|
|
|
|
|
|
|
|
ইন্দ্রজিত্ হাজরা
|
সত্যি বলতে কী, আমার মিথ্যে বলতে খুব একটা খারাপ লাগে না। একটু দ্বিধা লাগে বইকী। তা হলেও যখন দিল্লির ফরেন করেসপন্ডেন্ট্স ক্লাবে বসে এক অ-কলকাতাবাসী বললেন, ‘কলকাতা তো চুলোয় গেছে’, আমার প্রিয় মিথ্যের থলি থেকে বার করলাম একটা সত্য ‘তা গেছে। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলার ব্যাপারে কলকাতা এখনও অদ্বিতীয়। ছিনতাই, খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি হয় না তা নয়। বড় শহরে এ সব একদম না হলে শহুরেপনাটা রইল কোথায়? কিন্তু দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরুর চেয়ে এখানে রাস্তাঘাটে বিভীষিকা-বিপদ অনেক মাত্রায় কম।’
আমার মিথ্যের লজিকটা কিন্তু নির্ভুল। ঝিনচ্যাক পার্ক স্ট্রিটই হোক বা পথের পাঁচালি-মার্কা সঁুটিয়া, কলকাতার আইন-শৃঙ্খলার যদি বারোটা বেজে থাকত, তা হলে লোকজনের মধ্যে কোনও ভয়ের চিহ্ন বা হতাশার ছাপ নেই কেন? আন্দোলন করে কলেজ স্কোয়ার থেকে এসপ্ল্যানেড হাঁটা তো ঠিক কায়রোর তাহ্রির স্কোয়ার বা ঢাকার শাহবাগে দিনের পর দিন বিক্ষোভ আর দাবি জানানোর মতন নয়। ওটা তো একটু ‘ম্যাডাম-দি, একটু দেখবেন প্লিজ’ ধাঁচের ছিল।
কলকাতার নাগরিকের এই নির্ভয়তার একটাই কারণ আশির দশকের শেষ বছরে কলকাতা জুড়ে লোকে বেদম ভয় পেয়েছিল। নিশির ডাকের সঙ্গে জ্যাক দ্য রিপার মেশালে যে ভয়ংকর এক চলমান অশরীরীর আবির্ভাব হয়, সেটাই ছিল ‘স্টোনম্যান’। বাবা-কাকারা তো বটেই, পাড়ার দাদারা পর্যন্ত ভয়ে ঠকঠক, রক ছাড়ে জলদি, গলির মুখে ক্যারমের পাট উঠিয়ে ঘরের ছেলেরা ঘরে ফেরে তাড়াতাড়ি। |
|
প্রথমে কেউই একদম পাত্তা দেয়নি। সেই বছর ৪ জুন তারিখে বেজিং-এর তিয়েন আনমেন স্কোয়ার-এ অনেক ছাত্রছাত্রীর হত্যা হয় চিনে সেনার হাতে। সেই একই দিনে লালবাজারের পুলিশ হেডকোয়াটার্স-এর পাশেই লালদিঘি এলাকার এক রাস্তায় ভোরের আবছা আলোয় খুন হলেন এক রাস্তায়-থাকা মহিলা। তাঁর দেহ পাওয়া যায় সকালে। পাশে একটা রক্তাক্ত বড় পাথর, যা দিয়ে তাঁর মাথাটা থ্যাঁতলানো হয়েছে বিশ্রী ভাবে।
পৃথিবীতে এত হই-হট্টগোলের মাঝে কলকাতায় এই মহিলার ঘুমন্ত অবস্থায় খুনের খবর নিয়ে কেউই মাথা ঘামায়নি। মহিলা নাকি ওই লালদীঘি এলাকায় চোলাই মদ বিক্রি করতেন আর রাস্তাতেই থাকতেন-ঘুমোতেন। এ রকম লোক খুন হলে কারও নজর পড়ে নাকি?
দ্বিতীয় খুন অবিকল ওই ভাবে ঘটে ঠিক এক মাস পরে। ৪ জুলাই আর একটা রাস্তায় পুলিশ আর একটা দেহ পায়। এ বার ভিক্টিম এক ভিখিরি। সেই মাথা-থ্যঁাতলানো অবস্থায়, আর পাশে একটা রক্তমাখা পাথর। এর পর তিন মাসে আরও চার-চারটে খুন হয় কলকাতার রাস্তাঘাটে। প্রত্যেক বার পাথর স্টোন দিয়ে নৃশংস হত্যা। প্রত্যেক বার শিকার রাস্তার ঘুমন্ত দরিদ্র মজদুর অথবা ভিখিরি। চোদ্দো বছরের একটা ছেলেকেও ছাড়ল না এই অদৃশ্য খুনি। সেপ্টেম্বর ৮ তারিখে সাত নম্বর হত্যা। এ বার ৩৫ বছরের এক উন্মাদ ভিখিরি টাইপ-এর দেহ পেল পুলিশ। অবশেষে কলকাতার নাগরিক উঠে বসল। পুলিশের দৃঢ় ধারণা, এই খুনগুলো এক জন লোকেরই কাজ। ভারী পাথর দিয়ে খুনের পদ্ধতি দেখে অনুমান করা গেল, খুনি এক জন লম্বা, শক্তিশালী পুরুষ। এক ইংরিজি কাগজ খুনির নাম দিল ‘স্টোনম্যান’।
১৯৮৯-এর পুজোর সময়ে স্টোনম্যানের ভয়ে কলকাতা স্তম্ভিত। পাথুরিয়াঘাটা থেকে পদ্মপুকুর, হাড়কাটা গলি থেকে হ্যারিংটন স্ট্রিট, কোনও এলাকাই স্টোনম্যানের ভয় থেকে রেহাই পেল না। অক্টোবর ১৯৮৯-এ, সাতটা খুন হওয়ার পর কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার রচপাল সিংহ লস অ্যাঞ্জেলেস টাইম্স-এর সাংবাদিককে বললেন, ‘প্রথম তিন-চারটে খুনের পর আমরা ভাবিনি যে এটা এক জন লোকের কাজ হতে পারে। হ্যাঁ, এটা মানছি যে প্রথমে আমাদের অতটা চিন্তা হয়নি কারণ যতই হোক, যারা খুন হয়েছে তারা সবাই রাস্তার লোক।...এখন আমরা খুব পাবলিকের চাপে আছি।...আর লোকেরাও খুব বুদ্ধিমান এখানে। ওরা খবরকাগজ ভীষণ মন দিয়ে পড়ে। ওরা এখন এই রহস্যের সমাধান চায়।’
এর পর মার্চ ১৯৯০ পর্যন্ত আরও ছ’টা ‘স্টোনম্যান হত্যা’ হয় কলকাতায়, সব শব মিলিয়ে তেরোটা। কোনও খুনের কোনও সাক্ষী নেই। উপায় না পেয়ে পুলিশের লোকদের সন্ধেবেলা থেকে দেখা যেত পাড়ায় পাড়ায় পাথর-ইট সরাতে। পাড়ার ক্রিকেট খেলার জন্য যে ইট সাজিয়ে রাখা হত পরের দিন উইকেট বানানোর কাজে, সেই ইটগুলো প্রায়ই হাওয়া হয়ে যেত।
পুলিশের খবরে জানা গেল, প্রত্যেকটা খুনই হয় রাত তিনটে আর ভোর পাঁচটার মধ্যে। কলকাতার রণে-বনে-দফতরে নানা থিয়োরি ভাসতে শুরু করল। অনেকের দৃঢ় বিশ্বাস, স্টোনম্যান একটা দৈত্যাকার মানুষ। অনেকে নিশ্চিত, খুনি এক পলাতক গরিলা বা গরিলা প্রকৃতির দানব। কেউ কেউ ভাবল, স্টোনম্যান এক জন তান্ত্রিক আর খুনগুলো মা চণ্ডীর চরণে নরবলি। রাস্তার মানুষ আর ভিখিরি স্টোনম্যানের নিশানা হলে কী হবে, আমরা সব মধ্যবিত্ত ঘরের পালোয়ানরা রাস্তাঘাটের দিকে তাকিয়ে নতুন রকমের ভয় শিখলাম।
পরে জানলাম, ১৯৮৯ অক্টোবর থেকে পুলিশ কলকাতার রাস্তা থেকে অনেক ‘উন্মাদ’ আর ‘ম্যানিয়াক’কে থানায় খপাখপ ভরতে শুরু করেছিল। অনেক পুলিশ আবার নকশাল আমলের মতন চাদর মুড়ি দিয়ে রিভলভার হাতে নিয়ে ঘাপটি মেরে রাস্তাঘাটে শুতে শুরু করল স্টোনম্যানের অপেক্ষায়। তার পর যে রকম শুরু সে রকম শেষ। মার্চ ১৯৯০-এ হঠাত্ বন্ধ হয়ে গেল স্টোনম্যানের হত্যার পালা।
কয়েক মাস কলকাতার লোকজন বসে থাকল চুপটি করে। এর আগের পাঁচ মাস ধরে রাত্রের চুরিচামারি একদম কমে গেছিল। আস্তে আস্তে আর কোনও পাথুরে-হত্যার খবর না পেয়ে চোরেরা আবার বেরোতে শুরু করল। আমরাও কলকাতার রাত আর ভোরবেলাগুলো ফেরত পেতে শুরু করলাম। কে যে ‘স্টোনম্যান’ আদৌ এক জনই হত্যাকারী ছিল কি না এর উত্তর আর পাওয়া গেল না।
সেই স্টোনম্যান-আতঙ্কের স্বাদ পেয়েই কিন্তু এই শহর আর রাজ্য হল চির কালের জন্য ভয়শূন্য। যে বিশ্বযুদ্ধ লড়েছে, সে কি আর পাড়ার মস্তানকে ভয় পায়? তাই এখন কলকাতায় সবাই নির্ভয়ে হেঁটে চলে শুয়ে বসে দাঁড়িয়ে বেড়ায়। যদি একটু গা-ছমছম, বুক ঢিপঢিপ করে, ও কিস্যু না। ভয় পাওয়াটা এই যুগে নিছক ষড়যন্ত্রকারীর চিহ্ন। |
|
|
|
|
|