কলকাতা, দিল্লি, মুম্বই থেকে গ্রাম-গ্রামান্তরে মেয়েদের ভীত, সন্ত্রস্ত করে ধর্ষণের পরম্পরা চলছে। তারা একদল পুরুষের কাছে শুধুই শরীর। সাহচর্য, প্রেম, বন্ধুত্ব, স্নেহ কিছুই চাইবার নেই তাদের নারীর কাছে। তারা শুধু সঙ্কুচিত, অনিচ্ছুক, সন্ত্রস্ত এক— শরীরও নয়— শরীরের আধিপত্য চায়।
‘ধর্ষণ’ কোনও নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু পুরুষের ভোগ্য হলেই এখন ধর্ষিতার কাজ ফুরোচ্ছে না, একসঙ্গে বারো জন নিদেনপক্ষে পাঁচ জন ধর্ষণ না করলে সেটি ঠিক ‘ধর্ষণ’ হয়ে উঠছে না। আরও একটা পার্থক্য চোখে পড়ে। ধর্ষকদের বেপরোয়া ভাব। যখন তাদের পুলিশের গাড়িতে তোলা হচ্ছে বা আদালতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তাদের শরীরী ভাষা বুঝিয়ে দেয় যে, তাদের কোনও অপরাধবোধ নেই। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সেই শরীরী-ভাষা দেখে চমকে উঠি। এই বেপরোয়া ভাবটাকে ধর্ষণের চেয়ে কম ভয়ঙ্কর মনে হয় না। ঠিক এমনটা আগে ততটা দেখিনি, যা দেখছি গত কয়েক বছর ধরে।
কেন এমন হল? রাজনৈতিক চাপানউতোরে, প্রশাসনিক অকর্মণ্যতার প্রতিবাদ-মিছিলে যে সত্যগুলি উঠে আসে, তার চেয়ে আরও গভীরতর সত্যও হয়তো আছে। ‘রাজনৈতিক মদত’, ‘দোষীদের শাস্তি চাই’, এই দাবি নিশ্চয়ই মূল্যবান, কিন্তু তাতেও সেই সত্য উদ্ঘাটিত হয় না। উল্টো দিকে, পুলিশি রদবদল, তদন্তের নির্দেশ আর ‘দোষীদের অ্যারেস্ট করা হয়েছে’— এই সব আপ্তবাক্যে দায়িত্ব শেষ হয় না। সমস্যার বীজ আরও গভীরে। তার সন্ধান জরুরি। সন্ধান না জানলে প্রতিকার হবে কী করে?
নতুন অর্থনীতির হাওয়া যে সমাজজীবনেও ওলটপালট আনবে, এ তো জানা কথা। প্রশ্ন হল, সেই ঝড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য আমরা কি প্রস্তুত? আমাদের পুরনো খাঁচায় বিকল্প কম ছিল, তুলনামূলক ভাবে বাঁধা পথে হাঁটাও সহজ ছিল। কিন্তু নতুন অর্থনীতির খোলা বাজার ভরে গিয়েছে লোভনীয় বস্তুতে। এত লোভনীয় যে, মানুষের সঙ্গে বস্তুর সম্পর্কও গুলিয়ে দেয়। নতুন করে বুঝে নিতে হচ্ছে যে মানুষের জীবনে বস্তুর ঠিক কতখানি গুরুত্ব থাকা উচিত। একটি লোভনীয় বস্তুর মালিক হওয়ার জন্য ঠিক কী কী বিসর্জন দিতে পারি আমরা, তার হিসেবটা যেন গুলিয়ে গেছে। এই লোভনীয় বস্তুর সঙ্গে নারীশরীর একাকার হয়ে যায়। আসলে নারীর শরীর তো ভোগ্যপণ্যেরই এক বিস্তারে পরিণত হয়েছে। প্রযুক্তির বিস্ফার কেবল ঘরে ঘরে লাস্যময়ী বিজ্ঞাপনের নারীদের হাঁটা, তাকানো, কথা বলাই পৌঁছে দেয়নি, তাদের উন্মুক্ত শরীরের টানও পৌঁছে দিয়েছে। সাতপুরুষের অর্ধভুক্ত শরীরের ভার বহন করতে করতে কোটরগত চক্ষু মেলে কিশোরী মেয়েটি দেখে মাখনের মতো ত্বকের মহিমা আর কিশোরটি তার খড়ি ওঠা, কাজ করতে করতে শক্ত হয়ে যাওয়া আঙুল দিয়ে অন্তত এক বার সেই মহিমান্বিত ত্বক স্পর্শ করতে চায়। |
মোবাইলে মোবাইলে উন্মুক্ত নারীশরীর তাকে প্রকৃতিগত কারণেই ডাকে। সে ডাককে উত্তীর্ণ হওয়ার শিক্ষা তাকে দেওয়া হয়নি। তার ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে যে সংস্কৃতি চর্চা, সেখানেও তো কেবল হিংসা, সংস্কারের যুক্তিহীন আনুগত্য আর নারীকে দাবিয়ে রাখার কাহিনি। মূল ধারার সিনেমা আর সিরিয়ালে কোথাও কি যথার্থ সম্মান দিয়ে মেয়েদের দেখানো হয়? যত ব্যক্তিত্বময়ী বা প্রতিবাদী নারীই হোন না কেন, শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রাণভোমরা আশ্রয় নেয় সিঁদুর কৌটোয়। এর সঙ্গে আছে প্রতিনিয়ত নারীশরীরকে লাঞ্ছিত করার দৃশ্য। যৌন লাঞ্ছনার সঙ্গে ধর্ষণ প্রতিদিন মনোরঞ্জনের জন্য ব্যবহৃত হতে হতে এক ধরনের সামাজিক মান্যতা পেয়ে যায়। নিয়ম করে ভাবতে শেখানো হয়, আসলে নারীকে যৌন হেনস্তা করার মধ্যে এক ধরনের পৌরুষই কাজ করে।
বাইরের বাস্তবতায় পিছু হঠে যাওয়া, নিজের জায়গা খুঁজে না পাওয়া এক জন মানুষ যখন ছায়াচিত্রের এই কল্পবাস্তবতায় পা রাখে, তখন তার মনেও যে এমন আধিপত্য দেখানোর বাসনা জাগতে পারে, তা বোঝার জন্য মনোবিজ্ঞানের পাঠ নেওয়ার দরকার হয় না। ছায়াচিত্রের ছায়া-মেয়েটি তার হাতের নাগালে নেই, কিন্তু প্রতিদিন সামনের রাস্তা দিয়ে কলেজে যায় যে মেয়েটি, তাকে তো হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়! হোক না সে প্রতিবেশী। পুরনো সমাজকাঠামো সঞ্জাত মূল্যবোধ আর সম্পর্কের বিন্যাস এই ঝড়ে বিধ্বস্ত, বিপন্ন। অথচ নতুন কোনও সম্পর্ক বিন্যাসও তৈরি হয়নি। ‘নো-ম্যানস ল্যান্ড’-এ দিশাহীন দাঁড়িয়ে আছি। ‘সময়’ শিখিয়েছে প্রতিবেশী মেয়েটিকে নারীশরীর ভাবতে। অন্যের শরীর স্পর্শ করার আগে যে অনুমতির প্রয়োজন হয়, সেটি শেখানো হয়নি।
শিক্ষা নেই, জীবিকার নিশ্চয়তা নেই, নির্মম অর্থনীতি আর বিবেকহীন রাজনীতির সামনে প্রতিরোধহীন উদ্বৃত্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। কাজ রাজনৈতিক দলের ঝান্ডা বওয়া, প্রশ্নহীন আনুগত্যে ওপরতলার আদেশ মেনে নেওয়া। প্রয়োজন মতো মরা ও মারা। আর তাদের তুষ্ট করার জন্য কাঁচা টাকার প্রবাহ বহমান রাখা রাজনৈতিক দলের কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রামে গ্রামে মফস্সলের অলিতে গলিতে খুলেছে নীল ছবির ব্যবসা, দেশি মদের ঠেক বসাতে দেওয়া হয়েছে ঢালাও সম্মতি। বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি বলে যে সব গ্রামের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা ছেড়ে দেয়, সেখানে জেনারেটার লাগিয়ে নীল ছবি চলে। কামদুনির ঘটনার পর গ্রামবাসীরা কেবল রাস্তার আলো, ঠিকঠাক যানবাহন আর চোলাইয়ের ঠেক ভাঙার আবেদন জানিয়েছিলেন। যাতে আর একটা এমন ঘটনা না ঘটে। সেখানে দিনের বেলাও অল্পবয়সি ছেলেরা মদ্যপ হয়ে থাকে। প্রশাসনিক তৎপরতায় একটি মদের ঠেক বা নীল ছবির প্রদর্শনী বন্ধ হয়েছে? বরং সেই চাওয়ার আন্দোলনকে ভাঙার জন্য রাজনৈতিক, প্রশাসনিক সব রকমের তৎপরতা দেখেছি আমরা।
মৃত্যুর আগে মধ্যমগ্রামের কিশোরী মেয়েটি তার নারীজন্মকে ধিক্কার দিয়ে গোটা সমাজকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গিয়েছে। সে প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দায় আমরা এড়াতে পারি না। |