প্রবন্ধ ১...
পথের বিচার না করলে বিপদ হতে পারে
ই কথা বললে বড় একটা ভুল হবে না যে, সাধারণ ভাবে বাঙালি ভদ্রলোকি বুদ্ধিজীবী মন গাঁধী-ভাবনাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। ব্যক্তি-গাঁধী নিশ্চয় শ্রদ্ধার্ঘ্য পেয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ও বুদ্ধদেব বসুর শ্রদ্ধাঞ্জলি তো স্মরণীয় সাহিত্যকর্ম। চরকা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও গাঁধীর তীক্ষ্ণ পত্র-বিতর্কও মনে পড়ে, গাঁধীর উপর আঁকা নন্দলালের পোস্টারও ভোলার নয়। তবে এই সব ছাপিয়ে ত্রিপুরি কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্র বসুর বিরুদ্ধে গাঁধীর উক্তি, সন্ত্রাসবাদীদের ক্রিয়াকর্ম, দেশভাগ ও তথাকথিত মুসলমান তোষণের রাজনীতির প্রেক্ষিতে রক্ষণশীল মোহিতলাল মজুমদার থেকে শ্রেণিসমঝোতার বিরোধী বামপন্থীদের সমালোচনা গাঁধী-ভাবনাকে আদৌ সতর্ক ও সশ্রদ্ধ অনুধ্যানের বিষয় বলে মনে করেনি। স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গে বা ভারতে জনমানসে কংগ্রেসি শাসকদের অন্যতম অভিজ্ঞান ছিল সেই গাঁধী-টুপি, দুর্নীতি ও অসততার তীর্যক প্রতীক। সময়ের গতিতে নকশালবাড়ি আন্দোলনের সময় সুপ্রকাশ রায়ের পুনর্মুদ্রিত গাঁধী-জীবনী ও ‘দেশব্রতী’র পাতায় সরোজ দত্ত তথা শশাঙ্কের অসহিষ্ণু ও উচ্চকিত গাঁধী সমালোচনা আমাদের কালের ছাত্রজীবনকে আচ্ছন্ন করেছিল। ১৯৭০ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্রিকায় ও সেমিনারে গাঁধীর প্রতি অসুস্থ ঋত্বিক ঘটকের বাছাই করা বিশেষণটি কী ধরনের বাহবা তথা তাৎক্ষণিক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল, তা আজও চকিতে মনে পড়ে।
গাঁধীর মতো জটিল ব্যক্তিত্বের প্রতি ভক্তির বা বিক্ষোভের আতিশয্যের প্রকাশ বিচিত্র নয়, একটি তো অপরটির অন্য পিঠ। কিন্তু যেটা ভাবায়, সেটা হল, এত ভক্তি ও বিদ্বেষের মধ্যে নিছক গাঁধী-ভাবনা নিয়ে এ কালের বাঙালি মানসে কোনও সংহত যুক্তিসিদ্ধ প্রতর্ক গড়ে ওঠেনি, গাঁধীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিশ্লেষণ ও খতিয়ানেই যেন সব আলোচনা থেমে গেছে। গত শতকের শেষে অম্লান দত্ত বা পান্নালাল দাশগুপ্ত যেন একক, তাঁদের গাঁধী-চিন্তা নিয়ে পক্ষাপক্ষ কোনও গভীর বিচার চোখে পড়েনি, এমনকী গাঁধীর অর্থনৈতিক চিন্তা নিয়ে অজিত দাশগুপ্তের সাবলীল পেশাদারি বইটিও সমকালীন কোনও সাড়া জাগায়নি। ঠিক এই অবস্থায় অভীককুমার দে সংকলিত ও দুই খণ্ডে নিরাভরণ আকারে প্রকাশিত গাঁধীর বিষয়ে নির্মলকুমার বসুর যাবতীয় রচনাসংগ্রহ দেখাল যে, স্বাধীনতা-উত্তর এপার বাংলায় ভক্তি বা বিদ্বেষরহিত ভাবে গাঁধী-ভাবনা নিয়ে বাদানুবাদ কী ভাবে সক্রিয় ছিল, স্বল্প পরিসরে কিছু বুদ্ধিজীবী অন্তত মনন ও চিন্তনের স্তরে কী যুক্তিতে সেই প্রতর্ককে অন্তত দুই দশক ধরে সজীব রেখেছিলেন।
নির্মলকুমার বসু স্বনামধন্য বাঙালি মেধাজীবী, বিখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ ও নোয়াখালিতে গাঁধীর প্রধান পরিকর। ওই পর্বের গাঁধী-জীবনীর জন্য তাঁর স্মৃতিকথন ও দিনচর্যার বিবরণ অপরিহার্য ঐতিহাসিক আকর, বহু-ব্যবহৃত ও বহু-আলোচিত। কিন্তু এই বৃহদায়তন সংকলন খণ্ড দু’টি দেখায় যে, ওই রচনাগুলিকে ছাপিয়ে অজস্র অণুপ্রবন্ধ, পত্র-বিতর্ক ও তাৎক্ষণিক সমস্যা নিয়ে কথোপকথন বাংলা ভাষায় গাঁধী-ভাবনার নানা প্রতর্ককে জারিয়ে দিয়েছিল।

গাঁধীজির সঙ্গে নির্মলকুমার (ডান দিকে)। সঙ্গে শরৎচন্দ্র বসু। নোয়াখালি, ১৯৪৬-৪৭।
স্বঘোষণা অনুযায়ী নির্মলকুমার গাঁধী-অনুরাগী, ভক্ত নন। বিজ্ঞানসাধনাই তাঁর স্বধর্ম, ঐহিক সত্য অনুসন্ধানেই তিনি আগ্রহী, পরমার্থ বিচারে তিনি অনাসক্ত; যুক্তি ও যাচাই ছাড়া তিনি কোনও মতকেই মানতে রাজি নন। স্বধর্মে স্থিত হয়েই নির্মলকুমার গাঁধী অনুধ্যান করে গেছেন, তাঁর চর্চায় গাঁধীর আপত্তিও ছিল না, বরং উৎসাহই ছিল। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক বৈজ্ঞানিকের আত্মউপস্থাপনায় পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালের দায়স্বীকারও ছিল। নিজে বুঝলে হবে না, অন্বেষণের ফলও নানা রচনাগোত্রে সহজ ভাষায়, গণপরিসরে হাজির করতে হবে। প্রবুদ্ধ গণবিতর্ক গণতন্ত্রের শর্ত, সেই গণবিতর্ক নাগরিক সমাজে চাগিয়ে ও চারিয়ে দেবার দায় সচেতন বুদ্ধিজীবীর। এই দায় মেটাবার তাগিদেই গাঁধী-ভাবনার চরিত্রবিচারে কুমারাপ্পা, বিনোবা ভাবে, পান্নালাল দাশগুপ্ত ও বিমলচন্দ্র সিংহদের সঙ্গে তিনি বিতর্কে লিপ্ত হয়েছেন, সাম্যবাদীদের সঙ্গে গাঁধীবাদের তুলনা টেনে শান্ত ভাবে নিজের সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন।
বিতর্কের আশু প্রেক্ষিত ছিল স্বাধীন ভারতীয় রাষ্ট্র গঠনের নানা প্রকল্পে, সংসদীয় ও যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের নানা দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের মধ্যে গাঁধীর মতাদর্শের কার্যকর প্রাসঙ্গিকতা খোঁজা। কিন্তু ‘হিন্দ স্বরাজ’ (১৯১০) ছাড়া তো গাঁধীর নিজস্ব কোনও পূর্ণাবয়ব মতগ্রন্থ নেই, গোপালকৃষ্ণ গোখলে থেকে জওহরলাল নেহরু কেউই পুস্তিকাটিকে খুব একটা নম্বর দেননি। নানা প্রকীর্ণ লেখা ও জীবনচর্যার নানা অভিজ্ঞতায় যেন গাঁধীর মতাদর্শ ছড়িয়ে আছে, কোনও তাত্ত্বিক সুসঙ্গতির দাবি তিনি করেননি। ‘স্বরাজ’, ‘সর্বোদয়’, ‘সত্যাগ্রহ’, এই সব ভেসে বেড়ানো বহুশ্রুত শব্দের অভিধা, তাৎপর্য ও ব্যঞ্জনা কী হতে পারত বা পারে, এই নিয়ে স্বাধীনতা-উত্তর গাঁধীবাদী তাত্ত্বিকদের মতভেদগুলি নজর কাড়ে।
নির্মলকুমারের প্রাতিষ্ঠানিক সহকর্মী অতীন্দ্রনাথ বসু ‘নৈরাজ্যবাদ’ বলে ঐতিহাসিক সমীক্ষাগ্রন্থে দেখিয়েছিলেন, কী ভাবে গাঁধী-চিন্তার ধারণা-সত্য তলস্তয়, থোরো ও রাসকিনের নৈরাজ্যবাদী রচনায় উপ্ত ছিল। নৈরাজ্যবাদ আদৌ কোনও বিশৃঙ্খলার তত্ত্ব নয়, বরং নানা ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রশূন্য  সমাজ গড়ে তোলার আদর্শ। অতীন্দ্রনাথের মতে তলস্তয়, রাসকিন ও থোরোর চিন্তায় উদ্ভাসিত ‘নব নৈরাজ্যবাদ’-এর অন্যতম সেরা প্রবক্তা গাঁধী। যেন সমগোত্রীয় ভাবেই উদ্বুদ্ধ হয়ে কুমারাপ্পা বা ধীরেন মজুমদাররা রাষ্ট্রশক্তি ও বাজারের খেলার বাইরে ছোট ছোট স্ব-উদ্যোগে সামাজিক পুনর্গঠনের প্রকল্পের কথা ভাবতেন, গাঁধীর বিকেন্দ্রীকরণ ও স্বরাজসাধনার যোগ নৈরাজ্যবাদের ধারণাতেই সম্ভব বলে তাঁদের আস্থা ছিল। ‘শনিবারের চিঠি’র পাতায় পান্নালাল দাশগুপ্তের সঙ্গে সুতীক্ষ্ণ বিতর্কে নির্মলকুমার জানান যে, তাত্ত্বিক ভাবে গাঁধীর নৈরাজ্যবাদকে তিনি অস্বীকার করেন না, কিন্তু সব কিছুর প্রস্তুতিপর্ব আছে। রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা ও আমলাতন্ত্রের প্রতি সন্দেহ নিয়েও তাঁর ধারণা ছিল যে, দেশব্যাপী গঠনকর্মের জন্য তো এক বড় সাংগঠনিক সূত্র দরকার, ‘বর্তমানে ভারতের রাষ্ট্রগুলিকে বিকেন্দ্রীকরণের ব্যাপারে সহায় হবার জন্য জ্ঞানীর মতো দৃঢ় ভাবে আকর্ষণের রজ্জু প্রয়োগ করতে হবে।’ তিনি সাফসুতরো ঘোষণা করেন, ‘শুধু সংগ্রামে বিশ্বাসী আমি নই, সত্যাগ্রহ সংগ্রাম হলেও নয়।’ গাঁধী-ভাবনার নৈরাজ্যবাদী কল্পভাবুক পাঠ এবং বুদ্ধিনিষ্ঠ ও প্রায়োগিক পাঠের টানাপড়েনের ইতিবৃত্ত দেশজ রাজনীতি চিন্তনের এক বিস্মৃতপ্রায় অধ্যায়।
পরিব্রাজক নির্মলকুমারের আলোচনায় একটি দৈনন্দিন পরিচিত চরিত্র উঠে আসে, নাম নন্তুবিহারী নস্কর, ভাবে-ভোলা আম আদমি, চারিত্রিক সততা ও পরের উপকার করার আকুল তাগিদে একনিষ্ঠ সে সত্যাগ্রহী কর্মী হয়েছিল, বার বার জেলে গিয়েছিল। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে পরোপকারী নন্তুবাবু সবার মুশকিল আসান, পারমিট পাওয়া থেকে বদলি আটকানো বা করার জন্য সব আম আদমির সুরাহা সে করেই থাকে। পকেট ভারী করা তার উদ্দেশ্য নয়, চার পাশের আম আদমির উপকার করে দেশের ভাল করাই তার ইচ্ছা। নানা নিদর্শন দিয়ে নির্মলকুমার দেখিয়েছেন যে, ব্যক্তিগত ভাবে নির্লোভ নন্তুকুমারের কাজ কী ভাবে দুর্নীতি ও ক্ষমতার সব উৎসকে তৃণমূল স্তরে প্রোথিত করেছিল, প্রায়োগিকতার জিগিরে দেশ গঠনের ভিত্তিকে সব সময় কুরে কুরে খাচ্ছিল। ব্যস্তসমস্ত সৎ নন্তু প্রশ্নের উত্তরে বলেছিল, ‘কী যে করছি দাদা, তা নিজেই জানি না। কিন্তু নিশ্বাস ফেলার সময় নেই।’ করুণ ছবি, গত ত্রিশ বছরের গ্রামবাংলায়, বা আজও, এই ধরনের ক্যাডার বা কর্মী তো একান্ত দুর্লভ নয়।
নিদর্শনের ছলে বলা নির্মলকুমারের গল্পটি একটি সহজ অথচ গভীর ভাবনাকে তুলে ধরে। ব্যক্তি-সদিচ্ছা বা সততা, প্রায়োগিক দক্ষতা বা সাংগঠনিক কুশলতা যথেষ্ট নয়, আদর্শ সম্বন্ধে সচেতনতা ও তদনুযায়ী পদ্ধতির চরিত্র নিয়ে বিচারের সাযুজ্য দরকার। এই দুইয়ের ভারসাম্য কোথায় কী ভাবে রাখা যাবে সরকারি প্রশাসন, সমাজজীবন থেকে দিনচর্যায়, তাই নিয়েই সে দিন গাঁধীবাদীরা বিতর্ক করেছিলেন। ভ্রষ্টাচার নিয়ত থাকে, নানা ভাবে থাকে, সব ভ্রষ্টাচার তো সমাজের নানা স্তরে ভ্রষ্টাচার বলে গণ্যও হয় না এই কথাগুলোর নানা উদাহরণ সেই সময়কার গাঁধীবাদী বিতর্কে ছড়িয়ে আছে। ভ্রষ্টাচারকে চেনা ও জানার জন্যও আত্মশিক্ষা দরকার। সব দেশের রাজনীতিতে তেং সিয়াও পিং থেকে যোগেন্দ্র যাদবের মতো চিন্তকদের জোরদার উপস্থিতি আছে। মহৎ উদ্দেশ্য সিদ্ধি করতে হলে অত পথের বাছাই করা চলবে না, আশু কার্যকারিতাই বিচার্য এই ধারণাই গোলকায়নের সব স্তরে বড় বলবতী। গাঁধী-ভাবনার প্রতর্কেও গণতান্ত্রিক মতাদর্শের কার্যকারিতা বার বার আলোচিত হয়েছে, নির্মলকুমার তো মাঝে মাঝেই গাঁধী-কথিত ‘তাবিজ’ বা ‘ট্যালিসমান’-এর কথা বলেছেন। ওই বিতর্কে দেখা যায় যে, আদর্শের সম্যক ধারণার অভাবে, প্রায়োগিক ত্রুটিতে, বা দুটির সাযুজ্যের অভাবে সাত মণ তেল পুড়লেও রাধাটি আর নাচেন না। তেলা মাথাতেই তেল ঢালা হয়।
একেবারে হাল আমলের গাঁধীগিরির রাজনীতিতে সংসদীয় গণতান্ত্রিক প্রশাসনকে দুর্নীতির কলুষমুক্ত করতে শহুরে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত থেকে গরিব অটো-রিকশাওয়ালা সবাই উদ্বুদ্ধ, অর্জুনের তিরন্দাজির লক্ষ্যে যেন দুর্নীতিই মাছের চোখ, ছিলে টানলেই কেল্লা ফতে। ঠিক এমনি সময়ে দুর্বল চিত্তে শঙ্কা জাগে। বৃহত্তর আদর্শরহিত নিখাদ ভাল করার সদিচ্ছাও আম ডেমোক্রেসিতে সিদ্ধ যে-কোনও পদ্ধতিকে আর একটি ভ্রষ্টাচারে রূপান্তরিত করতে পারে, গাঁধী-ভাবনা নিয়ে বাংলা ভাষায় উচ্চারিত প্রায় ভুলে যাওয়া এই প্রতর্কের সমাহারটি সেই সতর্কবাণীকে আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সব প্রয়োগের নিহিত আদর্শ নিয়ে থমকাতে, ভাবতে, প্রশ্ন করতে বলে।

মহাত্মা গাঁধী, নির্মলকুমার বসু। অভীককুমার দে সম্পাদিত ও সংকলিত, প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড। পুনশ্চ


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.