|
|
|
|
বন্ধের মুখে দুই জেলার একমাত্র আর্ট কলেজ |
সুমন ঘোষ • মেদিনীপুর |
গুটি গুটি পায়ে অনেকটাই এগিয়ে ছিল। কিন্তু ক্রমে দুই গোষ্ঠীর মতবিরোধ চরম আকার নেয়। তারই জেরে বন্ধ হতে বসেছে দুই মেদিনীপুরের একমাত্র আর্ট কলেজ। ‘শিল্পীচক্র’ নামে এক সংস্থার উদ্যোগে ২০০১ সালে মেদিনীপুর শহরে গড়ে ওঠে এই আর্ট কলেজ। জমিটি শিল্পীচক্রের নামেই ছিল। কিন্তু গত ৫-৬ বছরে শিল্পীচক্রের সম্পাদক অমিতাভ দত্তের সঙ্গে কলেজ কর্তৃপক্ষের নানা মতবিরোধ দেখা দেয়। একপক্ষ অন্যপক্ষের বিরুদ্ধে অর্থ তছরুপ থেকে কুরুচিপূর্ণ ব্যবহার, ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টা-সহ নানা অভিযোগে সরব হয়। এক সময় জোরদার ছাত্র আন্দোলনও হয়। শিল্পীচক্রের সম্পাদক প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হন। এই পরিস্থিতিতে দেখা দেয় জমি-জট। জমি কলেজের নামে না থাকায় রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন বাতিল করে দেয়। ফলে চলতি বছর থেকে এই আর্ট কলেজে ছাত্র ভর্তি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। |
|
মেদিনীপুর আর্ট কলেজ। —নিজস্ব চিত্র। |
কলেজের অধ্যক্ষ সুশান্ত ঘোষ বলেন, “জমি জট মিটিয়ে কলেজ যাতে চালু করা যায়, সে জন্য সর্বত্র চিঠি দিয়ে আবেদন জানিয়েছি। শিল্পীচক্রের নামে থাকা জমির লিজের মেয়াদ চলতি মাসের ৩১ তারিখে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। তারপর যাতে কলেজের নামে জমির লিজ দেওয়া হয়, সে জন্যও আবেদন জানিয়েছি।” কিন্তু আবেদনে সাড়া মিলবে কিনা, সংশয় থেকেই যাচ্ছে। কারণ, লিজের মেয়াদ শেষ হলে শিল্পীচক্র ফের নিজেদের নামেই জমির লিজ চেয়ে আবেদন জানাবে বলে জানিয়ে দিয়েছেন সংস্থার সম্পাদক অমিতাভবাবু। তাঁর কথায়, “আমাদের সংস্থার নামে জমি, বাড়ি। আমরাই কলেজ তৈরি করেছিলাম। অথচ, কলেজের গুটিকয় ব্যক্তি আমাদের সম্মান দিল না। ছাত্রদের উস্কানি দিয়ে আন্দোলন করাল। এখন যাঁরা কলেজ চালাচ্ছেন তাঁরা কী ভাবে চালাবেন বুঝুন। তবে আমরা শিল্পীচক্রের নামে ফের জমির লিজ চেয়ে আবেদন জানাব।” এই চাপানউতোর ও টানাপোড়েন চললে কলেজ যে উঠে যাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পদাধিকারবলে কলেজ পরিচালন সমিতির সভাপতি হলেন মেদিনীপুরের পুরপ্রধান প্রণব বসু। তাঁর বক্তব্য, “অনেকদিন ধরেই ওই কলেজে জটিলতা দেখা দিয়েছে। তখনও আমি চেয়ারম্যান ছিলাম। আমাকে ফের সমস্যার কথা জানালে চেষ্টা করে দেখব যাতে কলেজটি বাঁচিয়ে রাখা যায়।”
শিল্পীচক্রের জন্ম ১৯৭৮ সালে। মেদিনীপুর সিপাইবাজারে শিল্পীচক্রের একটি ভবনও তৈরি হয়। সেখানেই ২০০১ সালে মেদিনীপুর আর্ট কলেজের জন্ম। প্রথমে ছত্তীসগঢ়ের খয়রাগঢ় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন নিয়ে কলেজ চলছিল। ২০০৭ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় শর্তসাপেক্ষে অনুমোদন দেয়। কিন্তু জমি কলেজের নামে না থাকায় ২০০৯-১০ সালে রবীন্দ্রভারতী অনুমোদন বাতিল করে দেয়। ফের বুঝিয়ে পরের বছর অনুমোদন মেলে। কিন্তু ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে শর্তপূরণ না করতে পারায় অনুমোদন বাতিল হয়ে যায়। অনেক অনুরোধের পর পরের বছর অনুমোদন মিললেও চলতি বছরে আবারও অনুমোদন বাতিল করে দিয়েছেন রবীন্দ্রভারতী কর্তৃপক্ষ।
দুই মেদিনীপুর জেলার একমাত্র এই আর্ট কলেজে ২৫টি আসন রয়েছে। পেন্টিং ও অ্যাপ্লায়েড আর্ট নিয়ে পড়া যায় এখানে। ছাত্রদের দেওয়া টাকাতেই কলেজের শিক্ষক ও কর্মীদের মাইনে হত। কিন্তু বারবার অনুমোদন বাতিলের জেরে ছাত্রভর্তি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তার জেরে প্রায় ৬ মাস হল শিক্ষক ও কর্মীরা বেতন পাচ্ছেন না। অধ্যক্ষ বলেন, “যেটুকু টাকা রয়েছে তা দিয়ে বহু কষ্টে বিদ্যুৎ বিল, টেলিফোন বিল-সহ কিছু টাকা মেটানো হচ্ছে।” শিক্ষক সমীর বিশ্বাস, সুভাষ দাসদের কথায়, “বাড়ির টাকা খরচ করে পড়াতে আসি। আশা একটাই, নিশ্চয় কলেজ চালু হবে। কিন্তু এ ভাবে আর কতদিন টানতে পারব জানি না।”
কলেজে এখন নিয়মিত ক্লাসও হচ্ছে না। আর্ট কলেজের পড়ুয়া সুভাষ মাইতি, সম্পূর্ণা সিংহ, রাখি বন্দ্যোপাধ্যায়দের কথায়, “নিয়মিত ক্লাস হয় না। আমরাও আশঙ্কার মধ্যে দিন কাটাচ্ছি।” এই পরিস্থিতিতে কলেজের ভবিষ্যৎ কী? তা নিয়ে চাপানউতোর চলছেই। অধ্যক্ষের অভিযোগ, “কলেজে নানা ধরনের গরমিল চালাচ্ছিলেন সম্পাদক। এমনকী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম পর্যন্ত মানছিলেন না। কলেজের নামে পাঠানো সাংসদ তহবিলের টাকা তিনি সংস্থার সম্পাদক হিসাবে বেআইনি ভাবে খরচ করেছেন। এমন নানা গাফিলতির জন্যই বিতর্ক দেখা দেয়।” অমিতাভবাবুর পাল্টা অভিযোগ, “কলেজ কর্তৃপক্ষের নানা কাজে চূড়ান্ত গাফিলতি ছিল। আমি তার প্রতিবাদ করাতেই পরিকল্পনা করে আমাকে সরাল।”
গোটা ঘটনায় মর্মাহত শিল্পীচক্রের সহ-সম্পাদক উদয় পাল। তাঁর কথায়, “দু’পক্ষের মধ্যে কেবল কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি হচ্ছে। আমার মতে, উভয়পক্ষই যদি সহনশীল হয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে তাহলে জেলার গর্ব এই কলেজকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। আমি চাই উভয়পক্ষের সমর্থনে আর্ট কলেজ বেঁচে থাক। প্রয়োজনে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপও দাবি করব।” |
|
|
|
|
|