নিজেদের হকের টাকা। তা-ও পেতে লড়াই করতে হল প্রায় ১২ বছর। হাওড়ার বাউড়িয়ায় দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা সুতোকল ‘বাউড়িয়া কটন মিল’-এর শ্রমিকেরা প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা পেতে শুরু করেছেন। সাড়ে চার হাজার শ্রমিকের মধ্যে প্রায় ৮০০ শ্রমিক ইতিমধ্যেই তাঁদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা পেয়ে গিয়েছেন বলে হাওড়া আঞ্চলিক প্রভিডেন্ট ফান্ড কমিশনারের দফতর থেকে জানা গিয়েছে। বাকিদের আবেদনপত্রও পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। কাগজপত্র ঠিক থাকলে তাঁরাও এই টাকা পেয়ে পেয়ে যাবেন বলে শ্রম কমিশনারের দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে।
নিজেদের হকের টাকা পেতে কেন লাগল এত বছর? এই সুতোকলের শ্রমিকেরা জানান, তাঁদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা জমা পড়ত ট্রাস্টি বোর্ডে, যার সদস্য ছিলেন একদিকে নির্বাচিত শ্রমিক প্রতিনিধি, অন্য দিকে প্রভিডেন্ট ফান্ড কমিশনার এবং কারখানা কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি। ট্রাস্টি বোর্ড-ই শ্রমিকদের বেতন থেকে কেটে নেওয়া এবং মালিকদের প্রদেয় এই দুই তরফের টাকা ব্যাঙ্কে জমা করত। অবসর নেওয়ার পরে শ্রমিকদের প্রভিডেন্ট ফান্ড বাবদ প্রাপ্য টাকা হিসাব করে মিটিয়ে দিত ট্রাস্টি বোর্ড। কিন্তু ১৯৯৫ সালের ১৮ মার্চ সুতোকলটি বন্ধ হয়ে যায়। তার পর থেকে বহু আন্দোলন হলেও সুতোকলটি আর খোলেনি।
এরপরেই শ্রমিকেরা ২০০২ সাল থেকে প্রভিডেন্ট ফান্ড-এর টাকা ফেরতের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। কিন্তু রাজ্য প্রভিডেন্ট ফান্ড কমিশনারের দফতর থেকে তাঁদের সাফ জানানো হয়, ট্রাস্টি বোর্ড-এর অধীনে টাকা রয়েছে। ফলে সেই টাকা ফেরত দেওয়া কমিশনারের তরফ থেকে সম্ভব নয়। দীর্ঘদিন সুতোকল বন্ধ থাকায় ট্রাস্টি বোর্ড কার্যত অকেজো হয়ে পড়ে। শ্রমিকেরা পাল্টা দাবি করেন, ট্রাস্টি বোর্ড ভেঙে দিয়ে সেই টাকা যেন প্রভিডেন্ট ফান্ড কমিশনারের দফতর নিজেদের হেফাজতে নিয়ে নেয়। কিন্তু আইনি জটিলতার কারণ দেখিয়ে সেই দাবি মানতেও অস্বীকার করে প্রভিডেন্ট কমিশনারের দফতর। দিল্লিতে শ্রম দফতরের কাছে তাঁরা একই দাবিতে আন্দোলনে নামেন তাঁরা। শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালে দাবিটি মেনে নেয় কেন্দ্রীয় শ্রম দফতর। রাজ্য কমিশনারের কাছে তারা নির্দেশ দেয় ট্রাস্টি বোর্ড ভেঙে দিয়ে কমিশনারের দফতর যেন নিজেরাই এই সুতোকলের প্রভিডেন্ট ফান্ড-এর টাকা নিজেদের হেফাজতে নেয় এবং তা শ্রমিকদের দিয়ে দেয়।
কিন্তু শ্রম দফতর এই নির্দেশ দেওয়ার পরেও সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকেরা টাকা হাতে পাননি। এই নির্দেশেরও প্রায় দু’বছর পরে ২০১৩ সালের মে মাসে হাওড়ার আঞ্চলিক প্রভিডেন্ট ফান্ড কমিশনারের দফতর সুতোকলের শ্রমিকদের দরখাস্ত জমা দেওয়ার কথা বলেন। ওই সময় থেকেই দরখাস্ত জমা পড়তে শুরু করে। আঞ্চলিক প্রভিডেন্ট ফান্ড কমিশনারের দফতর থেকে জানা গিয়েছে, বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময়ে কারখানার শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার হাজার হলেও এ পর্যন্ত আবেদনপত্র জমা পড়েছে প্রায় একহাজারের মতো। বাকিরাও আবেদন করতে পারেন।
২০১১ সালে কেন্দ্রীয় শ্রম দফতর নির্দেশ দেওয়ার পরেও কেন টাকা দিতে প্রায় দু’বছর দেরি হল? এই প্রশ্নের উত্তরে আঞ্চলিক প্রভিডেন্ট ফান্ড কমিশনারের দফতরের এক আধিকারিক জানান, ট্রাস্টি বোর্ড টাকা নিয়ে কোথায় রেখেছিল বা কোথায় লগ্নি করেছিল তা অনুসন্ধান করতেই অনেকটা সময় লেগে যায়। টাকার সন্ধান মেলার পরেই শ্রমিকদের আবেদন করতে বলা হয়। তবে দেরিতে হলেও টাকা পেয়ে শ্রমিকেরা খুশি। এই কারখানার শ্রমিক বলরাম হালদার, সামসুর রহমান বলেন, “শেষ পর্যন্ত যে আমরা হকের টাকা পেয়েছি সেটাই তো বড় কথা। এটা আমাদের লড়াইয়েরই ফল।” শ্রমিকদের এই দাবি নিয়ে যে শ্রমিক সংগঠন মূলত আন্দোলন করেছে সেই বাউড়িয়া কটন মিল সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়নের মুখ্য উপদেষ্টা কুশল দেবনাথ বলেন, “রাজ্যে বহু বন্ধ কারখানা রয়েছে তাদের টাকা গচ্ছিত রয়েছে ট্রাস্টি বোর্ড-এর হাতে। ট্রাস্টি বোর্ড অচল হয়ে পড়েছে ওইসব কারখানাতেও। ফলে শ্রমিকেরা টাকা পাচ্ছেন না। আমরা ওইসব কারখানার ট্রাস্টি বোর্ড ভেঙে দিয়ে সরাসরি যাতে প্রভিডেন্ট ফান্ড কমিশনার শ্রমিকদের প্রাপ্য টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করে সেই দাবিতে রাজ্য জুড়ে আন্দোলন করব।” রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুও বাউড়িয়া কটন মিলের শ্রমিকদের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “অন্য বন্ধ কারখানার শ্রমিকেরাও যদি একই দাবিকে রাজ্য প্রভিডেন্ট ফান্ড কমিশনারকে চিঠি দেন এবং আমাকেও সেই চিঠির একটি নকল দিয়ে রাখেন এ ব্যাপারে রাজ্য সরকারের তরফে আইনিভাবে যা সম্ভব তা করা যাবে।” |