বামপন্থার একটা সর্বজনীন আবেদন আছে, সব যুগে, সবার কাছে। বামপন্থার শক্তি তার বহমানতায়। বামপন্থী মানেই ভাবে, চিন্তা করে, সবার ভাল চায়, এই রকম একটা ধ্যানধারণা সাধারণ ভাবে আমাদের মানসপটে আছে। এই ভাবনা নিয়ে যখন আমরা বেশ কিছুটা আশাহত, তারই মাঝে অধ্যাপক অমর্ত্য সেন যেন ঝাঁকুনি দিয়ে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন: বামপন্থীরা ইদানীং বড় ‘ক্ষীণকণ্ঠ’ হয়ে পড়েছেন। সস্নেহ উষ্মা আর দুঃখে ভরা এই আবেগ প্রকাশের প্রতিক্রিয়ায় আড়ালে-আবডালে কিছু ফিসফাস উঠলেও কোনও বড় ঢেউ নেই। বামপন্থার সঙ্গে ‘নীরবতা’র সম্পর্ক কখনও এত নিবিড় ছিল না, যেমন এখন। সবাই যেন কেমন শীতঘুমে। কিছু বামপন্থী সৈনিকরূপী মনসবদারের শ্লাঘাতাড়িত মৃদু প্রতিবাদ অবশ্য কানে এসেছে। তাও অভিমানে ভরা, প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় নয়। মার্ক্সবাদের পইতে গলায় জীবিকা নির্বাহ করেন আর সদা আওড়ান ‘মার্ক্সবাদ শাশ্বত, কারণ ইহা বিজ্ঞান’, এ রকম কেউ কেউ এ-পাশ ও-পাশ তাকিয়ে বলেছেন, ‘দার্শনিকের চোখ ব্যাঁকা। কেন, আমরা তো যথেষ্টই জাগ্রত এবং বলশালী।’
অন্য দিকে, ‘জেনেটিকালি’ বাম প্রজাতির সদ্য কৈশোর-পেরোনো যুবক বামপন্থার আঁধার দেখে হতাশায় ছিলেন, তিনি আবার বুক বাঁধছেন। ওই সস্নেহ বকুনির মাঝেই বোধহয় আছে ভারতীয় বামপন্থার নবজাগরণের তূর্যবাদন। মুক্তমনা জিজ্ঞাসুরা কিন্তু যথেষ্ট কনফিউজ্ড। |
বামপন্থা নিয়ে বোধহয় সমস্যা ততটা নয়, যতটা সমস্যা বামপন্থীদের রূপ রস আর রঙ্গ নিয়ে। মেকি বাম, আসল বাম, সংসদীয় বাম, বিপ্লবী বাম, উগ্র চরমপন্থী বাম, স্নিগ্ধ মধ্যপন্থী বাম অবাক জলপানের মতো নানান প্রকারভেদের এবং তাদের বাচনিক ও শারীরিক দ্বন্দ্বের সাক্ষী এই বাংলা। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ, আদর্শের সংঘাত ইত্যাদি নানান মোড়কে ঢাকা হলেও এই বিভাজনের মূল ভিত্তিগুলির অন্যতম ছিল ব্যক্তিত্বের সংঘাত। দেশ আধা সামন্ততান্ত্রিক না আধা ঔপনিবেশিক, এই লড়াইয়ে যাঁরা বহু ঘাম ঝরালেন, তাঁরা কালক্রমে হয়ে উঠতে চাইলেন ‘প্রতিষ্ঠান’। আমার চেতনার রঙে রঞ্জিত চোখ দিয়ে বাকি সবাই বিশ্বলোকের দর্শন পাবে এই ভাবনা তো এক ধরনের সামন্ত-প্রভুত্ব। অনেকেই হলেন তার প্রতিভূ। ঝোলা কাঁধে গাঁয়ে ঘোরা তেভাগার সৈনিক, যুগান্তর, অনুশীলন সমিতি বা আন্দামান-খাটা, রোমাঞ্চসিক্ত বাঙালি মধ্যবিত্তই ছিল ‘বঙ্গে বামপন্থা’ নামের ইতিহাসের সৃষ্টিকারী। কিন্তু এক বছর বিপ্লব করা, পাঁচ বছর মানুষের পাশে থাকা, দশ বছর রাজপথে ঘাম ঝরানো আর জীবনভর মানুষের প্রতি, চিন্তার প্রতি, আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধ থাকা যে এক নয়, তা এ দেশের বামপন্থী নেতা-কর্মীদের মতো কেউ প্রমাণ করেননি।
বামপন্থার প্রবাহ ক্ষীণতর হয়েছে এমনটা যদি না-ও মানি, সবাই এটা মানবেন যে, সাবেকি বামপন্থী কর্মীরা আজ অদৃশ্য। পরার্থপরতার তৃপ্তিতে ভরা যে যুবকের দল বামপন্থী বলে সেলাম কুড়োতেন, তাঁরা যেন কোথায় বিশ্রামে চলে গেলেন। ক্রমশ সে জায়গা ভরাট করল ‘আমি কী পাব’ গানগাওয়া স্বপ্ন-সওদাগরদের দল। কথা ছিল সংসদীয় গণতন্ত্রে ক্ষণিকের অবস্থানের। তাই হয়ে গেল পাকা ঘরবাড়ি, আর তাতে ক্রমাগত সাফল্য দিল আরও টিকে থাকার প্রেরণা। এই টিকে থাকার পথে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা উঠে এল। এক, গণপার্টি গড়ে তোলার ডাক এল আশির শুরুতে। দুই, সততা-দায়বদ্ধতায় খামতির প্রশ্ন তুলতেই উত্তর আসতে লাগল গণতন্ত্রে এ সব একটু-আধটু থাকবেই। বিশ্বায়ন খায় না মাথা দেয়, না বুঝলেও এটা বলা শুরু হল যে, বিশ্বায়িত পৃথিবীতে শুধু গরিবের কুঁড়েঘর বানালে চলবে না, কৃষিজমিতে শিল্প করাই উন্নয়ন। গণপার্টিতে ক্রমশ জায়গা কমল গাঁয়ের চাষাভুষো-মাল বাউরির। কর্মদক্ষ, সুশিক্ষিত, ম্যানেজারিয়াল ক্ষমতায় পারদর্শীদের অট্টহাস্যের মধ্যে ‘বাঘারু বর্মন’ ফিরে যেতে শুরু করলেন কুঁড়েঘরে। লিউ শাও চি টেবিলে রেখে তিনখানা মোবাইল সমৃদ্ধ বামপন্থী জননেতারা সংসদীয় গণতন্ত্রের কাদা সর্বাঙ্গে মেখেও বলে চললেন, ‘আমরা মেহনতি মানুষের কল্যাণকামী’। ব্যষ্টিকে সমষ্টিতে বিলীন করার কথা ছিল যাঁদের, ক্রমশ তাঁরা হলেন যূথপতি। সমষ্টির বিকাশ নয়, সমষ্টির অস্তিত্ব ও চিন্তাকে পকেটে রেখে সময় মতো ব্যবহার করার পুঁজিবাদী দক্ষতা অর্জনে এঁরা মনোযোগী হলেন। অন্য দিকে, অ-সংসদীয় পথে যাঁরা দিনবদলের লড়াইয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরা আশিতেই ভূত। ‘অনেক জনগণ হয়েছে, এ হতচ্ছাড়া দেশে এর বেশি কিছু হবে না’, এই সংক্রামক চিন্তা এঁদের গ্রাস করল। রইল পড়ে একদল সফল প্র্যাগমাটিক বামপন্থী। তাঁরা নাকি ইতিহাস হবেন। ইতিহাস বড় নিষ্ঠুর।
শ্যাম ও কুল হারানো বামপন্থীদের দেখে আবেগতাড়িত দার্শনিক নিশ্চয়ই ব্রেজনেভের ভ্রুকুঞ্চনে আনন্দ পেতেন না। যেমনটা পাবেন না এল সি, ডি সি, পি সি, সি সি সমৃদ্ধ পার্টি-আমলাতন্ত্র’র সঙ্গে পরিচিত হলে। চিন্তার চর্চার আর প্রশ্ন করার অধিকার ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা’ নামে এক অদ্ভুত প্রয়োজনমাফিক ব্যবহৃত নামাবলি দিয়ে চাপা দেওয়া হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। সুদর্শন, সুবেশ, ইন্দ্রজাল বিস্তারে পটু ইত্যাকার গুণাবলি যেখানে বামপন্থার অগ্রণী সেনাদের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য, সেখানে কণ্ঠহীনতা তো আসবেই। এটা কি শুধুই কণ্ঠহীনতা? না কি দর্শনরিক্ত দিশাহীনতা? |