আরব বসন্তের সূতিকাগার টিউনিসিয়া হইতে সুসমাচার আসিতেছে। উত্তর আফ্রিকার এই মুসলিম রাষ্ট্র তাহার স্বৈরাচারী শাসক জিনে আল আবেদিন বেন-আলির নির্বাসনের পর হইতে গত তিন বছর ধরিয়া যে রাজনৈতিক ডামাডোল ও অস্থিরতার মধ্য দিয়া যাইতেছিল, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তাহার অবসানের ইঙ্গিত মিলিতেছে। ইসলামি এন্নাহ্দা পার্টি তাহার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা সত্ত্বেও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়া একটি সর্বসম্মত সংবিধান রচনায় সক্ষম হইয়াছে এবং সেই সংবিধান অনুযায়ী একটি অরাজনৈতিক তদারকি সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত করিয়া নূতন করিয়া নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হইতেছে। উত্তর আফ্রিকারই দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিশর ও লিবিয়ার পরিস্থিতির সহিত তুলনা করিলে টিউনিসিয়ার এই গণতান্ত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার তাৎপর্য সম্যক উপলব্ধি করা যায়। ওই দুই দেশই যেখানে আরব বসন্তের দক্ষিণা বাতাসে স্পৃষ্ট হইলেও পরস্পরবিরোধী জনগোষ্ঠী ও রাজনৈতিক দলের বিদ্বেষ, হানাহানি, রক্তক্ষয়ের চোরাবালিতে অধঃপতিত, টিউনিসিয়া সেখানে গণতন্ত্রের পাকা রাস্তা ধরিয়াই হাঁটিতে বদ্ধপরিকর।
মিশরে হোসনি মুবারকের পতনের পর ইতিহাসের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্য দিয়া মুসলিম ব্রাদারহুডের যে সরকার কায়েম হয়, প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুর্সির অবিবেচনা ও স্বৈর-প্রবণতায় ক্ষুব্ধ জনসাধারণের প্রতিবাদ আন্দোলন তাহার স্থলে সামরিক জেনারেলদের একনায়কত্ব কায়েমের পথ সুগম করে। মিশরে যে-সংবিধান সদ্য গণভোটে অনুমোদিত হইয়াছে, তাহার একমাত্র লক্ষ্য-- জেনারেল আল-সিসি-র নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিশ্চিত করা। আর গদ্দাফি-উত্তর লিবিয়ায় তো কোনও সংবিধানই রচিত হইতে পারে নাই। টিউনিসিয়াতেও ইসলামপন্থী এন্নাহ্দা পার্টির ক্ষমতাসীন হওয়া সে দেশে ধর্ননিরপেক্ষ শক্তিগুলি মানিয়া লইতে পারে নাই। দুই ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিকের হত্যাকাণ্ডও দেশে ব্যাপক বিক্ষোভ সৃষ্টি করে। কিন্তু মিশরের ব্রাদারহুডের মতো এন্নাহ্দা পার্টি জেদ ধরিয়া থাকে নাই, বরং সংবিধান রচনায় দেশের সব গোষ্ঠী ও দলকে জায়গা করিয়া দিয়াছে। খোলা মনে প্রজাকল্যাণের আদর্শকে অগ্রাধিকার দিয়া প্রতিটি অনুচ্ছেদ লইয়া তর্ক-বিতর্ক চালাইয়াছে, কোনও মতকে দমন করার চেষ্টা করে নাই। তাহার ফলেই এমন একটি সংবিধানের খসড়া রচিত হইয়াছে, যাহা সকল পক্ষকেই সন্তুষ্ট করিয়াছে।
যেমন টিউনিসিয়াকে ইসলামি রাষ্ট্র রূপে শনাক্ত করিলেও শরিয়তকে একমাত্র আইনের মর্যাদা দেওয়া হয় নাই। রাষ্ট্র হিসাবে টিউনিসিয়া যে ‘অসামরিক’, তাহাও বিজ্ঞাপিত। আরবি ভাষার বিকাশের উপর জোর দিয়াও অন্যান্য বিদেশি ভাষা এবং মানব সভ্যতা, মানবিক মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও মানবাধিকারের বিকাশের জন্যও সংবিধানে অনুচ্ছেদ রাখা হইয়াছে। সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হইল মহিলাদের অধিকার সুরক্ষিত করার বিধান। মহিলাদের জন্য পুরুষদের সমান সুযোগ সুনিশ্চিত করা হইয়াছে। ইহার পিছনে আছে মহিলা সংগঠনগুলির তীব্র আন্দোলনের ইতিহাস। বহুত্ববাদী গণতন্ত্রের অভিমুখে যাত্রার একটা তাগিদ এই সংবিধানের ছত্রে-ছত্রে বিধৃত। শেষ পর্যন্ত কী হইবে, তাহা অবশ্য ইতিহাসের গর্ভেই নিহিত। মৌলবাদী এবং ইসলামপন্থী শক্তিগুলি নিশ্চয় বহুত্ববাদকে বরণ করিতে উন্মুখ নহে। তবে মিশর ও লিবিয়ার দৃষ্টান্ত দেশবাসীর কাছে গণতন্ত্রে স্থিত থাকার প্রেরণা হইয়া উঠিতে পারে, এইটুকুই যা ভরসা। |