রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২...
খুদকুঁড়ো
বেণুদার সঙ্গে ঘনাদার তফাত ছিল এটুকুই যে, ঘনাদার গল্পে বিস্তর সত্যিকারের তথ্য থাকে, মজাও থাকে। বেণুদার তা নয়। আমার বেশ দূর সম্পর্কের দাদা। বয়সে অন্তত আমার চেয়ে পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের বড়। ব্যাচেলর ছিলেন বলে বেশির ভাগ আয়ুষ্কালই নানা মেস আর বোর্ডিং হাউসে কাটিয়েছেন। তবে আত্মীয়বত্‌সল ছিলেন খুব। দেওয়া-থোওয়ারও হাত ছিল। এল আই সি-তে কেরানির চাকরি করতেন। দায়-দায়িত্ব ছিল না তেমন। সুতরাং বেশ সচ্ছল। লোক খারাপ নন, কিন্তু ওই একটু ঘনাটে গোলমাল।
সন্ধেবেলা এক দিন আমার মধ্য কলকাতার বোর্ডিং-এর ঘরে এসে বললেন, ‘কাইল একটা কাণ্ড হইল, বুঝলি? কাইল পাহাড়ীমামার বাড়িতে গেছিলাম। আমারে পাইয়া পাহাড়ীমামার তো খুব আহ্লাদ। কইল কী জানস? কইল, আরে ভাইগ্না, আইজ না তোমার জন্মদিন? আসো, আইজ আমার বাড়িতেই তোমার জন্মদিন করি।’ আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘পাহাড়ীমামাটা আবার কে?’ ‘আরে পাহাড়ীমামা হইল গিয়া পাহাড়ী সান্যাল।’ পাহাড়ী সান্যাল কোন সুবাদে বেণুদার মামা হলেন, তা আমার মাথায় আসছিল না। উনিই করুণাপরবশ হয়ে বললেন, ‘বুঝলি না? পাহাড়ী সান্যাল হইল গিয়া আমার মাইজ্যা জেঠিমার খুড়াতো ভাই।’
তখন এমএ পড়ি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। থাকি শ্রীগোপাল মল্লিক লেনের ইউনিভার্সিটির হোস্টেলে। এক ছুটির দিনে বেণুুদা এসে হাজির। ওঁর খুব ইচ্ছে আমাকে একটা পাঞ্জাবি করে দেবেন। আমাকে নিয়ে চললেন দরজির দোকানে। যেতে যেতে বললেন, ‘বুঝলি, গত রবিবার আমার মিছরিমাসির বাড়িতে ভ্যাকাদার লগে দেখা হইল। আমি কিন্তু কইলাম, ভ্যাকাদা তুমি কিন্তু কামটা ভাল কর নাই। ভ্যাকাদা জিগাইল, কোনটা রে? আমি কইলাম, ওই যে স্টুডেন্টগো উপর পুলিশ অ্যাকশন লইছিলা। ভ্যাকাদা কিন্তু কইল, তুই ঠিকই কইছস। কাজটা ঠিক হয় নাই।’ আমার ফের এক গাল মাছি, ‘ভ্যাকাদা লোকটা কে?’ বেণুদা বুঝিয়ে বললেন, পশ্চিমবঙ্গে তত্‌কালীন চিফ সেক্রেটারি। আর তিনি হলেন জনৈকা মিছরিমাসির ভাশুরপো।
এক জন নতুন নায়িকা তখন সবে বাংলা চলচ্চিত্রে ঢেউ তুলেছেন এবং আমরা, বয়ঃসন্ধি পেরনো সদ্য যুবারা তখন তাঁকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছি। ধরা যাক তাঁর নাম ধরিত্রী। বেণুদা এক রবিবার দুপুরে আমার পিসিমার বাসায় গিয়ে হাজির। সেখানে আমিও আছি। বেণুদা অম্লানবদনে বলে যাচ্ছিলেন, ‘এই তো পরশু ধরিত্রীর লগে টালিগঞ্জে ভানুর বাড়িতে দ্যাখা। পায়ে হাত দিয়া প্রণাম কইরা কইল, বেণুদা, আমি কিন্তু সেই ধরিত্রীই আছি। আপনে তো আমারে সেই ছোটবেলা থিক্যাই দেইখা আইতাছেন।’ আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘ভানু কে?’ ‘ক্যান? ভানু ব্যানার্জি! আরে হ্যায় হইল গিয়া আমার...’
ছবি: সুমন চৌধুরী।
ঘনাদা যা বলতেন, জেনেশুনেই বলতেন। পিছনে একটা মজা করার মোটিভ থাকত। বেণুদার তো তা নয়। ‘গুলবাজ’ বলে তাঁকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করায় আমার সায় নেই। আমার মনে হত, তিনি ওই ভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে নিজের একটা বিশিষ্ট আইডেনটিটি খুঁজছেন। ‘আমি তুচ্ছ বা সামান্য নই’, এ তো সব মানুষই জানান দিতে চায় এবং তার নানা প্রকরণও সে অবলম্বন করে, সুতরাং বেণুদাকে নিয়ে আমি হাসাহাসি করতাম না অন্যদের মতো, বরং আমার একটু কষ্টই হত।
বেণুুদা রিটায়ার করেছিলেন বোধহয় সত্তর সালের কাছাকাছি। সেই সময় একটা ভদ্রগোছের চাকরি করার পর প্রভিডেন্ট ফান্ড আর গ্র্যাচুইটি মিলে ষাট-সত্তর হাজার টাকা পাওয়া যেত। সত্তর সালে ষাট-সত্তর হাজার টাকা ছিল অতীব লোভনীয় এক অঙ্ক। ফলে বেণুদার সঙ্গে জুটে গেল এক জন ধুরন্ধর দালাল।
এ কথা বিশ্বজনীন ভাবে স্বীকৃত না হলেও আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দুনিয়ার সব ব্যাচেলরেরই বাস্তববোধ ও বুদ্ধির অভাব ঘটে। বিশেষ করে আগুয়ান বয়সে। আজ অবধি আমি এক জনও স্বাভাবিক বাস্তববুদ্ধির ব্যাচেলর দেখিনি। দুলাল নামক সেই দালালটি বেণুদাকে মানিকতলার কাছে একটা চারতলা বিশাল বাড়ি দেখিয়ে বলেছিল যে ওই বাড়িটা তার। তবে শাশুড়ি মারা গেলেই বাড়িটা পুরোপুরি তার হবে। শাশুড়ি ক্যানসারে ভুগছেন। আর দু-চার মাস মাত্র। তার পরই বাড়ির মালিক হয়ে সে দোতলাটা বেণুদাকে পুরোপুরি ছেড়ে দেবে। বেণুদা সে কথা গভীর ভাবে বিশ্বাস করেছিলেন।
বেণুুদা রিটায়ার করার কয়েক মাস আগে থেকেই দুলাল তাঁকে ফরেন গুড্স-এর ব্যবসায় নামাল। জাপানি ঘড়ি, কলম, রাশিয়ান মুভি ক্যামেরা, রেডিয়োগ্রাম ইত্যাদি। জিনিসগুলি যে দু’নম্বরি এবং সম্ভবত চোরাই মাল, আর দুলাল যে এক জন জোচ্চোর, তা আমরা সবাই বুঝতে পারছিলাম জলের মতো। শুধু বেণুুদা নয়। দুলাল তাঁকে বুঝিয়েছিল, যারা আমাকে জোচ্চোর, ঠগবাজ বলছে, ক’দিন পর আপনি নিজের গাড়িতে চেপে তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখিয়ে দিয়ে আসবেন আমি জোচ্চোর না সাচ্চা লোক।
রাতারাতি বড়লোক হওয়ার একটা দুর্দম ইচ্ছে বেণুদার সেই প্রবীণ বয়সে কেন হয়েছিল কে জানে! কিন্তু ইচ্ছে এমনই বলবতী, কাণ্ডজ্ঞান আদপেই কাজ করছিল না। আমাকে কতগুলো সিকো ঘড়ি এনে দেখিয়েছিলেন। সেগুলো যে আসল সিকো নয়, তা বাচ্চা ছেলেরও বুঝবার কথা।
রিটায়ার করার পর ছ’মাসের মধ্যে দুলাল এবং বেণুদার প্রভিডেন্ট ফান্ডের প্রায় সমুদয় টাকা উধাও হয়ে গেল। এমনই দুরবস্থা, বেণুদার বাসভাড়া দেওয়ারও পয়সা ছিল না। এক রবিবার তিনি শ্যামবাজার থেকে হেঁটে আমার যাদবপুরের বাসায় এসেছিলেন দেখা করতে। ক্ষুত্‌-পিপাসায় কাতর, আমার বউ তাঁকে যত্ন করে ভাত বেড়ে খাওয়াল। সিক্ত চোখে তিনি বললেন, আজকাল তাঁর মুড়ি খাওয়ারও পয়সা থাকে না। তখন আমারও আর্থিক অবস্থা শোচনীয়। ঠিক মনে নেই, হয়তো দশ-বিশ টাকা তাঁকে সঙ্কোচের সঙ্গে দিয়েছিলাম। আমাকে বললেন, ‘দুই-চাইরটা জিনিস অখনও আছে। তুই আমার মুভি ক্যামেরাটা নে।’ আমি বললাম, ‘আমি ছাপোষা মানুষ। মুভি আমার কোন কাজে লাগবে?’
রিটায়ার করার বোধহয় এক বছরের মধ্যেই প্রায় বিনা চিকিত্‌সায় এক আয়ুর্বেদীয় হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। এক জন বাস্তববুদ্ধিবর্জিত লোক ছিলেন বেণুদা। গুল মারতেন বটে, কিন্তু কারও কোনও ক্ষতি করেননি। কেউ বিশ্বাস না করলেও তাঁর কিছু যেত-আসত না। কিন্তু দুলাল তো তা নয়। দুলালের মতো মোটিভেটেড গুলবাজরা অনেক বেশি বিপজ্জনক। দুঃখের বিষয়, বেণুদা সর্বস্বান্ত হলেন এক জন গুলবাজের কাছেই।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.