শিক্ষার আঙিনায় হিংসা-হানাহানির ঘূর্ণাবর্তের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে এ এক নতুন চেহারার ছাত্র নির্বাচন!
মারামারি, রক্তপাত নয়। শুধু কথা দিয়ে যে যুদ্ধ জয় করা যায়, সেটা প্রমাণ করে দিল প্রেসিডেন্সি। যুক্তি-তর্কের মুন্সিয়ানায় সহপাঠীদের সামনে সভাপতি, সহ-সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সহকারী সাধারণ সম্পাদক এবং ছাত্রীদের কমন রুমের সম্পাদক এই পাঁচটি পদের প্রার্থীরা নিজেদের যোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বুধবার। সেই সঙ্গে সামলেছিলেন বন্ধুদের প্রশ্নবাণ। নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বীরা তো বটেই, সাধারণ ছাত্রছাত্রীদেরও একটা বড় অংশ যোগ দেন ওই আলোচনায়। সেই আলোচনা, বিতর্কের ভিত্তিতেই শুক্রবার ভোটাভুটি হয়েছে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পরে প্রেসিডেন্সির এই প্রথম নির্বাচনে এসএফআই-কে হারিয়ে ছাত্র সংসদ দখল করেছে ইন্ডিপেন্ডেন্ট কনসলিডেশন (আইসি)।
এ দেশে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় (জেএনইউ)-এ আলোচনাসভার মাধ্যমে প্রার্থী-পদে যোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করার রেওয়াজ আছে। কিন্তু এ রাজ্যে এমন উদ্যোগ এই প্রথম। এবং প্রথম প্রয়াসেই বাজিমাত। গোটা প্রক্রিয়াই সম্পন্ন হয়েছে শান্তিতে। রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণে ছাত্রভোট ঘিরে উন্মত্ত হানাহানির মধ্যে ব্যতিক্রমী হয়ে উঠে এ ভাবেই অন্যদের হিংসা-হীন ভোটের দিশা দেখাল প্রেসিডেন্সি। |
নির্বিঘ্ন ভোটের উল্লাস। শুক্রবার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে। —নিজস্ব চিত্র। |
অথচ প্রেসিডেন্সির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হিংসা, উত্তেজনা একটা সময়ে প্রায় অবধারিত ছিল। নির্বাচনের আগে নিরাপদ আশ্রয়ে প্রার্থীদের আত্মগোপন, বিপক্ষের প্রার্থী অপহরণ করে ছাত্র সংসদ দখলের চেষ্টা কার্যত নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। ক্লাস বন্ধ রেখে, ক্যাম্পাসের মূল ফটক আটকে, সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের প্রবেশও নিষিদ্ধ করে দিয়ে শান্তিরক্ষার বন্দোবস্ত করতেন কর্তৃপক্ষ।
অতীতের সেই ছবিটা মুছে গিয়েছে শুক্রবারের ভোটে। মূল ফটকে পুলিশ মোতায়েন থাকলেও তারা ক্যাম্পাসের ভিতরে ঢোকেনি। ভিতরের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব রক্ষীরা। সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয়েছে। সকালের দিকে ক্লাসও হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। পূর্ব ঘোষণা অনুসারেই বেলা ১১টা ৪০ পর্যন্ত যথারীতি পঠনপাঠন চলে।
নির্বাচন নির্বিঘ্ন করতে এ বার পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে ছাত্রভোটের দিন স্থির করতে বলেছিল রাজ্য সরকার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলি তা-ই করেছে। সেই সঙ্গে নির্বাচনের দিন ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত পুলিশি প্রহরার বন্দোবস্তও করা হয়েছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তি বজায় রাখতে ক্যাম্পাসের ভিতরেও থেকেছেন পুলিশকর্মীরা। কিন্তু যাদবপুর বা প্রেসিডেন্সিতে তাঁরা থেকেছেন মূল ফটকের বাইরে।
সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ কিংবা রামকৃষ্ণ মিশনের কলেজগুলিতে ছাত্র নির্বাচন হয় না। শিবপুরের বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি বা বেসু-তে ছাত্র নির্বাচন হয় বটে, তবে সেখানে রাজনীতির অনুপ্রবেশ নেই। তাই রাজ্যের বিভিন্ন কলেজে ছাত্র নির্বাচন নিয়ে সংঘর্ষ চললেও বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কেন বেসু, রামকৃষ্ণ মিশনের মডেল অনুসরণ করছে না, সেই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন অনেকে। এর মধ্যেই বিকল্প পথের সন্ধান দিল প্রেসিডেন্সি। তিন বছর পরে সেখানে ছাত্র নির্বাচন হল। তবে তার জন্য ছাত্রছাত্রীদের আতঙ্কে কাটাতে হল
না গোটা দিনটা।
কলকাতা, যাদবপুরে নির্বিঘ্নে নির্বাচন হলেও নিজেদের বক্তব্যের মাধ্যমে যোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করার অভিনব পদ্ধতি সেখানে চালু করা হয়নি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস এই প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে স্বীকার করে নিয়েছেন নিজেদের অপারগতার কথা। তিনি বলেন, “প্রেসিডেন্সিতে ছাত্র-সংখ্যা দু’হাজার। আর সাতটা ক্যাম্পাস মিলিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-সংখ্যা ২০ হাজার। তা ছাড়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে পড়ুয়ারা আসেন। এই ধরনের বিতর্কসভার আয়োজন করা আমাদের পক্ষে কার্যত অসম্ভব।” যাদবপুরের উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী বিষয়টি নিয়ে তেমন আগ্রহী নন। তিনি বলেন, “ওই আলোচনাসভার কথা জেনেছি সংবাদমাধ্যম থেকেই। এ ব্যাপারে সবিস্তার ধারণা নেই আমার। তাই কিছু বলতে পারব না।”
সকলের সঙ্গে আলোচনা করে সবার সম্মতিতে এমন একটা প্রক্রিয়া চালু করা গেলে আপত্তি নেই বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রঞ্জন চক্রবর্তীর। তিনি বলেন, “বিদেশে বেশ কিছু জায়গায় এমন পদ্ধতি চালু আছে। খুবই অভিনব আর ভাল প্রক্রিয়া এটা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটা চালু করা যায় কি না, সকলের সঙ্গে আলোচনা করে দেখব।” |