|
|
|
|
শনিবারের নিবন্ধ ২... |
লোকটা ভাল তো |
আগেভাগে জেনেবুঝে নিন। কী করে? বিশেষজ্ঞের পরামর্শ শুনলেন পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়। |
বিপদ বা বিপজ্জনক লোক আঁচ করাতে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের জুড়ি নেই, বিশেষত মেয়েদের। চলতে-ফিরতে সেই ইন্দ্রিয়কে সজাগ রাখার দায়িত্ব তাঁদের। বলেন মনোবিদরা।
মুখ দেখে হয়তো মানুষ চেনা সহজ নয় কিন্তু চোখ-কান খোলা রাখলে ‘নেগেটিভ ভাইব’ পাওয়া যেতেই পারে। সমস্যা আন্দাজ করে দ্রুত সিদ্ধান্তের গতি পরিবর্তন যে যত রপ্ত করতে পারবেন, তিনি তত সুরক্ষিত।
দিল্লির নির্ভয়ার ধর্ষণের সময় তাঁর সঙ্গে যে বন্ধু ছিলেন তিনি আজও প্রায় সব সাক্ষাৎকারে আফশোস করেন। হয়তো সে দিন রাতে ফাঁকা বাসে আগুপিছু না ভেবে ঝুপ করে উঠে পড়াটা সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছিল। ঝুঁকি নিয়ে ফেলার ভুল। এই একই ধরনের আফশোস শোনা যায় কামদুনি বা মধ্যমগ্রামে লাঞ্ছিতার নিকটজনের কাছেও।
রাস্তাঘাটে, বাসে, স্টেশনে আমাদের রোজকার চলাফেরার অভিজ্ঞতা থেকে ভাবুন। পথ চলতে, ভিড় বাসে বা লোকাল ট্রেনে উঠেই কী ভাবে সতর্ক থাকতে হয়। আশপাশের বহু লোক, এমনকী অনেক কন্ডাক্টরের হাত সঞ্চালন, চোখের দৃষ্টি, পা এবং দেহের মুভমেন্ট আঁচ করে কী কী ভাবে নিজেকে বাঁচাতে হয়।
ভিড়ে ভরা স্টেশনে লোকাল ট্রেন থামার পর গলগল করে উগড়ে দেওয়া মানুষের স্রোতে অনর্গল মেয়েদের শরীর ছুঁতে চায় অজস্র হাত। ডজ করে এগিয়ে যেতে হবে আপনাকে।
অটোরিকশাতে আরও ঠেসাঠেসি। সব সময় নজর রাখতে হবে পয়সা-মোবাইল বার করার নামে কিংবা নিছক জামার হাতা ঠিক করতে-করতে কেউ আপনার শরীরে আঙুল বুলোতে চাইছে কি না। শুধু নজর রাখাই নয়, তেমন বুঝলে ঝাঁঝিয়ে প্রতিবাদ করতে মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে।
সমীক্ষকেরা দেখেছেন, যে সব মহিলা বেখেয়ালে, মোবাইল ফোনে কথা বলতে-বলতে বা গান শুনতে-শুনতে চলাফেরা করেন, যাঁদের হাতজুড়ে প্রচুর জিনিসপত্র বা সঙ্গে বাচ্চা থাকে বা পরনের জামাকাপড় সামলাতে যাঁরা হিমশিম খান, তাঁরাই হামলাকারীদের টার্গেট হচ্ছেন বেশি। কারণ, তাঁদের তখন ‘ডিফেন্স মেকানিজম’ কাজ করছে না।
এ ছাড়াও টার্গেট হচ্ছেন অপেক্ষাকৃত জড়োসড়ো, লাজুক, ভিতু মেয়েরা। হামলাকারী জানে, এঁদের থেকে প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ আসবে না। এরা নরম মাটি।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের প্রধান পারমিতা চক্রবর্তী বলছিলেন, “কেন চলতে ফিরতে মেয়েদের সব সময় সতর্ক থাকতে হবে? সে দায়িত্ব তো সরকারের নেওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি যে এ সবে আমল দেয় না। জন্মের পর থেকে একটা মেয়ের বড় হওয়ার মধ্যেই তার কী করা উচিত নয়, সেটা তার সিস্টেমে ঢুকিয়ে দেয় সমাজ। সেটাই বাধ্য হয়ে মানতে হয়।”
মানতে হয় কারণ, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে দমিত খারাপ রিপু রয়েছে। কখন কোন পরিবেশে কী দেখে তা জেগে উঠবে, কেউ জানে না।
ক্রিমিন্যাল সাইকোলজিস্ট এবং বডিল্যাঙ্গোয়েজ স্পেশ্যালিস্টদের একাংশ মনে করেন, দুর্বলের উপর ক্ষমতা প্রদর্শনের ইচ্ছা যে কারও মধ্যে জাগতে পারে। তখন অতি সাধারণ, মুখচোরা লোকও ধর্ষণকারীর ভূমিকা নিতে পারে।
বডিল্যাঙ্গোয়েজ স্পেশ্যালিস্ট মনোবিদ
ড. রঞ্জিত বসুর কথায়, “সুখ বা দুঃখের শারীরিক ভাষা থাকে। কিন্তু কারও মনে ধর্ষণের প্রবৃত্তি জাগলে তা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। তাই মেয়েদের সতর্ক থাকাই শ্রেয়।”
কী সেই সতর্কতা?
পর পর কয়েকটা উদাহরণ দিলেন মনস্তাত্ত্বিক মোহিত রণদীপ।
যেমন, রাস্তাঘাটে, পার্টিতে অপরিচিত বা অল্প পরিচিতদের মাঝে নিজে নেশা না-করা এবং যাঁরা করেছেন তাঁদের এড়িয়ে চলা। কারণ মানুষ সবথেকে বেশি অপরাধ করে নেশাগ্রস্ত অবস্থায়।
এ ছাড়া মনস্তাত্ত্বিকদের মতে, অল্প দিনের পরিচিত কেউ রাতে একা কোথাও দেখা করতে চাইলে এড়িয়ে যাওয়া উচিত। বেশি রাতে একেবারে একা ট্যাক্সি বা শেয়ার গাড়িতে চড়ার চেষ্টা না-করা, চড়লেও সঙ্গে-সঙ্গে মোবাইল থেকে বাড়ির কাউকে ফোন করে গাড়ির নম্বর এবং নিজের অবস্থান বলে দেওয়া। চালকের সঙ্গে হেল্পার রয়েছে এমন ট্যাক্সিতে না-ওঠা, অপরিচিতের গাড়িতে লিফ্ট না-নেওয়া, একেবারে ফাঁকা বাস বা কালো কাচ লাগানো বাসে রাতের দিকে না-ওঠা, বিপদ বুঝলে সোজা চিৎকার করে দৌড়তে শুরু করা, ব্যাগে পেপার-চিলি স্প্রে, নিদেনপক্ষে ডিওডোরেন্ট, সেফটিপিন বা চুলের কাঁটা রাখা ভাল, যা আত্মরক্ষার হাতিয়ার হতে পারে।
মনস্তাত্ত্বিক প্রশান্ত রায় যেমন জানালেন, একটা সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ষাট শতাংশ পুরুষের সেক্সুয়াল ফ্যান্টাসিতে ‘ফোর্সফুল সেক্স’ রয়েছে। মানুষের শিক্ষাদীক্ষা, সামাজিক চাপ ও নীতিবোধের জন্য সেই ইচ্ছা চাপা থাকে। কিন্তু কোনও অনুঘটকের জেরে তা চাগাড় দিতেই পারে। ফলে সতর্ক থাকতেই হবে।
তবে তাঁর কথায়, “ধর্ষণকারীর বডি ল্যাঙ্গোয়েজ যাচাই করা হয়তো যায় না। তবে কয়েক ধরনের মানুষ সম্পর্কে একটু বেশি সজাগ থাকা যেতে পারে। যেমন যারা অত্যন্ত অধৈর্য, ডমিনেটিং, কথায় কথায় মেয়েদের হেয় করতে অভ্যস্থ। বা যারা সব সময় জীবনে উত্তেজনা খোঁজে, একটুতে একঘেয়েমিতে ভোগে, যারা বাড়াবাড়ি রকম বেপরোয়া, শাস্তি বা দুর্নামের ভয়ে ভীত নয় অথবা রেগে গেলে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। এদের ধর্ষণকারী বা নির্যাতনকারী হওয়ার বিপুল আশঙ্কা থাকে।”
ধর্ষণের আরেকটা রূপ হল কোনও মেয়েকে পাচার করে দেওয়া। কোনও নিষিদ্ধপল্লিতে বেচে দেওয়া। সেখানে যে বা যারা পাচারকারী তারা প্রথমে মেয়েটিকে দফায়-দফায় ধর্ষণ করে। তার পর নিষিদ্ধপল্লিতে প্রতিদিন তাঁকে ২০-৩০ জনকে শরীর বিক্রি করতে হয়।
এই মেয়েদের উদ্ধার করার কাজ দীর্ঘদিন ধরে করছেন সিআইডি (পশ্চিমবঙ্গ)-র পাচারবিরোধী সেলের অফিসার ইনচার্জ শর্বরী ভট্টাচার্য। তাঁর মত, পাচারের শিকার বেশির ভাগ হয় গ্রামের অশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত গরিব, অল্পবয়সি মেয়েরা। পৃথিবীটা কতটা খারাপ সে সম্পর্কে যাদের কোনও বাস্তব জ্ঞানই নেই, তাদের। ভাবে জীবনটা হল বাংলা সিনেমা বা সিরিয়াল। বেশ মিষ্টি-মিষ্টি একটা প্রেম, বিয়ে, গদগদ সংসার। ছোটবেলা থেকে বাস্তবের জমিতে নামাতে হবে ওদের।
শর্বরী বলেন, “হুট করে একটা উটকো ছেলে এলাকায় এল। এক সপ্তাহের মধ্যে প্রেমের প্রস্তাব দিল। দু’সপ্তাহের মধ্যে বিয়ের কথা বলল। মেয়েটিও দিব্যি গলে গিয়ে তার ঠিকুজি-কুলুজি না-জেনে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল! কোনও বোধই নেই! এদের বাড়িতে বা স্কুলে যৌনশিক্ষা দিতে হবে, যৌনহেনস্তা এবং হেনস্থাকারীর স্বরূপ বোঝাতে হবে।”
একই কথা বলছিলেন প্রায় এক যুগের বেশি যৌনপল্লি থেকে উদ্ধার হওয়া মেয়েদের নিয়ে কাজ করা সমাজকর্মী বৈতালী গঙ্গোপাধ্যায়। “কেন একজন অল্প পরিচয়ে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে, বিনা স্বার্থে খামোখা গায়ে পড়ে সাহায্য করছে সে বিষয়ে সতর্ক হতে হবে।”
বৈতালীদেবী বলে যান, “কেউ গরজ দেখিয়ে বিয়ে বা চাকরির প্রস্তাব দিলে আগে সন্দেহের চোখে দেখুন। খোঁজ নিন। কোনও ছেলেকে ভাল লাগলে তার বাড়ির খবর, আত্মীয়দের খবর, ফোন নম্বর নিতে হবে। নিজের পরিবার বা বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে অন্তত কয়েক জনকে বিষয়টা জানাতে হবে। অন্ধের মতো তাকে বিশ্বাস করলে ঠকার সম্ভাবনা তার থেকে অনেক বেশি।”
সেই কবে উনিশ শতকে আমেরিকার নারী অধিকার আন্দোলনকর্মী লিলিক ডেভেরক্স ব্লেক লিখে গিয়েছিলেন, “ইট ইজ বেটার টু হ্যাভ দ্য পাওয়ার অব সেল্ফ প্রোটেকশন দ্যান টু ডিপেন্ড অন এনি ম্যান।” অর্থাৎ, অন্য কারও ওপর নির্ভর করার আগে আত্মরক্ষার শক্তিটা অর্জন করা ভাল।
একবিংশ শতকের ভারতে কথাগুলো ভীষণ সত্যি। নারীর আত্মরক্ষার একটা বড় অংশই হল নিজের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের যাচাই ক্ষমতার ভিত্তিতে একটু বুদ্ধি একটু সাহস করে অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির মোকাবিলা।
জীবনের খেলায় চারদিকে ছড়িয়ে থাকা হায়নাদের পাশ কাটিয়েই জয়ের জালে গোল দিতে হবে মেয়েদের। তার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখতে হয়। সতর্ক থাকতেই হয়।
|
কী করবেন, কী করবেন না |
• যে পুরুষ অত্যন্ত অধৈর্য, ডমিনেটিং, কথায় কথায় মেয়েদের হেয় করতে অভ্যস্থ বা যারা সব সময় জীবনে উত্তেজনা খোঁজে, একটুতে একঘেয়েমিতে ভোগে, যারা বাড়াবাড়ি রকম বেপরোয়া, শাস্তি বা দুর্নামের ভয় ভীত নয় অথবা রেগে গেলে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। এদের সম্পর্কে সতর্ক থাকুন
• পথঘাটে জড়োসড়ো জবুথবু হয়ে চলাফেরা নয়, আত্মবিশ্বাসী হন
• অনেক রাতে ফাঁকা রাস্তা, ফাঁকা বাস, শেয়ার ট্যাক্সি তো বটেই, হেল্পার রয়েছে এমন ট্যাক্সি এড়িয়ে যান
• একা ট্যাক্সিতে উঠলে পরিচিত কাউকে ফোন করে ট্যাক্সির নম্বর ও গন্তব্য জানান
• অপরিচিত জায়গায় বা অপরিচিত কিংবা স্বল্প পরিচিত কারও সঙ্গে মদ্যপান করবেন না
• হঠাৎ কেউ যেচে আলাপ জমাতে এলে, সাহায্য করতে চাইলে সতর্ক হন
• আত্মবিশ্বাস বাড়াতে মার্শাল আর্ট শেখা যেতে পারে বা ব্যাগে ছোট ছুরি, পেপার-স্প্রে রাখা যায়
• ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়কে গুরুত্ব দিন। বিপদ মনে করলে বুদ্ধি করে পাশ কাটিয়ে দৌড়তে শুরু করুন
• প্রয়োজনে কলকাতা পুলিশের তিনটি হেল্পলাইনের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে ১০৯০, ১০৯১, ১০০ |
|
|
|
|
|
|