|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
পুরাণকল্পের মধ্যেই লুকিয়ে আছে বিশ্বচেতনা |
আকার প্রকার গ্যালারিতে চলছে আদিত্য বসাকের একক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ। |
আদিত্য বসাকের সাম্প্রতিক ছবি, ভিডিয়ো ও ইনস্টলেশন নিয়ে একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল সম্প্রতি আকার প্রকার গ্যালারিতে। প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘মিথ-মেকিং’। এই শিল্পীর ছবি ও অন্যান্য মাধ্যমের কাজে ইতিহাস-চেতনা ও সমকাল-চেতনা সব সময়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা নিয়ে থাকে। এর সঙ্গেই অনেক সময় জড়িয়ে থাকে ‘মিথ’ বা পুরাণকল্পের আবরণ। এ বারের কাজে তিনি যেমন ইতিহাসকে পুরাণকল্পে অভিষিক্ত করতে চেষ্টা করেছেন, তেমনি পুরাণকল্পের মূল্যমানে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছেন ইতিহাস ও সাম্প্রতিককেও।
পুরাণকল্পের ভিতর সব সময়ই থাকে বিশ্বগত ও সময়াতীত আখ্যান। এই প্রদর্শনীতে আদিত্য তাঁর মনোযোগ সংহত করেছেন ১৯৪০-এর দশকের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা ঘটনাপ্রবাহের উপর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সামগ্রিক বিশ্ব পরিস্থিতিকে টালমাটাল করে দিয়েছিল। গোষ্ঠীগত হিংসা ও ধ্বংসের এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। আমাদের দেশেও তার প্রভাব হয়েছিল প্রগাঢ়। সেই সঙ্গে এইখানে মিশেছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক হিংসা ও তার প্রতিরোধে জেগে ওঠা নানা আন্দোলন। ঔপনিবেশিক হৃদয়হীনতার অনিবার্য পরিণতি ঘটেছিল তেতাল্লিশের মন্বন্তর, দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসে। এই ঘটনাপ্রবাহের ভিতর থেকে শিল্পী ‘মিথ’ বের করে আনতে চেয়েছেন।
কাজেই এই প্রদর্শনীতে রয়েছে দু’টি প্রবাহ। একটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসের পুরাণকল্প। অন্যটি আমাদের সমকালীন বাস্তবতার ভিতর পুরাণকল্পের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। প্রথমটির শিরোনাম ‘ওয়ার্ল্ড ওয়ার টু’। ছবিগুলি ক্যানভাসের উপর টেম্পারা ও মিশ্রমাধ্যমে আঁকা। দ্বিতীয় চিত্রমালার শিরোনাম ‘মিথ মেকিং’। এখানে রয়েছে দু’রকম মাধ্যম। ক্যানভাসের উপর টেম্পারা এবং বোর্ডের উপর মিশ্রমাধ্যম। এ ছাড়া ডিজিটাল প্রিন্টের উপর টেম্পারা মিলিয়ে কাগজেও রয়েছে কয়েকটি ছবি। |
|
শিল্পী: আদিত্য বসাক। |
সব ছবিতেই শিল্পী প্রগাঢ় অন্ধকারের এক পরিসর তৈরি করেছেন। প্রথম ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে গভীর নীল প্রদীপ্ত অন্ধকার প্রেক্ষাপট। সম্মুখ পটে হলুদ ও লালের বিচ্ছুরিত বর্ণাভা। প্রকট এক ধ্বংসলীলা চলছে সেখানে। তীব্র গতিতে সৈনিকরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আক্রমণোদ্যত। পড়ে আছে মৃতের করোটি ও শবদেহ। এ সমস্ত ছোট ছোট অবয়ব পুঞ্জিত হয়ে গড়ে উঠেছে জন্তুর আদলের এক বিপুল প্রতিমাকল্প। দ্বিতীয় ছবিটিতে সেরকমই এক অন্ধকার প্রেক্ষাপটে একটি জন্তুকে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। সেটি হতে পারে কুকুর-জাতীয় বা হায়না-জাতীয়। সেই জন্তুর সারা শরীর মৃত মানুষের করোটিতে আকীর্ণ। ওদিকে প্রেক্ষাপটের অন্ধকারের ভিতর অসংখ্য প্যারাসুট ছড়িয়ে আছে। ক্রমান্বয়ে সৈন্যরা নেমে আসছে ভূমিতলে। তৃতীয় ছবিটিতে একজন মানুষ রূপান্তরিত হয়েছে বিশালকায় এক সরীসৃপে। তার পিঠের উপর পাহাড়-প্রমাণ মৃতের করোটি। ওদিকে অন্ধকার প্রেক্ষাপটে উড়ছে অজস্র প্যারাসুট।
‘মিথ মেকিং’ পর্যায়ের ছবিগুলিতে শিল্পী যুদ্ধকে অতীত ইতিহাস ও প্রাক-ইতিহাস পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত করেছেন। এখানে তিনি কিছু কিছু প্রতিমাকল্প উদ্ধৃত করেছেন ঊনবিংশ শতকের অনামা শিল্পীদের তেলরঙে আঁকা পুরাণকল্পমূলক ছবি থেকে। তার সঙ্গে মিলিয়েছেন অতীত ইতিহাসের যুদ্ধের প্রতিমাকল্প। প্রথম ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে কৌণিক ভাবে অবস্থিত অন্ধকারে ভাসমান রাধা ও শ্রীকৃষ্ণ। আর চারপাশে যুদ্ধের ও জীবনের নানা প্রতিমাকল্প। অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত। পাল্কির মিছিল আছে। আছে অশ্ব-শকট। আবার রাইফেল কাঁধে বিশ্বযুদ্ধের সময়ের সৈনিকও রয়েছে। এই চিত্রমালারই তৃতীয় ছবিটির মধ্যভাগের একটি অংশমাত্র দেখছি এই লেখার সঙ্গে। মধ্যভাগে বাঁশি হাতে কৃষ্ণ। দু’পাশে করজোড়ে দুই নৃপতি। ঊনবিংশ শতকের তেলরঙের ছবির উদ্ধৃতি। একে ঘিরে চারপাশের হলুদ পরিসরে জীবনের ও যুদ্ধের নানা আখ্যান ছড়িয়ে আছে। এ ছাড়া ভিডিয়ো ও ইনস্টলেশনেও শিল্পী যুদ্ধ ও সন্ত্রাসের চতুর্মাত্রিক পরিমণ্ডল তৈরি করেছেন। নৃত্যের এক একটি অঙ্গের অনুপুঙ্খ উপস্থাপনায় নির্মিত ভিডিয়োটি স্বতন্ত্র মাত্রায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
এতটা সাফল্য সত্ত্বেও একটি সীমাবদ্ধতা ভারাক্রান্ত করেছে কিছু ছবিকে। তা হল অতিরিক্ত নাটকীয়তা। দৃশ্যতার অতিরেকে পরিসরের ‘অবকাশ’ হারিয়ে গেছে। |
|