সবে দমদম স্টেশন ছেড়ে কিছুটা এগিয়েছে শিয়ালদহমুখী রানাঘাট লোকাল। শনিবার সকাল সাড়ে ৬টা। হঠাৎ বিকট শব্দ। যাত্রীরা দেখলেন, চার দিক ধুলোয় ঢেকে গিয়েছে। সঙ্গে বার দু’-এক বিদ্যুতের ঝলকানি আর প্রবল ঝাঁকুনি। দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের মধ্যে অনেকে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন কামরার মধ্যে। জিনিসপত্র ছিটকে গেল এদিক-ওদিক। কেউ ভাবলেন, ভূমিকম্প। আতঙ্কের কয়েকটা মুহূর্ত কাটার পর কয়েক জন যাত্রী দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলেন, লাইন থেকে বেরিয়ে মাটিতে নেমে গিয়েছে ট্রেন। নয় কামরার ওই ট্রেনের সাতটি কামরাই লাইনচ্যুত হয়েছে। গতি কম থাকায় পরিণতি ভয়ঙ্কর হয়নি। যদিও এর জেরে শুক্রবার দিনভর নিদারুণ ভোগান্তি হল শিয়ালদহ উত্তরের তিন শাখার যাত্রীদের। সন্ধে পর্যন্ত বাতিল হল ৫৪ জোড়া লোকাল। দূরপাল্লার ট্রেন চলল অস্বাভাবিক দেরিতে।
|
রানাঘাট লোকালের লাইনচ্যুত একটি কামরা। ছবি: শৌভিক দে। |
রেল স্বীকার করছে, তাপমাত্রার তারতম্যের জেরে লাইনে তৈরি হওয়া ফাটলের দিকে ঠিক মতো নজর না দেওয়ায় তা ক্রমশ বাড়তে বাড়তে এ দিনের দুর্ঘটনা ঘটেছে। রেলের বক্তব্য, গতি কম থাকার জন্যই বড়সড় দুর্ঘটনা এড়ানো গিয়েছে। দমদম স্টেশন ছেড়ে সবে ছেড়ে ট্রেনটি এগোচ্ছিল ২ নম্বর লাইন দিয়ে।
গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটারের কিছু বেশি। দুর্ঘটনার জেরে এক কিলোমিটারেরও বেশি লাইন ভেঙে গিয়েছে। তবে এ ঘটনায় কারও মৃত্যু হয়নি, কেউ গুরুতর জখমও হননি। কামরায় ছিটকে পড়ায় কয়েক জন যাত্রী চোট পেয়েছেন।
রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। তদন্ত শুরু করেছেন রেলের সেফটি কমিশনার। রেলে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ যে শিকেয় উঠেছে, এ দিনের ঘটনায় তা ফের প্রমাণিত হল বলে রেলকর্তাদের একাংশই মনে করছেন। এ দিন সকালেই সাড়ে ৯টা নাগাদ হালিশহর স্টেশনের কাছেও তাপমাত্রার হেরফেরে ডাউন লাইনে বড়সড় ফাটল ধরা পড়ে। সেখানে কোনও ট্রেন লাইনচ্যুত না হলেও সব মিলিয়ে শিয়ালদহ মেইন, বনগাঁ, বসিরহাট, ডানকুনি সব লাইনেই ট্রেন চলাচল দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এ দিন সন্ধে পর্যন্তই ৫৪ জোড়া লোকাল ট্রেন বাতিল করা হয়েছে বলে রেল সূত্রের খবর। রাজধানী এক্সপ্রেস-সহ কয়েকটি দূরপাল্লার ট্রেনের শিয়ালদহে ঢোকা ও বেরোনোয় দেরি হয়। দমদমে ১ এবং ২ নম্বর লাইনে সারা দিন ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় যাত্রীদের চূড়ান্ত হেনস্থা হতে হয়। বারাসত স্টেশনে যাত্রীরা বেলা পৌনে ১০টা নাগাদ বিক্ষোভ দেখান।
বিক্ষোভকারীরা ইট-পাটকেল ছোড়ে। কিছু ক্ষণের মধ্যে অবশ্য সেখানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। ট্রেন না পাওয়ায় যাত্রীদের তুমুল ভিড় আছড়ে পড়ে সড়কপথে। কিন্তু বাসের সংখ্যা যখন এমনিতেই কমে গিয়েছে, তখন ওই অতিরিক্ত ভিড় সামাল দেওয়ার ক্ষমতা রাস্তায় থাকা হাতে গোনা যানবাহনের ছিল না। ফলে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ছাত্রছাত্রী এ দিন পরীক্ষা থাকা সত্ত্বেও সময় মতো পৌঁছতে পারেননি। কর্মস্থলে পৌঁছতে পারেননি অনেকে।
যশোহর রোড, বি টি রোড, দমদম রোডের মতো রাস্তায় চলে আসা ট্রেনযাত্রীদের ভিড় সামলাতে হিমশিম খেয়েছে পুলিশ। ব্যারাকপুরের চিড়িয়ামোড়, খড়দহ, পানিহাটি, সোদপুরের মতো জায়গায় তখন থিকথিকে ভিড়। মওকা বুঝে ট্যাক্সি, অটোরিকশা, ট্রেকার ভাড়া হেঁকেছে ইচ্ছে মতো। উপায় না থাকায় অস্বাভাবিক রকম ভাড়া দিয়ে লরি, ম্যাটাডরে চেপেও গন্তব্যে পৌঁছতে হয়েছে অনেককে। |
চলছে লাইন সারাইয়ের কাজ। শনিবার দমদম স্টেশনের কাছে। ছবি: শৌভিক দে। |
এ দিন বেলা সাড়ে ১১টায় মৌখিক পরীক্ষা ছিল রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ব বিভাগের ছাত্রী অঞ্জনা সরকারের। তাঁর কথায়, “সকাল ৯টায় ব্যারাকপুর স্টেশনে গিয়ে ট্রেন না পেয়ে বি টি রোডে উঠে দেখলাম, জনসমুদ্র। বাস দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছেন মানুষ। কোনও রকমে একটা বাসে উঠলাম। কিন্তু বাদুড়ঝোলা অবস্থায় বেশি দূর যেতে পারলাম না। শেষমেশ একটা ম্যাটাডরে উঠে পৌঁছলাম রবীন্দ্রভারতীতে।”
স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার কর্মী সুদীপ ঘোষ কিন্তু এ দিন কর্মস্থলে পৌঁছতেই পারেননি। কল্যাণী থেকে সকাল আটটা নাগাদ ট্রেন ধরে অফিসে যাওয়ার কথা ছিল সুদীপবাবুর। স্টেশনে গিয়ে ট্রেন না পেয়ে তিনি বাড়ি ফিরে যান। সুদীপবাবু বলেন, “মাসের এই প্রথম দিনে বহু বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ব্যাঙ্ক থেকে পেনশনের টাকা তোলেন। মূলত আমার কাউন্টার থেকেই পেনশনের টাকা দেওয়া হয়। চাবিও থাকে আমার কাছে। কিন্তু যেতেই পারলাম না।”
নিত্যযাত্রীদের পাশাপাশি ক্ষোভ লাইনচ্যুত ট্রেনের যাত্রীদেরও। তাঁদের বক্তব্য, দুর্ঘটনার পর ১৫-২০ মিনিট কেটে গেলেও রেলের তরফে কারও দেখা মেলেনি। কোলে মার্কেটের সব্জি বিক্রেতা অসিত দাসের কথায়, “শ্যামনগর স্টেশন থেকে এ দিন সওয়া ৫টায় ডাউন রানাঘাট লোকালে উঠি। ট্রেন দমদম ছাড়ার কিছু পরেই প্রবল ঝাঁকুনি। কামরার মধ্যেই হুমড়ি খেয়ে পড়ি। ভাবলাম, ভূমিকম্প হয়েছে। পরে দেখলাম, আমাদের কামরাটা পুরো হেলে গিয়েছে।” ওই ব্যবসায়ী বলেন, “প্রথমে কিন্তু রেলের কেউ আসেননি। আমরা নিজেরাই ধরাধরি করে ট্রেন থেকে নেমেছি।” একই বক্তব্য কলেজ স্ট্রিটের একটি বাড়িতে আয়ার কাজ করা আগরপাড়ার মায়া রায়ের। তিনি বলেন, “আমার কয়েক জন পরিচিত দুর্ঘটনার পর আমাকে ট্রেন থেকে নামান। রেলের কারও দেখা পাইনি।”
ওই ডাউন রানাঘাট লোকাল দমদমের আরআরআই (রুট রিলে ইন্টারলক) কেবিন ছাড়িয়ে খানিকটা এগোনোর পরেই লাইনচ্যুত হয়। দমদম থেকে ওই জায়গার দূরত্ব মাত্র দু’শো মিটার। রেল কর্তৃপক্ষের দাবি, দুর্ঘটনার আধ ঘণ্টার মধ্যেই অ্যাক্সিডেন্ট রিলিফ ট্রেন ঘটনাস্থলে পৌঁছয়। দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনের যাত্রীদের একাংশ তখনও ট্রেনের মধ্যে আটকে ছিলেন। রেলকর্মীরা তাঁদের নামিয়ে অন্য ট্রেনে উঠিয়ে দেন। কিন্তু দুর্ঘটনাস্থল থেকে রেল লাইন ধরে হেঁটে দমদম যাওয়ার পথে অনেককে সমস্যায় পড়তে হয়। ওই পথের এক জায়গায় অনেকটা নীচে রয়েছে সাবওয়ে। সেখানে লাইনের মধ্যে শুধু স্লিপার ও পরপর প্রচুর ফাঁক। রীতিমতো ঝুঁকি নিয়ে সন্তর্পণে হেঁটে পার হতে হয় যাত্রীদের। মালপত্র নিয়ে পেরোতে অনেকেই অসুবিধেয় পড়েন।
দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনটি ২ নম্বর লাইনে ও ১ নম্বর লাইনে রিলিফ ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকায় ওই দু’টি লাইন বন্ধ ছিল। রেল সূত্রে খবর, সকাল ৯টা নাগাদ ৩ ও ৪ নম্বর লাইন দিয়ে অল্প অল্প করে ট্রেন চালানো শুরু হয়। কিন্তু কিছু ক্ষণ পর হালিশহরের কাছে লাইনে ফাটল ধরা পড়ায় সব কিছু জট পাকিয়ে যায়।
রেল সূত্রে খবর, বিকেল সাড়ে তিনটেয় দমদমের কাছে লাইনচ্যুত হওয়া ট্রেনটির সব ক’টি কামরা ওঠানো সম্ভব হয়। তবে তত ক্ষণে যা দুর্ভোগ হওয়ার হয়ে গিয়েছে। দমদমের ২ নম্বর লাইনে ট্রেন চলাচল শুরু হয় এ দিন রাত সাড়ে ৮ টা নাগাদ। রেলে রক্ষণাবেক্ষণের কাজটিই যে অবহেলিত, তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে কয়েক মাস ধরে ঘটা বিভিন্ন ঘটনায়। চলন্ত ট্রেনে আগুন ধরে যাত্রীদের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। এই নিয়ে গত ২১ জানুয়ারি সব জোনের জেনারেল ম্যানেজারদের নিয়ে বৈঠক ডেকেছিল রেল বোর্ড। রেল সূত্রের খবর, ওই প্রসঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণের ত্রুটির বিষয়টি সামনে আসে। রেলকর্তাদের একাংশের মতে, রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে যে ভাবে একের পর এক ট্রেন বাড়ানোর প্রতিযোগিতা চলছে, তাতে রক্ষণাবেক্ষণের সময়ই পাওয়া যাচ্ছে না। সাধারণত, মাঝরাতের পর লাইন পর্যবেক্ষণের কাজ হয়। গ্যাংম্যানেরা সেই কাজ করেন। কিন্তু রেলকর্তাদের একাংশের অভিযোগ, ইদানীং বেশ কিছু কর্মী নিয়োগ করা হলেও, তাঁরা এই কাজে তেমন দক্ষ নন। |