|
|
|
|
|
ভোটের চাপে বাড়ল ভর্তুকির
সিলিন্ডার, হিমঘরে আধার-ও
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি ও কলকাতা
৩০ জানুয়ারি |
|
সংস্কারের পথে হেঁটে ভর্তুকিতে দেওয়া রান্নার গ্যাস সিলিন্ডারের সংখ্যা বছরে ৯টায় বেঁধে দিয়েছিলেন মনমোহন সিংহ। আধার কার্ডের মাধ্যমে সরাসরি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সেই ভর্তুকির টাকা পৌঁছনোর ব্যবস্থাও করছিল কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের আগে ভর্তুকির সিলিন্ডারের সংখ্যা বাড়িয়ে ১২ করার সিদ্ধান্ত নিল কেন্দ্র। সেই সঙ্গে সরে এল আধার কার্ডের মাধ্যমে সরাসরি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ভর্তুকি পাঠানোর পথ থেকেও।
ভর্তুকির গ্যাস সিলিন্ডারের সংখ্যা যে বাড়তে চলেছে, সেটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল সম্প্রতি রাহুল গাঁধী প্রকাশ্যে এই দাবি তোলার পরেই। দু’সপ্তাহ আগে কংগ্রেসের অধিবেশন মঞ্চে দাঁড়িয়েই মনমোহনকে সরাসরি সম্বোধন করে রাহুল বলেছিলেন, “প্রধানমন্ত্রীজি, ৯টা সিলিন্ডারে কাজ হচ্ছে না। অন্তত ১২টা সিলিন্ডার দিতে হবে।” রাহুলের এই কথার পরে বোঝাই গিয়েছিল, কী হতে চলেছে। শুধু প্রশ্ন ছিল, কবে এই নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে সরকার?
আজ মন্ত্রিসভার রাজনীতি বিষয়ক কমিটির বৈঠকের পরে সরকার জানিয়ে দিল, পরিবার পিছু ১২টি ভর্তুকির সিলিন্ডারের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে এপ্রিল থেকে। তার আগে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে ভর্তুকি-মূল্যে পরিবার পিছু একটি করে সিলিন্ডার দেওয়া হবে। এই সিদ্ধান্তের ফলে সরকারের ঘাড়ে বাড়তি ৫ হাজার কোটি টাকার বোঝা চাপতে চলেছে।
পাশাপাশি পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী বীরাপ্পা মইলি এ দিন জানান, সিলিন্ডার বাবদ ভর্তুকি পাওয়ার জন্য আধার কার্ডের ব্যবহার আপাতত বাধ্যতামূলক হচ্ছে না। ভর্তুকির টাকা গ্রাহকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টেও যাবে না। অতীতে যে ভাবে মানুষ ভর্তুকি-দামে সিলিন্ডার কিনতেন, সে ভাবেই কিনতে পারবেন। ১ ফেব্রুয়ারি এই নিয়ম চালু হবে।
ভর্তুকির সিলিন্ডারের সংখ্যা ৯ থেকে বাড়িয়ে ১২ করার দাবি দল ও সরকারের মধ্যে অনেক আগে থেকেই ছিল। রাহুল প্রকাশ্যে দাবি তোলার পরে দলীয় নেতাদের একাংশ উল্টে এমনও বলেছেন, রাহুল এই কাজটি আগে করলে কংগ্রেসের এত ক্ষতি হতো না। আজ মন্ত্রিসভার বৈঠকেও একই কথা শোনা গিয়েছে একাধিক মন্ত্রীর মুখে। সিদ্ধান্তটা যে অর্থনীতি বিষয়ক কমিটির বদলে রাজনীতি বিষয়ক কমিটির বৈঠকে হল, তা থেকেই বোঝা যাচ্ছে, দেশের আর্থিক হালকে ছাপিয়ে গিয়েছে দলের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা।
ভোটের মুখে সরকারের এমন খয়রাতির সিদ্ধান্তের সঙ্গে কিন্তু একমত হতে পারেননি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর রঘুরাম রাজন। বরং তিনি কেন্দ্রের সমালোচনা করে বলেছেন, “লক্ষ্যভ্রষ্ট ভর্তুকির বহর বাড়ানোর ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত। কারণ, যে সব গুরুত্বপূর্ণ দিকে আমাদের খরচ বাড়ানো উচিত, সে দিকে বিশেষ তাকাচ্ছি না।” গভর্নরের যুক্তি, জনসংখ্যার একটা অংশ ভর্তুকি দামে সিলিন্ডার পেয়ে লাভবান হয়। কিন্তু বাকিদের ভর্তুকি দেওয়ার অর্থ নেই। তাদের পুরো দাম দেওয়ারই ক্ষমতা রয়েছে। সে জন্যই তিনি ভর্তুকিতে বাড়তি সিলিন্ডার দেওয়ার বিষয়টিকে লক্ষ্যভ্রষ্ট বলেছেন।
অন্য দিকে এত দিন ভর্তুকি সরাসরি অ্যাকাউন্টে পাঠানোর কর্মসূচিকে ‘আপনার টাকা, আপনার হাতে’ বলে প্রচারে নেমেছিলেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। আজ সেটাও স্থগিত করা হল। মনমোহন-চিদম্বরম আগে দাবি করেছিলেন, এই ব্যবস্থা অর্থনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেবে। এ ক্ষেত্রে বন্ধ করা যাবে সিলিন্ডারের অপব্যবহার। বাড়ির জন্য ভর্তুকির সিলিন্ডার অনেক ক্ষেত্রেই ঘুরপথে বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য বিক্রি হয়ে যায়। এই পদ্ধতিতে তা বন্ধ করা সম্ভব হবে।
কিন্তু এই কাজে বিস্তর সমস্যা দেখা দিচ্ছিল। রান্নার গ্যাস পাওয়ার জন্য আধার কার্ড বাধ্যতামূলক করা উচিত কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে সুপ্রিম কোর্টও। যাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে আধার নম্বর যুক্ত করার কাজ হয়ে গিয়েছে, সিলিন্ডার বুক করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের অ্যাকাউন্টে ভর্তুকির টাকা ঢুকে যাওয়ার কথা। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা হচ্ছিল না অনেক সময়েই। ফলে কার্যত পুরো দামেই সিলিন্ডার কিনতে হচ্ছিল গ্রাহককে। বহু জায়গায় এই অভিযোগ ওঠায় আপাতত গোটা দেশেই এই ব্যবস্থা স্থগিত রাখছে সরকার।
এই নিয়ে মইলি বলেন, “পরিকল্পনা রূপায়ণে কিছু সমস্যা দেখা দিচ্ছিল। অনেক জায়গাতেই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে আধার নম্বর যুক্ত করার কাজ শেষ হয়নি। তাই ঠিক হয়েছে, একটি কমিটি রূপায়ণের কাজটি পর্যালোচনা করবে। পর্যালোচনা না হওয়া পর্যন্ত আগের ব্যবস্থাতেই ভর্তুকি দামে সিলিন্ডার পাওয়া যাবে।”
এ দিনের সিদ্ধান্তের পরে কিছু ধোঁয়াশাও তৈরি হয়েছে। যেমন, যাঁরা ইতিমধ্যে ১০টি সিলিন্ডার কিনে ফেলেছেন এবং শেষ সিলিন্ডারটি কিনেছেন পুরো দামে, তাঁরা কি টাকা ফেরত পাবেন? পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের বক্তব্য, চলতি আর্থিক বছরে এখন পর্যন্ত কোন পরিবার ভর্তুকি মূল্যে কতগুলি সিলিন্ডার পেয়েছেন, তা আর বিবেচ্য হবে না। কোনও টাকাও ফেরত দেওয়া হবে না। ফেব্রুয়ারি ও মার্চে একটি করে সিলিন্ডার ভর্তুকি দামে দেওয়া হবে। আবার যাঁরা এ বছর ৯টির কম ভর্তুকির সিলিন্ডার কিনেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে কী হবে? তাঁরা কি আগামী দুই মাসে প্রয়োজনে দু’টির বেশি ভর্তুকির সিলিন্ডার পাবেন? এই নিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের প্রতিলিপি না দেখে মুখ খুলতে নারাজ তেল সংস্থাগুলি।
সংশয় তৈরি হয়েছে আধার নম্বরের ভিত্তিতে ভর্তুকি দেওয়া নিয়েও। তবে পরে তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রী মণীশ তিওয়ারি বলেন, “গ্রাহকদের যে সব বিষয়ে অসুবিধা হওয়ার সম্ভাবনা, সেগুলি খতিয়ে দেখে ঠিক করা হবে।” তাঁর বক্তব্য, একমাত্র
রান্নার গ্যাসের ক্ষেত্রেই আধার কার্ডের মাধ্যমে ভর্তুকি দেওয়ার প্রক্রিয়া স্থগিত রাখা হচ্ছে। অন্যান্য যে সব ভর্তুকি বা বৃত্তি এই ভাবে দেওয়া হচ্ছে, তা আগের মতোই চলবে।
পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের অঙ্ক বলছে, ৮৯.২ শতাংশ পরিবারেরই বছরে ৯টি সিলিন্ডারে কাজ চলে যায়। এখন সেই সংখ্যা ১২ করা হলে ৯৭ শতাংশ পরিবার এসে যাবেন এর আওতায়। এই নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন রঘুরাম রাজন। তাঁর বক্তব্য, ৯৭ শতাংশ মানুষকেই ভর্তুকি দেওয়ার অর্থ হল ওঁদের কাছ থেকে কর বাবদ আদায় করা টাকা ভর্তুকির মাধ্যমে আবার ওঁদেরই হাতে ফিরিয়ে দেওয়া। তা হলে রোজগারের রইল কী!
আদ্যন্ত অর্থনীতির মানুষ রাজনের সঙ্গে কিন্তু একমত নন কংগ্রেসে প্রবীণ মন্ত্রীরা। তাঁরা আজ বৈঠকের শুরু থেকেই ভর্তুকির সিলিন্ডারের সংখ্যা বাড়ানোর পক্ষে সওয়াল করেছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন, ভোটের মুখে এসে অর্থনীতির অঙ্ক আর রাজনীতির অঙ্ক একেবারেই এক নয়। এই সওয়ালের পুরোভাগে ছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি। যিনি অতীতে খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি থেকে শুরু করে মনমোহনের সব সংস্কার কর্মসূচিতে জোরালো আপত্তি জানিয়েছেন। অ্যান্টনি এ দিন প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, “আগে পই পই করে বলেছিলাম, ভর্তুকি মূল্যে বছরে অন্তত ১২টি সিলিন্ডার দেওয়া হোক। কিন্তু তাতে কর্ণপাতও করা হয়নি। ওই একটি সিদ্ধান্তের জন্য কংগ্রেসের বড় সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে।” এমনিতে কথা কম বলেন অ্যান্টনি। কিন্তু আজ ক্ষোভের মাথায় টানা ১৫টি মিনিট বক্তব্য রেখেছেন তিনি। অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমকে বাদ দিয়ে কংগ্রেসের অন্য মন্ত্রীরা তো বটেই, কৃষিমন্ত্রী শরদ পওয়ারও এতে সায় দেন।
কিন্তু এই জনমোহিনী রাজনীতির পথে হেঁটেও কি কংগ্রেস মানুষের আস্থা ফিরে পাবে? কংগ্রেস শিবিরের অনেকের মতে, বড় দেরি হয়ে গিয়েছে। অন্তত তিন মাস আগে এই সিদ্ধান্ত নিলে তবু কথা ছিল। এখন যে বিশেষ সুবিধা হবে না, সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন সরকারের শরিক থেকে বিরোধী, অনেক দলই। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় যেমন বলেছেন, “এখন এ সব বলা অর্থহীন। কারণ, এপ্রিলের পরে তো নতুন সরকার এসে যাবে। তখন কী দেওয়া হবে, তা বলার অধিকার এই সরকারের নেই।” শরিক মুলায়ম সিংহও দাবি করেছেন, “সরকার এমন বিরাট কিছু করেনি। ভর্তুকি মূল্যে বছরে অন্তত ২৪টি সিলিন্ডার দেওয়া উচিত ছিল। সেই সঙ্গে গরিবদের বিনামূল্যে সিলিন্ডার দিতে হবে।” বিজেপি নেতা প্রকাশ জাভড়েকর বলেন, “কংগ্রেস কি ভাবছে এই সিদ্ধান্তে জনতা তালি বাজাবে? ভর্তুকি মূল্যে প্রথমে ৬টি ও পরে ৯টি সিলিন্ডার দেওয়ার পাপ তো ওরাই করেছিল। এখন প্রায়শ্চিত্ত করছে। মানুষ এত মূর্খ নয়।”
|
সংস্কারের বিরুদ্ধে শ্রমিকরা |
মনমোহন সিংহের আর্থিক দাওয়াইয়ের বিরোধিতা এ বার শ্রমিক সংগঠনের মুখেও। এবং সেটা তাঁরা করলেন রাহুল গাঁধীর সঙ্গে এক বৈঠকেই। দলের ইস্তেহার তৈরির আগে শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া খতিয়ে দেখতে বৃহস্পতিবার শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন রাহুল। সেখানে একাধিক শ্রমিক নেতা বলেন, পেনশন খাতে সংস্কারের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার, তা শ্রমিক-বিরোধী। এতে শ্রমিকদের আর্থিক সুরক্ষা নিয়ে ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যাচ্ছে। গোটা দেশে অভিন্ন ন্যূনতম মজুরি চালু করা নিয়ে কেন্দ্রের গয়ংগচ্ছ মনোভাবেরও সমালোচনা করেন তাঁরা। দাবি করেন, চুক্তি ব্যবস্থায় শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে আর্থিক সুরক্ষাও সুনিশ্চিত করতে হবে। রাহুল আশ্বাস দেন, শ্রমিক স্বার্থে দলের ইস্তেহারে যথাসম্ভব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে। এ-ও জানান, শ্রমিক সংগঠনের বেশ কিছু নেতাকে এ বার প্রার্থী করতে চাইছেন তিনি। |
|
|
|
|
|