মন্দিরক্ষেত্র তেলকূপি অবহেলায় ক্ষোভ
প্রাচীন মন্দিরক্ষেত্র তেলকূপির বদলে তারই কিছু দূরের তেলকূপি ঘাটকে পর্যটন ক্ষেত্র হিসেবে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করলেন রঘুনাথপুরের পাড়া কেন্দ্রের কংগ্রেস বিধায়ক উমাপদ বাউরি। একই মহকুমা এলাকায় দামোদর নদের তীরে তেলকূপি নামে দু’টি জায়গা রয়েছে। এই বিভ্রান্তিকে সামনে রেখে আদি তেলকূপি অর্থাৎ একদা মন্দির নগরী তেলকূপির বদলে সেখান থেকে কমবেশি চল্লিশ কিলোমিটার দূরের তেলকূপি ঘাটকে পযর্টনক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে বলে রাজ্যের পযর্টনমন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু চৌধুরীকে তাঁর আপত্তির কথা জানিয়েছেন উমাপদবাবু। কৃষ্ণেন্দুবাবু জানিয়েছেন, বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখবেন। তেলকূপি ঘাটকে পর্যটনকেন্দ্র করার সিদ্ধান্তে তাঁদের আপত্তির কথা জানিয়ে প্রশাসনকে চিঠি লিখেছে তেলকূপি সংরক্ষণ কমিটি নামে এক সংগঠনের সদস্যেরাও।
এই মন্দিরগুলি সংস্কারের দাবি কংগ্রেস বিধায়কদের।—নিজস্ব চিত্র।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে বারেবারে জেলায় এসে পুরুলিয়ার প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলিকে ও জঙ্গলমহলের এই প্রান্তীয় জেলার সৌন্দর্যকে মানুষের সামনে হাজির করার কথা বলছেন। এ কথা মাথায় রেখেই রাজ্য সরকার তেলকূপি ঘাটে পরিকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য গত ২০১২ সালেই অর্থ মঞ্জুর করে। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে রাজ্য সরকার ৭৬ লক্ষ ৮৮ হাজার ৬১২ টাকা বরাদ্দ করে। কাজ শুরু করার জন্য জেলা প্রশাসনের হাতে ২৬ লক্ষ টাকা পৌঁছেও যায়। ২০১৩ সালের মার্চে সাঁতুড়ি ব্লকের তেলকূপি ঘাটে পরিকাঠামো গড়ার কাজও শুরু হয়ে যায়। যদিও জমির সমস্যায় সেই প্রকল্পের কাজও বেশ কিছুদিন থমকে রয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
বিধায়ক উমাপদবাবু বলেন, “দামোদরের তীরে এই তেলকূপি ঘাটকে সংস্কার করে পর্যটনক্ষেত্র গড়তে চাইলে, আমাদের আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক আকর্ষণ রয়েছে রঘুনাথপুর ২ ব্লকের তেলকূপিকে ঘিরেই। তেলকূপি ঘাটে কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নেই।” সেখানে কারও স্বজন মারা গেলে তাঁরা তাঁর অস্থি বিসর্জন দেন। তেলকূপি ঘাটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও রয়েছে। কিন্তু মন্দিরক্ষেত্র তেলকূপিই বেশি বিখ্যাত। সেখানেও বহু মানুষ মৃত স্বজনের অস্থি বিসর্জন দেন। তবে এই এলাকার জৈন মন্দিরগুলিই প্রধান আকর্ষণ। উমাপদবাবুর বক্তব্য, “তাই মন্দিরক্ষেত্র তেলকূপির বদলে যদি অন্য তেলকূপিকে গড়ে তোলা হয়, তা হলে ইতিহাস চাপা পড়ে থাকবে। সেকথাই আমি পযর্টনমন্ত্রীকে জানিয়েছি।”
মন্দির গবেষক সুভাষ রায় বলেন, “মন্দিরক্ষেত্র তেলকূপি একদা তৈলকম্প বন্দর নামে পরিচিত ছিল। গবেষকদের মতে এখানে গড়ে ওঠা মন্দিরগুলি আনুমানিক নবম-দশম শতাব্দীর।” ইংরেজ পুরাতত্ত্ববিদ জে ডি বেগলার ১৮৭২-৭৩ সালে এই তেলকূপিতে এসে ২২টি মন্দির দেখেছিলেন। সেই মন্দিরগুলির কিছু ছবিও তিনি তুলেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, তেলকূপির এই মন্দিরগুলির তিনটি ভাগ দেখতে পেয়েছিলেন। গ্রামের সামান্য পুব দিকে নদের একেবারে ধারে ছিল সব থেকে বড় মন্দিরগুচ্ছ। দ্বিতীয় গুচ্ছটি ছিল গ্রামের আরও কাছে এবং গ্রামের পশ্চিম দিকে। তৃতীয় মন্দিরগুচ্ছটি ছিল গ্রামের দক্ষিণ-পুব দিকে।
সুভাষবাবু জানান, জৈন ব্যবসায়ীরা এই বন্দর ব্যবহার করে তাম্র আকরিক রপ্তানি করত। সেই সূত্রে এই এলাকায় তাঁদের বসতি ছিল। তৈলকম্পের রাজা রুদ্রশেখর ছিলেন পাল বংশের রাজা রামপালের বিশেষ মিত্র। ইতিহাসবিদদের ধারণা, তাঁর আমলেই এই মন্দিরগুলি গড়ে ওঠে। মন্দিরগুলিতে কিছুটা ওডিশি প্রভাবও রয়েছে। কিন্তু ১৯৫৭ সালে ডিভিসি-র জলাধার গড়ে উঠলে মন্দিরগুলি প্রায় সবই জলের তলায় চলে যায়। তিনটি এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে। একটি নদের ধারে পাথরবাড়ি গ্রামে, আর একটি লালপুর গ্রামে এবং অন্যটি জলের মধ্যে। জলাধারের জল কমলে অর্থাৎ এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত এই মন্দিরটি দেখা যায়।
তাঁর কথায়, “আমাদের বক্তব্য, তেলকূপি ঘাটকে পর্যটনক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তোলা হলে, আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বের প্রশ্নে এক তেলকূপির বদলে আর এক তেলকূপিকে গড়ে তোলা হলে, ইতিহাস হারিয়ে যাবে। যা কোনওভাবেই কাম্য নয়। তা ছাড়া যে তেলকূপি ঘাটকে পর্যটনক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে, সেখানকার ইতিহাস কী, তা আমাদের জানা নেই। মানুষজন কিন্তু মন্দিরক্ষেত্র তেলকূপিকেই প্রত্নতাত্ত্বিকস্থল হিসেবে জানেন।” রাজ্য পুরাতত্ত্ব দফতরের উপ অধিকর্তা অমল রায় বলেন, “মন্দিরক্ষেত্র তেলকূপির ইতিহাস বিখ্যাত। তবে পর্যটন দফতর কোথায় পর্যটন কেন্দ্র করবে, সেই ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে কোনও আলোচনা করেনি।”
জেলা কংগ্রেসের সভাপতি তথা বাঘমুণ্ডি কেন্দ্রের বিধায়ক নেপাল মাহাতো বলেন, “প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের ফলে যদি ইতিহাস চাপা পড়ে যায়, তা হলে এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে আমরা বিধানসভায় প্রশ্ন তুলব।” রঘুনাথপুরের তৃণমূল বিধায়ক পূর্ণচন্দ্র বাউরি বলেন, “আপাতত তেলকূপি ঘাটের জন্য অর্থ বরাদ্দ হয়েছে। যদিও স্থানীয় সমস্যায় সেখানে কাজ আটকে রয়েছে।” ওয়েবকুপার রাজ্য কমিটির সহ সম্পাদক তথা সিধো কানহো বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, “মন্দিরক্ষেত্র তেলকূপির প্রামাণ্য ইতিহাস রয়েছে। সেক্ষেত্রে অন্য কোনও এলাকাকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হলে, তা নিয়ে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু এই এলাকার গুরুত্বের কথা ভেবে এখানেও পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা উচিত। তাতে ইতিহাস সমৃদ্ধ হত।”
জেলাশাসক তন্ময় চক্রবর্তী বলেন, “এই বিষয়টা আমাদের নজরে এসেছে। তবে আমাদের কাছে দুই তেলকূপিরই গুরুত্ব রয়েছে। আমরা দু’টি জায়গাকেই পযর্টনক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তুলব।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.