রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ৩...
একটাভয়কষ্ট[লজ্জা]
ধ্যবিত্ত জীবনের বেশ অনেকটাই কেটে যায় পাবলিক ট্রান্সপোর্টে। আমাদের আজকের কাহিনির পরদা যখন উঠছে, আমি তখন টিনটিনি। বছর চোদ্দোর কিশোরী, যে কিনা পুজোর সময় হিল-জুতো কিনবে বলবে আছাড়িপিছাড়ি। সেই শীতের এক পড়ন্ত বিকেলে, ফাঁকা বাসে উঠে আমার ফ্যামিলি কোথাও একটা যাচ্ছিল। আমিই সেই পাকা মেয়ে, যে হিল-জুতো পরে খ্যাটরম্যাটর এবং হাঁটতে গেলেই পিছিয়ে পড়ছি। সমস্ত অবস্ট্যাক্ল-রেস পেরিয়ে বাসে উঠতেই বাস ছেড়ে দিল। হিল-পরা কিশোরী কোনও মতে টাল ও প্রেস্টিজ সামলে বাসের পেছন দিকের একটা রড ধরল, কিন্তু সেটা ওপরের হ্যান্ডেল নয়। বাস বড় বেয়াড়া, মাঝে মাঝেই এমন দুর্দান্ত ব্রেক কষে, যে দাঁড়িয়ে থাকা তাবত্‌ জনগণের প্রতিটি বল ও সকেট জয়েন্ট খসে পড়তে চায়। এমনই একটি ব্রেকের ঠিক ন্যানোসেকেন্ড আগে আমি রড ছেড়ে ওপরের হ্যান্ডেল ধরব বলে ঠিক করেছি, এবং হ্যঁা, সেই সেডিস্ট মুহূর্ত। বাসটা মোক্ষম ব্রেক কষল।
আর ঠিক সেই ন্যানোসেকেন্ডে আমার সামনে বসা মহিলাও ভাবলেন, জানলা থেকে মুখ ঘোরালে কেমন হয়। সুতরাং আশ্চর্য সমাপতন। আমি হাত ছেড়ে রড ধরব এবং উনি মুখ ফেরাবেন, এই মুহূর্তে ব্রেক। এবং বিশ্বচরাচর স্তব্ধ করে সেই মহিলার মুখে এক থাপ্পড়। আমার। কিন্তু এ কী হল?!!! মানে আমি ইচ্ছে করে মারিনি, বিশ্বাস করুন আমি রডটা ধরতে চেয়েছিলাম, হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছি, তখনই ব্রেক কষল, এ বাবা, আমি খুব সরি, লজ্জিত... কিন্তু এ সব কথা আমার মনেই থেকে গেল। মহিলা ককিয়ে উঠলেন, ‘উরি বাবা, এ কী মারে রে!’ এই উদ্ভট ডায়ালগ শুনে বাসসুদ্ধ সবাই হেসে ফেটে পড়ল। সঙ্গে আমিও।
কিছুতেই হাসি থামিয়ে ক্ষমা চাইতে পারছি না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এত খারাপ লাগছে! আমি কিছুতেই বোঝাতে পারছি না যে আমি এত খারাপ মেয়ে নই। এটা আমার ইচ্ছাকৃত নয়। খিলখিলখিল করে হেসেই চলেছি। ওই মুহূর্তটাই আমাকে এমন নির্লজ্জ এবং লজ্জাকর হাসি হাসিয়ে চলেছে, আমাকে আমার কোনও শাসন শোনাতেই দিচ্ছে না।
এবং কয়েক সেকেন্ড পরেই যখন মহিলার মুখ দেখলাম, তখন খুব খুব খুব কষ্ট হল আর লজ্জা হল। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী, আমার লজ্জার চেয়েও ওঁর লজ্জা বোধ হয় অনেক বেশি হয়েছিল। মাঝবয়সি এক জন আটপৌরে মহিলা, যিনি তাঁর হাঁটুর বয়সি এক জন মেয়ের কাছে থাপ্পড় খাচ্ছেন। এবং কথা নেই বার্তা নেই, খামখাই! আর, চারপাশের কেউ তো সমব্যথী হচ্ছেই না, উপরন্তু সবাই তাঁর দুর্দশায় হাসছে! আমি ঠিক বুঝতে পেরেছিলাম, ওঁর যত না রাগ হচ্ছে, তার চেয়ে লজ্জা লাগছে অনেক বেশি। ওঁর কান নিশ্চয়ই গরম হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে, বাসটা এখুনি থেমে যাক, আর উনি নেমে যান।
আর আমি? কিছু ক্ষণের মধ্যে হাসি চেপে নত মুখে দাঁড়িয়ে রইলাম। সত্যি বলছি, এমন একটা কাজ করে ফেলেও ওঁর কাছে কিছুতেই ক্ষমা চাইতে পারলাম না। ওঁর লজ্জা-অপমানের মুখটা দেখে আমার মুখে রা সরল না। তার ওপর, আমাকে তো আমি চিনি, কোত্থেকে সোডার মতো ভসভসিয়ে আবার হাসি বেরিয়ে আসবে, কে জানে। আমার এখনও ব্যাপারটা ভাবলেই খুব বাজে লাগে, আবার কাউকে বলতে গিয়ে খি-খি করে হেসেও ফেলি। লজ্জা পাই, ঘটনাটার জন্যও, হাসিটার জন্যও।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.