হঠাৎ হঠাৎ লোভনীয় ই-মেল। কম দামে বিদেশি পণ্য কেনার সুযোগ বা ‘মোটা অঙ্কের লটারি জিতেছেন’ বলে অভিনন্দনবার্তা। জালিয়াতদের পাঠানো এমন টোপ প্রায়শই গিলছেন ইন্টারনেট ব্যাঙ্কিংয়ে অভ্যস্ত কিছু মানুষ। এর পর তাঁদের অজান্তেই হয়তো বদলে গেল ইন্টারনেট ব্যাঙ্কিং অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড কিংবা তাতে জুড়ে গেল তৃতীয় ব্যক্তির নাম। সেই বদলের খবর জানিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে ই-মেল বার্তাও হয়তো এল। কিন্তু গ্রাহক তা খুললেন না। হয়তো ভাবলেন ব্যাঙ্কেরই পাঠানো ‘পুজো বাম্পার’ গোছের কোনও বিজ্ঞাপনী মেল। ফলে জালিয়াতের পোয়াবারো। গ্রাহক পরে এসএমএস পেলেন ‘আপনার অ্যাকাউন্ট থেকে তোলা হল অত লক্ষ টাকা।’
মোটামুটি ভাবে গল্পটা এখন এই। নেট দুনিয়ায় রমরমিয়ে জাল বিছোচ্ছে আন্তর্জাতিক জালিয়াতি চক্র। কখনও কখনও যাদের শিকার তারকারাও! সাম্প্রতিক উদাহরণ প্রাক্তন টেস্ট ক্রিকেটার ভিভিএস লক্ষ্মণ। |
শুক্রবার লক্ষ্মণের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল ১০ লক্ষ টাকা। তা জমা পড়ে সল্টলেকের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে। সেই অ্যাকাউন্টের মালিক রেজবান-উল-হক ওরফে ইজাজুল শেখ নামে এক যুবককে গ্রেফতার করে বিধাননগর পুলিশ। তদন্তে নেমে পুলিশ মনে করছে, লক্ষ্মণের টাকা হাতানোর পিছনে রয়েছে আন্তর্জাতিক জালিয়াত চক্র। তবে অন্ধ্রের সাইবারাবাদ পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার (সাইবার অপরাধ) প্রতাপ রেড্ডি শনিবার বলেন, “তদন্ত সবে শুরু হয়েছে। মূল চাঁই কারা, সেটা এখনই বলা যাবে না।” এই ধরনের জালিয়াতি চক্র বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিদেশ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ভারতেও কয়েক জন জন চাঁই থাকে। তাদের আওতায় থাকে এজেন্টরা। গোয়েন্দারা জেনেছেন, কলকাতা-সহ দেশের বিভিন্ন শহরের যুবকরা এই চক্রের সঙ্গে জড়াচ্ছেন।
একটা ই-মেল কী ভাবে থেকে কী ভাবে কাজ হাসিল করে জালিয়াতরা?
ব্যাঙ্ক জালিয়াতি দমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জালিয়াতদের প্রধান অস্ত্র ভুয়ো ই-মেল। ব্যাঙ্ক বা বিভিন্ন সংস্থার নাম করে নানা ধরনের লোভনীয় প্রস্তাব পাঠানো হয় তাতে। ওই ই-মেলেই একটি ‘লিঙ্ক’ দেওয়া থাকে। তা খোলা মাত্রই গ্রাহকের কম্পিউটারে একটি প্রোগাম (ভাইরাস) ঢুকে পড়ে। তার সাহায্যে কম্পিউটারে থাকা গ্রাহকের ই-মেল আইডি, পাসওয়ার্ড-সহ নানা তথ্য হাতায় জালিয়াতেরা। পরে সেগুলি ব্যবহার করেই নেট ব্যাঙ্কিংয়ের মাধ্যমে টাকা গায়েব করে তারা। পুলিশ সূত্রের খবর, সাইবারাবাদ পুলিশকে জানানো অভিযোগে লক্ষ্মণও তাঁর ই-মেল অ্যাকাউন্ট হ্যাক হওয়ার কথা বলেছেন।
অনলাইনে হাতানো টাকা জালিয়াতদের হাতে পৌঁছয় কী ভাবে? কলকাতা পুলিশের এক গোয়েন্দা-কর্তা বলছেন, কোনও অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা হাতানোর পরে তা সরাসরি জালিয়াতদের হাতে যায় না। বিভিন্ন এজেন্টের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তা নেওয়া হয়। প্রথমে পুরো টাকাটা এক জন এজেন্টের অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে। সেই এজেন্ট অ্যাকাউন্ট থেকে নগদ টাকা তুলে নিজের কমিশন রেখে বাকিটা অন্য এজেন্টের অ্যাকাউন্টে জমা করে। সেই এজেন্টও একই কায়দায় নিজের কমিশন নিয়ে বাকিটা অন্য কোনও এজেন্টের অ্যাকাউন্টে জমা করে। এ ভাবে তিন-চারটি শহরের এজেন্টের অ্যাকাউন্ট ঘুরে টাকা পৌঁছয় জালিয়াতদের কাছে। তদন্তকারীদের বিভ্রান্ত করার জন্যই এমন কায়দা। লক্ষ্মণের টাকা জালিয়াতির ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া ইজাজুলও এমনই এক এজেন্ট বলে সন্দেহ করছেন তদন্তকারীরা। পুলিশ সূত্রের খবর, মালদহের কালিয়াচকের বাসিন্দা ইজাজুল ছোটখাটো ব্যবসা করেন। জেরায় তিনি দাবি করেছেন, ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে তাঁর অন্য একটি অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়ার কথা ছিল। এর বিনিময়ে কমিশন পাওয়ার কথা ছিল তাঁর। দিল্লির এক ব্যবসায়ীর কথায় তিনি এই কাজ করেছেন বলে দাবি ইজাজুলের। সেই ব্যবসায়ীর খোঁজ শুরু হয়েছে। ইজাজুল এর আগেও এমন কাজ করেছেন কি না, তা জানার চেষ্টা চলছে। শনিবার শহরে আসেন সাইবারাবাদ পুলিশের অফিসারেরাও। ইজাজুলকে বিধাননগর এসিজেএম আদালতে এ দিন হাজির করানো হয়। সাইবারাবাদ পুলিশ তাঁকে ট্রানজিট রিমান্ডে নিয়েছে।
নেট দুনিয়ায় জালিয়াতি চক্রের জড়িত থাকার প্রমাণ এর আগেও বারবার মিলেছে। গত কয়েক বছরে এমনই জালিয়াতির অভিযোগে দেশের নানা প্রান্ত থেকে কয়েক জন নাইজেরীয়কে গ্রেফতার করেছিল লালবাজারের ব্যাঙ্ক জালিয়াতি দমন শাখা। হায়দরাবাদেও নাইজেরীয় জালিয়াতদের নিয়ে ওয়েবসাইটে সতর্কবার্তা ঝুলিয়েছে পুলিশ। তা সত্ত্বেও লোকে ফাঁদে পড়ছে কী করে? গোয়েন্দাদের বক্তব্য, জালিয়াতদের অভিনব ফন্দি যেমন রয়েছে, তেমনই গ্রাহকদের গাফিলতিও কম নয়।
কী রকম? প্রথমত প্রলোভনের ফাঁদে পা দেওয়া, দ্বিতীয়ত ব্যাঙ্কের সতর্কবার্তাকে আমল না দেওয়ার কথা বলছেন গোয়েন্দারা। জালিয়াতি রুখতে ব্যাঙ্কগুলি সম্প্রতি নানা ধরনের সতর্কতা নিয়েছে। টাকা লেনদেনের আগে মোবাইলে কিংবা ই-মেলে একটি ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড (এটি কয়েক মিনিটের জন্য কার্যকর থাকে) পাঠানো হয়। সেটি পাল্টা ব্যাঙ্ককে জানালে, তবেই লেনদেন সম্পূর্ণ করা যায়। একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের কর্তা জানান, নেট ব্যাঙ্কিং অ্যাকাউন্টে কোনও ধরনের রদবদল করা হলে, তা-ও গ্রাহককে ই-মেল মারফত জানানো হয়। গ্রাহক চাইলে মোবাইলেও সতর্কবার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু বিভিন্ন ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে গোয়েন্দারা দেখেছেন, গ্রাহকেরা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাঙ্কের মেলগুলিকে গুরুত্ব দেন না কিংবা সতর্কতামূলক মেলগুলিকেও বিজ্ঞাপনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। অনেক সময় নজর এড়িয়ে যায় এসএমএস-ও। পুলিশ সূত্রে খবর, লক্ষ্মণ এসএমএস-টা দেখেছিলেন। তার পরে থানায় যেতে দেরি করেননি।
|