বাইরে থেকে কিছুই বোঝার জো নেই। কিন্তু ভিতরে ঢুকলেই চিচিং ফাঁক। চোখের সামনে একটা আস্ত শহর। ফারাক শুধু একটাই। এ শহর রয়েছে মাটির ৬০ ফুট গভীরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত থেকে বাসিন্দাদের বাঁচাতে ইংল্যান্ডের র্যামসগেটে এই সুড়ঙ্গ-শহর তৈরি করেছিলেন তৎকালীন মেয়র। তার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষেই দর্শকদের জন্য ফের খুলতে চলেছে এই লুকনো শহরের দরজা।
তবে আপাতত সীমিত ভাবে। পরে সরকারি অনুমতি মিললে আরও বেশি মানুষ ঘুরে দেখতে পারবেন এই ঐতিহাসিক শহর। এত দিন পরেও যার আনাচে কানাচে বসতির চিহ্ন স্পষ্ট। কোথাও ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো মরচে ধরা সাইকেল এখনও জিরোচ্ছে। কোথাও আবার ভাঙা বিছানার ধ্বংসাবশেষ। সহজ ভাষায় আর পাঁচটা শহরে যা যা থাকার কথা, মোটামুটি সব নিয়েই তৈরি হয়েছিল তিন মাইল ব্যাপী এই সুড়ঙ্গ শহর। এবং ইতিহাস বলছে, জার্মানির লাগাতার হামলা থেকে বাঁচতে এর আশ্রয়ে বছর খানেক কাটিয়েছিলেন বহু মানুষ। এমনকী, ১৯৪০ সালের অগস্টে এক বার শহরের হালচাল পরিদর্শনে এসে এই সুড়ঙ্গ শহরেই আশ্রয় নিতে হয়েছিল তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে। অথচ প্রথম দিকে এই শহর তৈরির অনুমতি পেতে টানা তিন বছর নাকানিচোবানি খেয়েছিলেন র্যামসগেটের তৎকালীন মেয়র আর্থার কেম্প। অবশেষে ১৯৩৯ সালের মার্চে মেলে অনুমতি। আর জুন মাসের মধ্যেই প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হয়ে যায়। পুরোটাই কেম্পের তদারকিতে। আসলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত র্যামসগেটের বাসিন্দাদের মনে তখনও যুদ্ধের স্মৃতি স্পষ্ট। মেয়র আন্দাজ করেছিলেন, সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে খুব শীঘ্রই।
হলও তাই। সেপ্টেম্বরে শুরু হল যুদ্ধ। আক্রান্ত হল র্যামসগেট। প্রাণ বাঁচাতে প্রথমে অন্যত্র পালিয়ে যান সেখানকার ৩০০০ মানুষ। কিন্তু পরে তাঁদের বেশির ভাগই ফিরে এসে আশ্রয় নেন সুড়ঙ্গ-শহরে। তার ভিতরে ছিল দোতলা বিছানা, কম্বল, চাদর। ছিল খেলার জায়গা। হাসপাতালও তৈরি করা হয়েছিল। দুই সুড়ঙ্গের মাঝে খাঁজ বানিয়ে সেখানে শৌচাগারও তৈরি করা হয়।
ঠিক কেমন ছিল সেই জীবন? গোয়েনডোলিন ল্যাংরিজের বয়ানে, “প্রত্যেক দিনই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হত। বিনোদনের নয়া উপায় খুঁজে বের করতাম নিজেরাই।” তখন গোয়েনডালিনের বয়স ১২। লেখাপড়া নেই, সারা দিন খালি খেলা আর খেলা। তবে সূর্যের আলোয় নয়, সুড়ঙ্গের আঁধারে।
কিন্তু সেই আশ্রয় মোটেও পরিচ্ছন্ন ছিল না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক কর্তা তার অবস্থা দেখে বলেছিলেন, “যাযাবরদের শিবির ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি ওটি দেখে।” বাস্তবিক। বিছানার পাশেই শৌচাগার আর তাতেই প্রতিদিনের প্রাতঃকৃত্য। দুর্গন্ধ ছড়াবেই। দূষণও হবে। তবে সেই দুর্গন্ধের মধ্যেই ‘বাসা’ বেধেছিলেন বাস্তুহারারা। আসলে, প্রাণ বাঁচাতে একমাত্র আশ্রয় তো এটিই।
যুদ্ধের বাজারে ওই আশ্রয়ই বা কম কী? |