মাসের পর মাস চলে গেলেও পানাগড়ে জাতীয় সড়কের ফাঁস খুলছে না। সাধারণ মানুষ থেকে কলকাতা-দুর্গাপুর-ঝাড়খণ্ড যাতায়াত করা শিল্পপতি, বীতশ্রদ্ধ সকলেই। যানজট এড়াতে বাইপাস গড়া হবে জানিয়েও রাস্তার কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছেন না জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ (এনএইচএআই)।
কোথায় আটকে আছে কাজ? এক কথায় উত্তর: জমির জটে। বাইপাস গড়তে গেলে যতটা জমি অধিগ্রহণ করতে হবে, তা আজও করা যায়নি। এনএইচএআই-এর প্রকল্প অধিকর্তা (দুর্গাপুর) কৃষ্ণমুরারীর বক্তব্য, “আমাদের হাতে এখনও জমি তুলে দেওয়া হয়নি। তাই কাজও শুরু করা যায়নি।” বর্ধমানের অতিরিক্ত জেলাশাসকের (ভূমি অধিগ্রহণ) দফতর সূত্রে আবার বলা হচ্ছে, এনএইচএআই টাকা না দেওয়াতেই অধিগ্রহণ থমকে রয়েছে। যদিও কৃষ্ণমুরারীর দাবি, যখন যেমন টাকা চাওয়া হচ্ছে, তা-ই দেওয়া হচ্ছে। |
জাতীয় সড়ক নির্মাণ ও সম্প্রসারণের জন্য এনএইচএআই তাদের নিজস্ব আইনে জমি অধিগ্রহণ করে। নিয়ম অনুযায়ী, বর্ধমানের অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি অধিগ্রহণ) উৎপল বিশ্বাসকে জমি অধিগ্রহণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁর দফতর সূত্রের দাবি, জমিমালিকদের শুনানিতে ডেকে ক্ষতিপূরণের হার চূড়ান্ত করার পরে এক দফা টাকা এসেছিল। চেক বিলিও হয়ে গিয়েছে। উৎপলবাবু বলেন, “এনএইচএআই পরের দফার টাকা দিলেই বাকি জমিমালিকদের চেক দেওয়া হবে।” এনএইচআই-এর পূর্বাঞ্চলীয় চিফ জেনারেল ম্যানেজার অজয় অহলুওয়ালিয়া বলেন, “আশা করছি, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ফের টাকা দেওয়া যাবে।”
২০০১ সালে কেন্দ্রীয় স্বর্ণ চতুষ্টয় প্রকল্পে ২ নম্বর জাতীয় সড়কের ডানকুনি থেকে বরাকর পর্যন্ত অংশ চার লেন হওয়ার সময়ে পানাগড় বাজার এলাকার লোকজন বাধা দেন। আপত্তির কারণ, রাস্তা সম্প্রসারণ করতে গেলে দোকান-বাজার-বাড়ি ভাঙা পড়বে। ফলে দার্জিলিং মোড় থেকে পানাগড় বাজার পেরিয়ে ও পাশে রেল ওভারব্রিজ সওয়া তিন কিলোমিটার রাস্তা দু’লেনেরই থেকে গিয়েছে। এ দিকে যত দিন যাচ্ছে, গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। শুধু দুর্গাপুর থেকেই সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে কলকাতা যাওয়ার বাস চালু হয়েছে শ’পাঁচেক। ভিন্ রাজ্যের গাড়ি তো আছেই। বীরভূম থেকে দার্জিলিং মোড়ে এসে মিশেছে পানাগড়-মোরগ্রাম রাজ্য সড়কও। দু’দিক থেকে অগুনতি গাড়ি পানাগড় বাজারের মুখে এসে আটকে যাচ্ছে।
নিত্য যানজট এড়াতে এনএইচএআই বাইপাস তৈরির পরিকল্পনা করেছে। পানাগড় বাজার এড়িয়ে সামান্য ঘুর পথে কাঁকসা, পন্ডালি, ধরলা ও সোঁয়াই মৌজার উপর দিয়ে তা নিয়ে যাওয়া হবে। ইতিমধ্যে ঝাড়খণ্ডের ধানবাদ জেলার বারোয়াড্ডা থেকে পানাগড় পর্যন্ত ১১৪ কিলোমিটার রাস্তা ছ’লেনের করার জন্য ১৬৬৫ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ হয়েছে। মোট ১৯৩ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। তার মধ্যেই পানাগড় বাইপাসের প্রায় ৮ কিলোমিটার ধরা আছে। চার মৌজা মিলিয়ে অধিগ্রহণ করা হবে প্রায় ৭৩ একর জমি। জমিমালিকের সংখ্যা একশোর উপরে। জমির সর্বোচ্চ বাজারদর, তার ৩০ শতাংশ অতিরিক্ত এবং ১২ শতাংশ সুদ মিলিয়ে একর পিছু সর্বোচ্চ প্রায় ৬০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ নির্ধারিত হয়।
গত বছর ১ মে তৎকালীন জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনা জানিয়েছিলেন, জুনের শেষে এনএইচএআই-এর হাতে জমি তুলে দেওয়া হবে। জুলাই থেকে কাজ শুরু হবে। কিন্তু তার পরেও সমস্যা মেটেনি। এনএইচএআই প্রথম দফায় ২৮ কোটি টাকা দিয়েছিল। তার বেশির ভাগটাই বিলি হয়ে গিয়েছে। এখনও বেশ কিছু জমিমালিক রয়ে গিয়েছেন যাঁরা ক্ষতিপূরণ পাননি বা নেননি। কিছু জায়গায় আবার বাড়তি দরের দাবি উঠেছে। ধরলা মৌজার শ্রীকান্ত কোনার, অলোক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রদীপ দে-র দাবি, “এক ফসলি জমিতে যদি একর পিছু ৬০ লক্ষ টাকা মেলে, এই মৌজার তিন ফসলি জমির জন্য ২ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ চাই। কাজও দিতে হবে। অন্যথায় একর পিছু তিন কোটি টাকা চাই।”
আগে অধিগৃহীত জমি নিয়েও নয়া জটিলতা তৈরি হয়েছে। ২০০৯ সালে কাঁকসা মৌজার মাধবমাঠ এলাকায় শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করেছিল রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগম। স্থানীয় জমিমালিক, প্রয়াত গদাধর পালের ভাইপো উত্তম পাল বলেন, “একর পিছু ১০ লক্ষ ৪০ হাজার টাকায় কাকার জমি নেওয়া হয়। শিল্প হয়নি। আমরা কেন বঞ্চিত হব?” প্রয়াত নিতাই দত্তেরও প্রায় ১৫ কাঠা জমি গিয়েছে। তাঁর নাতি বাপন দত্তের বক্তব্য, “দামে পোষায়নি বলে তখন টাকা নিইনি। এখন রাস্তা হিসেবেই ক্ষতিপূরণ চাই।” উৎপলবাবু বলেন, “রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগম ওই সব
জমি এনএইচএআই-এর হাতে তুলে দিচ্ছে। ওই দুই দফতরই যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নেবে।”
কাঁকসার মাস্টারপাড়ার মতো কিছু এলাকায় আবার বাইপাসের জন্য বাড়ি ভাঙা পড়ার সম্ভাবনা থাকায় কিছু মানুষ ক্ষুব্ধ। স্থানীয় ভূমি ও গৃহরক্ষা কমিটির সম্পাদক সন্তোষকুমার দাসের আক্ষেপ, বাড়ি ভাঙা পড়বে বলেই এক সময়ে পানাগড় বাজারে রাস্তা চওড়া করতে দেওয়া হয়নি। অথচ বাইপাসের জন্য অন্তত আড়াইশো বাড়ি ভাঙা পড়বে। উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের দাবি জানিয়ে তাঁরা মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রশাসনের বিভিন্ন মহলে চিঠি দিয়েছেন। উৎপলবাবু বলেন, “ভূমি অধিগ্রহণ আইনে যদি সেই সংস্থান থাকে তাহলে তাঁরা তা পাবেন।” কিছু এলাকায় আবার ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহ, গাড়ি ভাড়া নেওয়া এবং বেকারদের কাজের দাবিও যোগ হচ্ছে। সোঁয়াই-পন্ডালি-ধরলা জমিরক্ষা কমিটির সম্পাদক নীলাদ্রি মুখোপাধ্যায় বলেন, “যে সমস্ত ঠিকাদার রাস্তা নির্মাণের কাজ করবেন, তাঁদের সামগ্রী সরবরাহ করে জমি মালিকেরা দু’পয়সা আয় করতে চান।”
জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে এই ধরনের দাবি-দাওয়া বা দর কষাকষি নতুন কিছু নয়। কিন্তু চেক দেওয়ার কাজ এগোচ্ছে না কেন?
অতিরিক্ত জেলাশাসকের দফতর সূত্রের দাবি, দ্বিতীয় দফার টাকা চাওয়া হলে এনএইচএআই আপত্তি তুলে বলে, খুব বেশি হারে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি রাজ্যের অতিরিক্ত মুখ্যসচিব এবং ভূমি ও পূর্ত দফতরের প্রধান সচিবকে জানানো হয়েছিল। রাজ্য সরকারের সঙ্গে বৈঠকের পরে এনএইচএআই আর ওজর-আপত্তি করেনি। কিন্তু নতুন করে আর টাকাও পাঠায়নি। এনএইচআই-এর পূর্বাঞ্চলীয় চিফ জেনারেল ম্যানেজার অবশ্য জানান, কী হারে ক্ষতিপূরণ দেওয়া যেতে পারে, তা ঠিক করেন অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি অধিগ্রহণ)। তাঁরা কী প্যাকেজ দিতে চাইছেন তা রাজ্য প্রশাসনের থেকে জানার পরে তাঁরা উপদেষ্টা কমিটির মতামতও নিয়েছেন। অহলুওয়ালিয়া বলেন, “টাক সব জটিলতা কাটিয়ে কাজ কবে শুরু হবে, তা অবশ্য বহু দূরের প্রশ্ন। |