নিয়োগ হয়েছিল ঘটা করে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে দেখা গেল, তিন মাস কাজ করার পরেও পারিশ্রমিক মিলল না। হাতে লাঠি নেই। ইউনিফর্ম নেই। এমনকী, ন্যূনতম প্রশিক্ষণটুকুও নেই। ফলে রাজ্যের অন্যান্য জেলার মতো হুগলিতেও সিভিক পুলিশের দশা ঢাল তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দারের মতো।
গত ১৯ জানুয়ারি পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরিতে এক সিভিক পুলিশকর্মীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। আগে তিনি ফুচকা বিক্রি করতেন। সিভিক পুলিশের কাজ পাওয়ার পর ফুচকা বিক্রি ছেড়ে দেন। কিন্তু বেতন মেলেনি। সেই কারণেই তিনি আত্মঘাতী হন বলে ওই যুবকের পরিবারের অভিযোগ। অন্য দিকে, ওই দিনই মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘিতে মদ্যপদের সামলাতে গিয়ে তাঁদের হাতে বেধড়ক মার খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় দুই সিভিক পুলিশকর্মীকে। হুগলিতে তেমন ঘটনা সামনে না এলেও নিজেদের নিরাপত্তা সুরক্ষিত না হওয়ায় এবং বেতন না মেলায় ক্ষোভ বাড়ছে সিভিক পুলিশ কর্মীদের মধ্যে। বেতন না পেয়ে অনেকে কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন বলে পুলিশ মহলের একটি অংশ স্বীকারও করেছেন। তবে শীঘ্রই বেতন মিলবে বলে পুলিশকর্তাদের একাংশ জানিয়েছেন। পাশাপাশি তাঁরা জানান, রাজ্যের নির্দেশ মতোই সিভিক পুলিশদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে।
গত নভেম্বর মাসে দুর্গাপুজোর পরে ঢাকঢোল পিটিয়ে হুগলির সব ক’টি থানায় বেশ কয়েক হাজার যুবক-যুবতীকে সিভিক পুলিশ হিসেবে নিয়োগ করা হয়। রীতিমতো ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে প্রার্থী বাছাই করা হয়। প্রশাসনের বক্তব্য অনুযায়ী, মূলত উৎসব বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো পরিস্থিতিতে অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করার জন্যই সিভিক পুলিশ কর্মীদের নেওয়া হয়েছিল। তবে, রাজ্যের পাঠানো সময়সীমা অনুযায়ী কাজ দিতে যান নিয়ন্ত্রণ-সহ অন্যান্য ‘ডিউটি’ দেওয়া হচ্ছে। যদিও তিন মাস কেটে গেলেও কোনও টাকাই হাতে পাননি ওই যুবক-যুবতীরা। কাজের দিন-পিছু ১৪০ টাকা করে পাওয়ার কথা সিভিক পুলিশদের। কিন্তু সামান্য এই টাকাও পাচ্ছেন না তাঁরা।
পুলিশ সূত্রের খবর, সিভিক পুলিশদের জন্য কোনও পোশাক বিধি নেই। সাধারণ পোষাক পরেই ডিউটি করতে হয়। বুকে ঝোলানো ব্যাজে লেখা থাকে ‘সিভিক পুলিশ ভলেন্টিয়ার’। খালি হাত। এই ভাবেই তাঁদের রাস্তার গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলিতে ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে। কোনও জায়গায় হাসপাতালেও মোতায়েন করা হচ্ছে তাঁদের। ব্যাঙ্কের সামনে নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করানো হচ্ছে। শীতকালে পিকনিক স্পটে অথবা সাংস্কৃতিক বা বিচিত্রানুষ্ঠানেও ভিড় সামলাতে এঁদের কাজে লাগানো হচ্ছে। তাঁদের অভিযোগ, ইউনিফর্ম না থাকায় সে ভাবে মান্যতা পাচ্ছেন না তাঁরা। সঙ্গে কোনও পুলিশকর্মী না থাকলে গোলমালের পরিস্থিতি সামলাতে এগিয়ে যাওয়ার সাহসে কুলাচ্ছে না।
হুগলি পুলিশ সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই বিভিন্ন থানার তরফে সিভিক পুলিশদের কাজের বিবরণ দিয়ে পারিশ্রমিক চেয়ে বিল পাঠানো হয়েছে জেলা পুলিশের সদর দফতরে। কিন্তু টাকা কবে মিলবে, সে ব্যাপারে স্পষ্ট উত্তর নেই। জেলার একটি থানা ওসি বলেন, “পরিস্থিতি দেখে অনেক ছেলেমেয়ের এই কাজ থেকে মন উঠে গিয়েছে।” তাঁর বক্তব্য, “ওঁদের প্রশিক্ষণ না থাকায় মুশকিল অনেক। ধরুন কেউ ট্র্যাফিক ডিউটি করছেন। ওঁদের ভুলে কোনও ঘটনা ঘটলে, সেই দায় কে নেবে?” জেলার বর্ষীয়ান পুলিশ অফিসারদের অবশ্য ধারণা, সিভিক পুলিশদের সঠিক প্রশিক্ষণ দিয়ে রাস্তায় নামনো হলে গোটা পুলিশি ব্যবস্থা অনেকটা চাঙ্গা হতে পারত। তা না করে স্রেফ চমক দেওয়ার জন্যই আনকোরা অবস্থায় কিছু ছেলেকে এই ভাবে কাজ দেওয়া হল বলে তাঁদের বক্তব্য। প্রকাশ্যে অবশ্য কেউই মুখ খুলছেন না।
জেলার কয়েক জন সিভিক পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মাসের পর মাস সরকারের হয়ে কাজ করেও টাকা না পেয়ে হতাশ তাঁরা। এক জন বলেই ফেললেন, “এখানে স্থায়ীকরণের কোনও সম্ভাবনা নেই, সেটা জানতাম। কিন্তু পরিশ্রমের টাকাটুকু না পেলে এ ভাবে কদ্দিন কাজ চালাতে পারব জানি না।” |