সে ঊনবিংশ শতকের সত্তরের দশক। বই নামের ছাপা বস্তুটির সঙ্গে শিক্ষিত ভদ্রলোক বাঙালির পরিচয় তখন বেশ ভালই জমিয়া উঠিয়াছে। তাঁহারা কেবল প্রয়োজনের বই পড়েন না, অপ্রয়োজনের বই উপভোগও করেন। অক্ষয়চন্দ্র সরকার লিখিয়াছিলেন, পিতা গঙ্গাচরণ আর তিনি কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের রস লোফালুফি করিয়া উপভোগ করিতেন। সন্ধেবেলা আদালত হইতে পিতা গঙ্গাচরণ ফিরিলেই বই-ভোগের আসর বসিত। পল্লির বিশিষ্ট জনেরা আসিতেন পুত্র অক্ষয়চন্দ্রও সেই রসের হাটের রসিক। দরজার পাশে দাঁড়াইয়া শুনিতেন। কিন্তু বাস্তবে হাট তো নিত্য বসে না। সপ্তাহান্তে বা পক্ষকাল পরে হাটের আয়োজন। প্রয়োজনীয় সামগ্রী ওই দিনটিতে সংগ্রহ করা চাই। গঙ্গাচরণের বাড়ির বইয়ের রসের হাট অবশ্য নিত্য বসত। নিত্য নূতন বই কিনিতেন তিনি। বাংলা বই প্রকাশিত হইলেই তাহা গঙ্গাচরণের সামগ্রী হইত। বই কেনার এই অভ্যাস যাহাতে সকলের হয়, তাহা লইয়া বই-ভাবুকদের নানা ভাবনা। গঙ্গাচরণের সখা লেখক ও সাময়িকপত্র সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র পরিকল্পনা করিয়াছিলেন গ্রাম্য বিদ্যালয়গুলিকে এ কার্যে ব্যবহার করিতে হইবে। গ্রাম্য বিদ্যালয়ের ক্লাস-ঘরের একটি কোণ হইলেই আপাতত চলিবে। সেখানেই নিত্য পাঠের জন্য গড়িয়া তুলিতে হইবে গ্রাম্য-গ্রন্থাগার। আর বই বেচার কাজে লাগাইতে হইবে নিত্য-সামগ্রীর ফিরিওয়ালাদের। তাঁহাদের ঝাঁকায় অন্য সামগ্রীর সহিত বইকেও বসিতে হইবে ছড়াইয়া পড়িতে হইবে গ্রাম-গ্রামান্তরে। তখন বই আর কেবল এক দিনের হাটের সামগ্রী থাকিবে না, তাহা হইবে নিত্যদিনের বস্তু। বাজারের দ্রব্যাদির যেমন নিত্য বেচা-কেনা সেই রূপ বইয়েরও। |
কিন্তু তাহা আর হইল কই! এই একুশ শতকেও তো বাংলা বই নিত্যদিনের নহে, তাহা বৎসরে এক বারের। বইমেলার। সারা বৎসর চুপচাপ, মেলার পূর্বে হুপহাপ। রামভক্ত হনুমানের মতো বইভক্ত লেখক, পাঠক, প্রকাশক দাপাইতেছেন। বই নাদে চারপাশ ভরিয়া উঠিতেছে। সেই জন্যই তো কলিকাতার আর জেলার বইমেলা ঘিরিয়া এমন বাৎসরিক হইচই। বই ফুটিতেছে প্রেসে প্রেসে। বই ছুটিতেছে মেলা প্রাঙ্গণে। এই বাৎসরিক বইহাট উঠিয়া গেলে আর বুঝি কেহ বই কিনিবে না! তাই ছুটিতে ছুটিতে বই প্রকাশ। ছাপা খারাপ, ফর্মা উধাও, মুদ্রণ প্রমাদে পরিপূর্ণ তবু কী গর্ব। ‘আমি মেলার বই।’ এই গর্বে গ্রন্থের পাতায় না-শুকোনো আঠার ছাপ, প্রকাশকের মুখে ‘ওস্তাদের মার শেষ রাতে’ হাসি, লেখকের চোখে আনন্দাশ্রু। কিন্তু এই আশার ছলনায় নিজেদের ভুলাইয়া কী লাভ! এই ঘোড়-দৌড় অর্থহীন। পাঠক যাহা পাতে পাইলেন তাহাতে তো নানা ত্রুটি রহিয়া গেল।
আসলে উচিত বইয়ের হাটকে নিত্যদিনের বই-বাজারে রূপান্তরিত করা। সম্বৎসরের কার্যক্রম লইতে হইবে। প্রকাশক ভাবিয়া-বুঝিয়া লাভ-ক্ষতি কষিয়া বিচার করিবেন বৎসরে ক’টা বই তিনি প্রকাশ করিতে সমর্থ। লেখককেও বুঝিতে হইবে একসঙ্গে বৎসরে একবার খান-চার গ্রন্থ-সন্তান উৎপাদন শরীর স্বাস্থ্য ও মনের পক্ষে ভাল নহে। রক্তাল্পতার ন্যায় যত্নাল্পতার ছাপ থাকিতে পারে মেধা-সন্তানদের গাত্রে। তাহার চাহিতে বৎসরের নানা সময় একটা একটা করিয়া বই প্রকাশ পাইলে সকলেরই লাভ। প্রকাশকের ভুল কমিবে, লেখকের রচনার মানও বজায় থাকিবে, পাঠকও ক্রমে ক্রমে কিনিয়া ধীরে ধীরে চাখিতে পারিবেন। প্রিয় লেখকের পাঁচটি বই বৎসরে একবার একসঙ্গে নানা প্রকাশনা হইতে বাহির হইলে বাছিয়া কিনিতে হয়, সবগুলি কেনাও চলে না। এই বস্তুগত লাভের পাশাপাশি বৃহত্তর লাভও রহিয়াছে। বই নিত্যদিনের, সারা বৎসরের বেচা-কেনার পণ্য হইলে বঙ্গ-সংস্কৃতির মরা-গাঙে জল আসিবে। লেখক-পাঠক-প্রকাশক বইমেলার পরিবর্তে সম্বৎসরের বই বাজারের দিকে মন দিলে মঙ্গল। |