সুচিত্রা সেন ছাড়া প্রফুল্ল কাউকে মানায়-ই না। বলেই ফেললেন গীতাপিসি, টিভি’তে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দেবী চৌধুরাণী’ দেখতে-দেখতে তিনি উচ্ছ্বসিত। সময়টা আশির দশকের গোড়ার দিক, সপ্তাহান্তে দূরদর্শনে বাংলা ছবি বরাদ্দ। তখন আমাদের আবাসনে অনেকের বাড়িতেই টিভি আসেনি। যাঁদের বাড়িতে এসেছে, তাঁরা সহৃদয় হলে বাংলা ছবি দেখানোর দিন আড্ডা জমত তাঁদের বাড়িতে। কথায়-কথায় জানা গেল, ’৭৪-এ যখন ‘দেবী চৌধুরাণী’ রিলিজ করেছিল, তখন একাধিক বার দেখেছেন গীতাপিসি। কারণ? ‘সুচিত্রা সেন ছাড়া অমন ব্যক্তিত্বের দাপট আর কারও আছে নাকি!’
গীতাপিসি নিজেও ছিলেন দাপুটে মহিলা, বরিশালের বাঙাল, পেশায় ডাক্তার। একই রকম সুচিত্রা সেন-আসক্ত ছিলেন তাপসীমাসি, আমার বাল্যবন্ধুর মা, তিনিও ওপার বাংলার মানুষ, পেশায় শিক্ষিকা। ’৭৬-এ যখন শরৎচন্দ্রের ‘দত্তা’ রিলিজ করল, সুচিত্রা সেনকে ঘিরে তাঁর আবেগের কথা মনে আছে এখনও, গীতাপিসির মতো তিনিও ছিলেন সুচিত্রার ব্যক্তিত্বের অসম্ভব ভক্ত। দু’জনার কেউই বেঁচে নেই, থাকলে সুচিত্রার মৃত্যুতে শোকগ্রস্ত হতেন নিশ্চিত।
এ সমস্তই আমার বয়ঃসন্ধির স্মৃতি, আর বয়ঃসন্ধি পেরনোর আগেই অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন সুচিত্রা সেন। তিনি জানতেন কি না জানি না, তাঁর ভক্তকুলের মধ্যে একটা বড় অংশ ছিলেন সেই বাঙালি মেয়েরা, যাঁরা ও-বাংলা থেকে কলকাতায় এসে লেখাপড়া শিখে চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছিলেন, পাশাপাশি ঘোরতর সংসারীও ছিলেন। তাঁরা, স্বাধীন দেশের ঘরে-বাইরে সমান পরিশ্রমী, উদ্যমী, শিক্ষিত, কলকাতা শহরের মেয়েরা সুচিত্রা সেন অভিনীত চরিত্রগুলির মধ্যে যেন নিজেদের খুঁজে পেতেন। |
বাঙালির তখন ঘোর দুর্দিন। সদ্য পেরোতে হয়েছে দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশভাগ। সরাসরি না হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঝাপট। স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে বাঙালির আর যা-ই হোক, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য-সমৃদ্ধি কিছুই মেলেনি। উপরন্তু পঞ্চাশের দশকে উদ্বাস্তু মানুষের ঢল। ওপারের ছিন্নমূল বাঙালি যেমন শুরু করছে আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই, তেমনই দুঃসময়ের শরিক এপারের বাঙালিও, তাদের জীবনেও বেঁচে থাকার লড়াই, সম্মান আদায় করার চেষ্টা।
হারানো প্রেম, হারানো পিতৃমাতৃপরিচয়, হারানো পারিবারিক বন্ধন, হারানো আত্মীয়তা, হারানো অর্থ-সম্পত্তি, হারানো কাজকর্ম, হারানো আভিজাত্য, হারানো মূল্যবোধ অনেক কিছুই যেন পুনরুদ্ধার করে এনে দিত সুচিত্রা-উত্তমের ছবি। তাদের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করত ওপারের বাঙালি এক দিকে পুনর্বাসনের সাধনায়, অন্য দিকে ফেলে আসা বসতির সঙ্গে পুনর্মিলনের স্বপ্নে। আর এপারের বাঙালি একাত্মতা বোধ করত তাদের পুরনো ‘স্বর্ণযুগ’ ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায়। সবটাই অলীক, ইচ্ছেপূরণের খেলা। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে বাংলা ফিল্মের এই বানানো বিশ্বাসের জগতে অংশীদার না হয়ে উপায় ছিল না সমকালীন বাঙালির।
বাঙালি মেয়েরা তাঁদের অবদমিত বা অপূর্ণ বাসনার পরিপূর্ণতা দেখতে চাইতেন সুচিত্রা সেন অভিনীত নানা চরিত্রে, এক কথায় সুচিত্রা ছিলেন তাঁদের ইচ্ছাপূরণের প্রবেশদ্বার। প্রায় প্রতিটি বাঁধা ছকের ফিল্মে অবিরত এক গড় চরিত্রে অভিনয় করে যেতেন সুচিত্রা। সে-চরিত্রটি আপাতদৃষ্টিতে যতই অভিজাত বা বিত্তবান পরিবারের প্রতিনিধি হোক না কেন, এ শহরের আর পাঁচজন বাঙালি মেয়ের মতোই সে লড়াই করত। শেষ পর্যন্ত সফলও হত, এবং সেই সাফল্য আসত এক সংগ্রামের মধ্য দিয়েই। সেই সংগ্রাম যত অবাস্তব ভাবেই দেখানো হোক ছবিতে, মুগ্ধ মেয়েদের চেতনায় তা অমোঘ প্রাপ্তির স্বাদ এনে দিয়েছে বছরের পর বছর, অন্তত তিনটি দশক ধরে।
কোনও ছবিতেই সুচিত্রা কেবলমাত্র উত্তমের ‘ন্যাকা’ প্রেমিকা কিংবা ‘বক্ষলগ্না’ হয়ে থাকেননি, বরং তাঁর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সফলতার লড়াইয়ে পা বাড়িয়েছেন। বা আরও একটু স্পষ্ট করে বলা যায়, অন্তঃপুরবাসিনীর ঘেরাটোপ থেকে বাইরে বেরিয়ে ‘প্যাশনেট’ প্রেমের ভিতর দিয়ে, অমসৃণ জীবনের নানা ওঠাপড়ার ভিতর দিয়ে উত্তমকে টেনে নিয়ে গিয়েছেন এক উন্নত জীবন, বা কোনও নৈতিক মূল্যবোধ, সর্বোপরি সুস্থিত প্রতিষ্ঠার দিকে এবং একই সঙ্গে নিজেদের প্রেমের পরিণতির দিকেও। এখানেই তাঁর চরিত্রগুলির ব্যক্তিত্বের দাপট, যা আকৃষ্ট করত বাঙালি মেয়েদের। তবে শুধু তাঁরা নন, পুরুষরাও আকৃষ্ট হতেন সুচিত্রা সেন-এ, এবং সেটা কেবল রূপের জন্য নয়, কেননা এমন ব্যক্তিত্বময়ী চরিত্রকে পাশে পাওয়াই তো সৌভাগ্যের। এ-মেয়ে পুরুষকে প্রেরণা জোগায়, তার পাশে দাঁড়ায়, প্রয়োজনে পুরুষের অসমাপ্ত কাজ নিজে সম্পন্ন করে।
সুচিত্রা সেনের চরিত্রেরা তাই তৎকালীন বাঙালি মেয়ে-পুরুষ উভয়ের কাছেই ছিল কাঙ্ক্ষিত। মেয়েরা তাঁদের পছন্দের পুরুষটিকে উপযুক্ত স্বামী হিসেবে সাজিয়ে তুলতে সুচিত্রার মতোই অধ্যবসায় রপ্ত করতেন। উল্টো দিকে, পুরুষেরা চাইতেন সুচিত্রার মতোই কোনও ঘরনি, যার গুণে সংসার সুখের হবে, যে আবার বাইরের ঘাতপ্রতিঘাত থেকেও সংসার আগলাবে। বাঙালি নারী-পুরুষের এই আকাঙ্ক্ষার সূত্রটি যেমন সহজেই একটা সামাজিক বর্গভেদ তৈরি করে ফেলল, ঠিক তেমনই নারী ও পুরুষের এই অপরিবর্তনীয় ইমেজ’গুলোর অবিরত ব্যবহার প্রায় চিরাচরিত হয়ে উঠল সুচিত্রা-উত্তমের ছবিগুলিতে। ‘ইমেজ’গুলোর এই ভিন্নতাকে পাকাপাকি করতে যে গাঁটছড়াটার দরকার পড়ে, তা হল বিবাহ পুরুষসমাজ বা পিতৃতন্ত্রের অতি-পছন্দের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। প্রায় সমস্ত ছবিতেই সুচিত্রা তাঁদের সম্পর্ককে পরিণতি দিতে যে অভীষ্টের দিকে টেনে নিয়ে যেতেন উত্তমকে, তা ওই বিবাহ। প্রণয়ে শুরু হয়ে পরিণয়ে শেষ হত সুচিত্রা-উত্তমের ছবি, মিলনান্তক বলে বিয়েটা অনেক ছবিতেই উহ্য থাকত, বিয়েটা যে হবেই বুঝে নিতেন বাঙালি দর্শক। অনেক ছবিতে বিয়েটা আগেভাগে হয়ে যেত, গোটা ছবি জুড়ে অপেক্ষা করতে হত কখন সে-বিবাহ প্রকাশ্যে আসবে, সামাজিক সমর্থন পাবে। কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে সুচিত্রা-উত্তমের তিরিশটি ছবি প্রেম থেকে বিবাহ পর্যন্ত মূলত এক পরিবারপ্রথার পরিক্রমা।
এই প্রাতিষ্ঠানিকতার শিকড় এতটাই গভীরে ছিল যে বাঙালি পুরুষ আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠতেন নারী-নির্ভরতায়। কারণ তাঁরা জানতেন, ‘অন্দর’-এর স্থিতাবস্থা বজায় রেখেই ‘বাহির’-কে জিতে নিতে বেরোন মেয়েরা; এবং আত্মপরিশ্রম আর আত্মত্যাগের মাধ্যমে প্রেমিক বা স্বামীর পৌরুষ আর উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে, বুদ্ধি আর প্রতিভাকে তুঙ্গে তুলে নিয়ে তবে তাঁদের স্বস্তি; তার পর তাঁরা নিজেদের সঁপে দেন প্রিয় পুরুষটির কাছে।
তিন দশক ধরে এ ভাবেই মাতৃলালিত পত্নীপালিত বাঙালি পুরুষের মানসপ্রতিমা হয়ে উঠেছিলেন সুচিত্রা সেন। রুপোলি পর্দায় তাঁর এই ব্যক্তিত্ব ভারী পছন্দ হয়েছিল বাঙালি পিতৃতন্ত্রের। আবার তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলির মধ্যেই ব্যক্তিত্বের স্ফুরণ দেখতে পেয়েছিলেন স্বাধীনতার পর নিজের পায়ে দাঁড়ানো এ শহরের মেয়েরা। |