ঈশ্বর যাহার সর্বনাশ করিতে চাহেন, প্রথমে তাহার বুদ্ধি কাড়িয়া লন, এমন একটি কথা জানা ছিল। মনমোহন সিংহের সরকার যাহা কিছু করিতেছে, তাহার প্রত্যেকটিতে বুদ্ধি এবং বিবেচনাবোধের ভয়াবহ অভাব দেখিয়া মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, সর্বনাশের মাত্রা নির্ধারণে ঈশ্বর সাম্যবাদী নহেন, কাহারও কাহারও ক্ষেত্রে অতিরিক্ত নির্দয় তাহাদের সমস্ত বুদ্ধিই তিনি কাড়িয়া লন, কণামাত্র অবশিষ্ট রাখেন না। সাম্প্রতিকতম দৃষ্টান্তগুলির অন্যতম: ভর্তুকিধন্য এল পি জি সিলিন্ডারের সংখ্যা বার্ষিক নয় হইতে বারোয় বাড়াইবার সিদ্ধান্ত। সম্পূর্ণ ভুল ভাবে একটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত বলবৎ করিবার এমন কৃতিত্ব অর্জনের জন্য যে বিপুল বুদ্ধিহীনতার দরকার হয়, তাহার পরিমাপ কল্পনা করাও কঠিন। অমর্ত্য সেন এবং জগদীশ ভগবতী উভয়েই বিরোধিতা করিবেন, এমন সিদ্ধান্ত স্থির করা সহজ কাজ নয়! বাজারপন্থী ভগবতী সাফ বলিবেন, ভর্তুকি দেওয়ার নীতি মূলত অন্যায় ও উন্নয়নবিরোধী। অমর্ত্য সেন বলিবেন, এল পি জি’র ভর্তুকি ভ্রান্ত অগ্রাধিকারের নিদর্শন (প্রধানত) মধ্যবিত্তের ভোগ্য রান্নার গ্যাস সস্তায় মিলাইবার জন্য সরকারি কোষাগারের টাকা খরচ না করিয়া সেই অর্থ প্রকৃত দরিদ্র মানুষের পুষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক প্রয়োজন মিটাইবার কাজে ব্যবহার করা উচিত। লক্ষণীয়, রঘুরাম রাজন অবধি জানাইয়াছেন, এই ভর্তুকি ‘বিপথচালিত’, কারণ ইহা অপাত্রে বর্ষিত হইবে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর সরকারি নীতির প্রকাশ্য সমালোচনা করিতেছেন, এমন ঘটনা খুব সুলভ নয়। রঘুরাম রাজনকে অবিবেচক এবং অমিতবাক অপবাদও কেহ দিবে না। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁহার উপদেষ্টারা ভাবিয়া দেখিতে পারেন, এমন বিরল ঘটনা কেন ঘটিতেছে।
কিন্তু নীতিগত ভ্রান্তিতে সমস্যার শুরুমাত্র। বস্তুত, নির্বাচনী মরসুম আসন্ন হইলে এবং সেই নির্বাচনে শাসক দলের ভরাডুবির প্রবল আশঙ্কা থাকিলে ভর্তুকির প্লাবন বহিবে, ভারতীয় রাজনীতিতে ইহা নূতন কিছু নহে। অতীতেও ‘ঋণ মেলা’ আদি নির্বাচনী দানসত্র বিস্তর দেখা গিয়াছে, আশঙ্কা হয় ভবিষ্যতেও বিস্তর দেখা যাইবে। এমন কথা মনে করিবার যথেষ্ট কারণ আছে যে, দেশ জুড়িয়া নাগরিক মধ্যবিত্ত সমাজ নানা কারণে শাসক দলের উপর বিষম কুপিত হইয়াছে। দিল্লিতে আম আদমি পার্টির ধূমকেতুপ্রতিম আবির্ভাবে এবং দেশের অন্য নানা অঞ্চলে তাহার সম্পর্কে নাগরিক উৎসাহে তাহারই প্রতিফলন। এই পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যবিত্ত নাগরিকদের সস্তায় গ্যাস দিবার সিদ্ধান্ত, ঘাটতি-তাড়িত কোষাগারের পক্ষে ক্ষতিকর এবং বৃহত্তর অর্থনৈতিক স্বার্থের পক্ষে হানিকর হইলেও, ভোট-নীতি হিসাবে দুর্বোধ্য নয়। কিন্তু সেখানেই দ্বিতীয় প্রশ্ন। ভর্তুকি যাহা দিবার, তাহা প্রথমেই কেন স্থির করা হইবে না? চাপে পড়িয়া ভর্তুকি বাড়াইবার সিদ্ধান্ত কেন? এহ বাহ্য। ১৭ জানুয়ারি কংগ্রেসের সহ-সভাপতি সভাস্থলে হাজির প্রধানমন্ত্রীকে ভর্তুকিযুক্ত সিলিন্ডারের সংখ্যা বাড়াইবার ‘আবেদন’ জানাইলেন আর ৩০ জানুয়ারি পেট্রোলিয়ম মন্ত্রী ভর্তুকিপ্রাপ্ত সিলিন্ডারের সংখ্যা বাড়াইয়া দিলেন? কংগ্রেসের মুখপাত্ররা জোর গলায় বলিয়াছেন, এই সিদ্ধান্ত রাহুল গাঁধীর কথায় লওয়া হয় নাই, সমগ্র ‘দেশবাসী’র মনোভাব অনুসারেই এই সিদ্ধান্ত। জোর গলায় একটি কথা বলিলেই তাহা বিশ্বাসযোগ্য হয় না, এই বোধটুকুও কংগ্রেসের মস্তিষ্ক হইতে কাড়িয়া লইয়াছেন কি না, তিনিই জানেন। সামান্যতম কাণ্ডজ্ঞান অবশিষ্ট থাকিলেও সরকারি কর্তাদের বোঝা উচিত, স্বাধীন ভাবে ভর্তুকি বাড়াইবার সিদ্ধান্ত করা হইলেও রাহুল গাঁধীর এমন প্রকাশ্য ‘নির্দেশ’-এর পরে কোনও অবস্থাতেই সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়, কারণ লোকে ইহার একটি নামই দিবে। যুবরাজতন্ত্র। |