|
|
|
|
|
|
রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ৪... |
|
|
আকিরা কুরোসাওয়া |
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত
|
একটা সময় যে ছবিগুলি সুযোগ পেলেই বার বার দেখতাম, কুরোসাওয়ার ‘রশোমন’ ছিল তার মধ্যে একটি। আর ‘বোলেরো’ প্রথম শুনেছিলাম স্ট্যাটিসটিক্সের মাস্টারমশাই তরুণ সান্যালের বাড়িতে। স্ট্যাটিসটিক্স পড়াতে পড়াতে অনেক সময়েই ক্লাসে বাখ, বেঠোফেন, মোত্সার্টকে নিয়ে বলতে শুরু করে দিতেন তরুণদা। বোলেরো আমি আজও শুনি, কিন্তু তখনও যেটা মেলাতে পারতাম না, তা হল রশোমন-এ একটি দৃশ্যে বোলেরো ব্যবহারের কারণটা, কেননা জাপানি সুর ও সংগীত কোনও ভাবেই ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল মিউজিকের ধারপাশ দিয়েও ঘোরাফেরা করে না। ভাবতাম, যদি কখনও কুরোসাওয়ার সঙ্গে দেখা হয়, জানতে চাইব, কী করে মেলালেন জাপানি চরিত্র, জাপানি সংলাপ, জাপানি দৃশ্যের সঙ্গে পৃথিবীখ্যাত ফরাসি সুরকার মরিস র্যাভেলের বোলেরো! কিন্তু এও জানতাম, কখনওই কুরোসাওয়ার সঙ্গে দেখাটেখা হবে না আমার, জানাও হবে না এই মিলিয়ে দেওয়ার রহস্যটা।
১৯৮০ সালে জাপান ফাউন্ডেশন তাদের প্রথম ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল করে সারা এশিয়ার তরতাজা আট জন ফিল্মমেকারের ছবি নিয়ে। এ দেশ থেকে দুজনকে ডাকলেন তাঁরা, কেরলের অরবিন্দন, ছবি: কুমাটি। আর কলকাতার আমি, ছবি: দূরত্ব। এক মাস ধরে জাপানের এক শহর থেকে আর এক শহরে ছবি দেখানো হবে, সঙ্গে পরিচালকরা যাবেন দর্শক আর ছবির মধ্যে ভাব-ভালবাসা করিয়ে দেওয়ার জন্য। সেই দিন আমরা আছি মাউন্ট ফুজির খুব কাছেই একটা বহু প্রাচীন জাপানি হোটেলে, যেখানে থাকতে গেলে ভিনদেশি জামাকাপড় সব খুলে নিয়ে তারা পরিয়ে দেয় কিমোনো। কিমোনো পরে অরবিন্দন আহ্লাদে আটখানা, বলল ফিরে গিয়ে এটা চালু করে দিতে হবে কেরলে। সন্ধেবেলা গোল হয়ে মাটিতে বসে শুরু হত আমাদের সাকি-পান। রোজকার মতো একটু পরেই সে দিনও অরবিন্দন কুমাটির একটা গান গাইতে গাইতে তার নিজস্ব নাচ শুরু করে দিল। নাচ যখন প্রবল আকার নিল, আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন এক অসামান্য সুন্দরী জাপানি মেয়ে। প্রথা মেনে অভিবাদন করে তিনি জানালেন, কাল দুপুরে খানাপিনার জন্য আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন যিনি, তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং আকিরা কুরোসাওয়া।
জাপানের আপ্যায়ন আর বিনয় দেখলে আমাদের নবদ্বীপের লোকজনও লজ্জা পাবে। আমি যত বার ঘাড় ঝুঁকিয়ে আমার শ্রদ্ধা জানাচ্ছি কুরোসাওয়াকে, উনিও সঙ্গে সঙ্গে ঠিক একই ভঙ্গিতে নত হচ্ছেন। বেশ কিছু ক্ষণ এ রকম চলার পর পেছন থেকে অরবিন্দন জলজ্যান্ত মালয়ালম ভাষায় বলে উঠল ধারা আলাম, মিরথু। অর্থাত্, ঢের হয়েছে, এ বার বোসো। শুরু হল খাওয়াদাওয়া। আর খানদানি জাপানি খাওয়া এক বার শুরু হলে তার শেষ যে কোথায়, কেউ জানে না। একের পর এক পদ আসতে শুরু করল, যার সবই আগেভাগে ঠিক করে রেখেছিলেন কুরোসাওয়া নিজেই। আস্তে আস্তে শুরু হল কথাবার্তাও। কুরোসাওয়া বলছেন জাপানি, যা তাঁর সেক্রেটারি, আগের দিনের সেই সুন্দরী, আমাদের জন্য ইংরেজি করে দিচ্ছেন। করব কি করব না ভেবে শেষমেশ করেই ফেললাম মনের ভেতর খচখচ করতে থাকা সেই প্রশ্ন: রশোমন-এ উনি কী ভেবে ব্যবহার করেছিলেন বোলেরো? কুরোসাওয়া একটু তাকিয়ে থেকে হেসে বললেন, ‘আসলে খুব সহজ। সুরের তো কোনও দেশ হয় না! দৃশ্যের সঙ্গে যে-কোনও সুরকেই মিলিয়ে দেওয়া যায়, যদি জানা থাকে কী ভাবে ও কখন তা করতে হবে।’ একটু পরে উনি জানতে চাইলেন, ‘আপনার কি কোনও অসুবিধা হয়েছিল?’ আমি বললাম, ‘একেবারেই নয়। আসলে বিস্মিত হয়েছিলাম, ভেবেছিলাম এ রকমও করা যায়!’
পদের পর পদ আসছে, ফুরিয়ে যাওয়া সাকির বোতলের জায়গায় আসছে নতুন উষ্ণ বোতল। আট জন আনকোরা ফিল্মমেকার ঘিরে রয়েছে ছ’ফুট দুই ইঞ্চির সেই পরিচালককে, যিনি একের পর এক বানিয়ে গিয়েছেন মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া অসামান্য সব ছবি। জাকার্তার এক পরিচালক, যাঁর ছবি সেই বারই বার্লিনে পুরস্কৃত হয়েছে, মাঝে মাঝেই জড়ানো গলায় বলে উঠছিলেন আর ইউ রিয়েলি আকিরা কুরোসাওয়া? আমারও চড়েছে একটু একটু, মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল সারা পৃথিবী জুড়ে আপনার দর্শক, তারা মাথায় করে রাখে আপনার ছবি, তবু কেন বার বার মৃত্যুর দিকে ছুটে যান আপনি? আত্মহত্যার চেষ্টা করেন? নিজের বাঁ হাতের কবজির দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছু ক্ষণ। কবজির ওপর আড়াআড়ি একটা বহু কালের শুকিয়ে যাওয়া কাটা দাগ। বললেন, আসলে নিজের ছবি দেখে মাঝে মাঝেই মনে হয় কিছুই করতে পারিনি।
এর পরের দেখা ভেনিসে। ১৯৮২। প্রতিযোগিতা বিভাগে দেখানো হচ্ছে ‘গৃহযুদ্ধ’। সত্যজিত্ রায় আর আন্দ্রেই তারকভস্কি জুরিতে। এক দিন দেখি দূর থেকে একা একা হেঁটে আসছেন কুরোসাওয়া। একদম একা, নিভৃত এক জন মানুষ। সারা পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালে এ ভাবেই খুঁজে পেয়েছি একা একা ঘুরে বেড়ানো বিখ্যাত সব পরিচালকদের। লোকার্নো-য় দেখেছিলাম রাস্তার দোকানে দাঁড়িয়ে স্যান্ডউইচ খাচ্ছেন গোদার। সেই একা, নিভৃত। কুরোসাওয়াকে দেখে এগিয়ে গেলাম। বললাম চিনতে পারছেন? উনি হেসে মাথা নাড়লেন। পরের দিন বিকেলে এক সঙ্গে কফি খাওয়ার কথা হল। কফিপান শেষ করে বড়সড় একটা প্যাকেট এগিয়ে দিলেন। বললেন, এটা আপনার জন্য। সেই প্যাকেটে ছিল কুরোসাওয়ার নিজের আঁকা ছবির একটি বই। ‘র্যান’-এর বিভিন্ন দৃশ্যের পেন্টিং, ছবি তৈরির আগে করা। জাপানি আর ইংরেজিতে সই করে দিলেন নিজের নামটা।
এর পরে কুরোসাওয়ার সঙ্গে আবার দেখা কান-এ ১৯৮৯ সালে। সেই বারই শেষ দেখা। ওঁর ছবি ‘ড্রিম্স’ দিয়ে ফেস্টিভ্যাল শুরু। কয়েক দিন পর ‘বাঘবাহাদুর’ দেখতে এসেছিলেন তিনি। ছবির শেষে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করলাম, একটু কফি খাবেন আমার সঙ্গে? হেসে সম্মতি জানালেন। জানালাম কী অসম্ভব ভাল লেগেছে ড্রিম্স। একটু চুপ করে থেকে বললেন, আপনি স্বপ্ন দেখতে ভালবাসেন? আমি বললাম, আলবাত। এমনকী দুঃস্বপ্নও। আবার হাসলেন কুরোসাওয়া, বললেন, আমি এমন মানুষ ভাবতেই পারি না যে স্বপ্ন দেখে না অথচ বেঁচে থাকে।
এখন মাঝে মাঝে চারপাশের দৃপ্ত উল্লাসময় সিনেমা-করিয়েদের দিকে তাকিয়ে কুরোসাওয়ার কথা মনে পড়ে। আশি বছর বয়সে ড্রিম্স বানিয়েও স্বপ্ন দেখার কথা বলেছিলেন আর সেই স্বপ্নের ছবি বানানোর তাড়নায় বার বার নিজেকে শেষ করতে চেয়েছিলেন। অথচ মিডিয়ার দিকে চির কাল পেছন ফিরে ডাঁটে দাঁড়িয়ে থাকা এই মানুষটির ছবি কাউকে না কাউকে স্বপ্নের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আজও।
|
|
|
|
|
|