|
|
|
|
ডাইন অপবাদে বৃদ্ধাকে পুড়িয়ে মারার নালিশ
নিজস্ব সংবাদদাতা • জামবনি |
ডাইনি অপবাদে এক শবর বৃদ্ধাকে ঘুমন্ত অবস্থায় পুড়িয়ে মারার অভিযোগ উঠল পশ্চিম মেদিনীপুরের জামবনি থানার বড়শোল গ্রামে।
বুধবার রাতে নিজের বাড়িতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে শ্রীমতী শবর (৬২) নামে ওই বৃদ্ধার মৃত্যু হয়। বৃদ্ধার দুই ছেলে অর্জুন ও নকুল শবরের অভিযোগ, প্রতিবেশী পরিবারের পাঁচ জন মিলে তাঁদের মাকে ডাইনি অপবাদে পুড়িয়ে মেরেছে। অভিযোগের ভিত্তিতে এক বৃদ্ধ দম্পতিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বাকি তিন অভিযুক্ত পলাতক। ধৃত অশীতিপর সুবল শবর ও তাঁর স্ত্রী বিমলা শবরকে বৃহস্পতিবার ঝাড়গ্রাম এসিজেএম আদালতে তোলা হলে তদন্তের স্বার্থে দু’দিন পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ হয়। তবে ঘটনাটি তদন্ত সাপেক্ষ হওয়ায় এবং পারিপর্শ্বিক কিছু অসঙ্গতির নিরিখে অভিযোগপত্রে ‘ডাইনি অপবাদে’ কথাটির উল্লেখ নেই। খুনের অভিযোগে মামলা রুজু করেছে পুলিশ।
বড়শোল গ্রামের শবর পাড়ায় খেজুরপাতার ছাউনি দেওয়া মাটির একটি কুঁড়ে ঘরে থাকতেন শ্রীমতীদেবী। ওই বাড়িটি পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছে। দগ্ধ বাড়িটির ফরেন্সিক (সিএফএসএল) পরীক্ষা করানো হবে। এ দিন ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতালের পুলিশ মর্গে শ্রীমতীদেবীর দগ্ধ দেহের ময়না-তদন্ত করা হয়। হাসপাতাল সূত্রের খবর, ভিসেরা রিপোর্ট পাওয়ার পরই ময়না-তদন্তের চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়া হবে। পুলিশ জানিয়েছে, ময়না তদন্তের রিপোর্ট ও ফরেন্সিক পরীক্ষার রিপোর্ট না-পাওয়া পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট ভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়। এটি খুন, নাকি দুর্ঘটনা তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। |
বড়শোল গ্রামে পোড়া বাড়ি। |
বড়শোল গ্রামের শবরপাড়ায় ১৮টি শবর পরিবারের বাস। হতদরিদ্র পরিবারগুলি দিনমজুরি করে দিনযাপন করেন। শবরপাড়ার এক প্রান্তে একটি আতাগাছের তলায় ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে একাই থাকতেন শ্রীমতীদেবী। পঞ্চায়েত থেকে বিধবা ভাতা পেতেন তিনি। একই উঠোনে কিছুটা দূরে পৃথক দু’টি মাটির ঘরে শ্রীমতীদেবীর দুই ছেলে-বৌমারা আলাদা থাকেন। সকলেই দিনমজুরি করেন। শ্রীমতীদেবীও দিনমজুরির পাশাপাশি, জঙ্গলের শালপাতা ও শুকনো কাঠ বেচে সংসার চালাতেন। শ্রীমতীদেবীর কুঁড়ের পিছনে প্রায় সত্তর ফুট দূরে রাবণ শবরের বাড়ি। পড়শিরা জানিয়েছেন, রাবণ শবরের দেড় বছরের ছেলে বিষ্ণুর অসুস্থতাকে ঘিরে গণ্ডগোল। শিশুটি কিছুদিন ধরে সর্দি-জ্বরে ভুগছে। এর জন্য শ্রীমতীদেবীকে দায়ী করে রাবণবাবুর পরিবারের লোকজন ডাইনি অপবাদ দিয়ে গালিগালাজ করছিলেন। বুধবার সন্ধ্যায় বিষ্ণুর ফের জ্বর বাড়লে শিশুটির ঠাকুর্দা, প্রপিতামহ, প্রপিতামহীরা শ্রীমতীদেবীকে প্রবল গালিগালাজ করেন বলে অভিযোগ। এরপরই বুধবার রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ শ্রীমতীদেবীর খেজুরপাতার ছাউনি দেওয়া কুঁড়েঘরটি আগুনে জ্বলতে দেখেন তাঁর পরিজনেরা।
শ্রীমতীদেবীর বড় বৌমা অর্জুনবাবুর স্ত্রী ভবানী শবর বলেন, “হাড়ভাঙা খাটুনির পরে আমরা রাত আটটার মধ্যে ঘুমোতে গিয়েছিলাম। শাশুড়ি মা-ও রাতের খাওয়া সেরে নিজের কুঁড়েতে ঘুমিয়ে পড়েন। রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ হঠাৎ-ই বাঁশফাঁটার আওয়াজ শুনে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে দেখি শাশুড়ি মায়ের কুঁড়েটা দাউদাউ করে জ্বলছে।” ভবানীদেবী স্বামী ও দেওরকে ঘুম থেকে তোলেন। তাঁদের চিৎকার চেঁচামেচিতে গ্রামবাসীরা জল ঢেলে আগুন নেভান। ঘরের ভিতর দগ্ধ অবস্থায় পড়েছিলেন শ্রীমতীদেবী। |
শ্রীমতি শবর। |
স্থানীয় কাঁপগাড়ি পঞ্চায়েতের সদস্য ত্রিলোচন মাহাতোর বাড়ি বড়শোল গ্রামেই। খবর পেয়ে তিনি জামবনি থানায় ফোন করেন। রাতেই পুলিশ এসে মৃতদেহ উদ্ধার করে। অভিযোগের ভিত্তিতে বিষ্ণুর প্রপিতামহ ও প্রপিতামহীকে (সুবল শবর ও বিমলা শবর) গ্রেফতার করে পুলিশ। ত্রিলোচনবাবু বলেন, “শ্রীমতীদেবীর কুঁড়ে ঘরের ভিতর উনুন ছিল। আবার আগুন লাগার পরও কেউ তাঁর আর্তনাদ শুনতে পাননি। ফলে, বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষ। তবে, ঘটনার পরেই রাবণের বাবা পঞ্চানন শবর আমার কাছে ছুটে এসেছিলেন। আগুন লাগার ঘটনায় তাঁদের ফাঁসানো হচ্ছে বলে পঞ্চাননবাবু দাবি করেছিলেন।” অন্যতম অভিযুক্ত পঞ্চাননবাবু ও তাঁর স্ত্রী চঞ্চলাদেবী ও পঞ্চাননবাবুর ভ্রাতৃবধূ কাজল শবর রাতেই ফেরার হয়ে যান। অভিযোগপত্রে নাম না-থাকলেও গা-ঢাকা দিয়েছেন অসুস্থ শিশুর বাবা রাবণ শবরও।
বৃহস্পতিবার বড়শোল গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, দগ্ধ কুঁড়েটির ভিতরে অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি, কড়াই, থালা ও মাটির কলসি রয়েছে। ঘরের ভিতরেই এককোণে একটি মাটির পাতা-উনুন রয়েছে। কেরোসিনের লম্ফও রয়েছে একটি। ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্যই দগ্ধ বাড়িটির চারদিক দড়ি দিয়ে ঘিরে দিয়েছে পুলিশ। গ্রামবাসী রোহিত শবর, শিবরাম শবরেরা বলেন, “শিশুটির অসুস্থতাকে ঘিরেই অর্জুন-নকুলের মা’কে ডাইনি বলে গালি দিত রাবণের বাড়ির লোকেরা। বুধবার সন্ধ্যায় শ্রীমতীদেবীকে প্রবল গালিগালাজ করেছিল ওরা। তারপর এই ঘটনার পর ওদের উপরই সন্দেহ হচ্ছে।” |
ছবি: দেবরাজ ঘোষ। |
|
|
|
|
|