|
|
|
|
|
|
সিইও-র টেবিল থেকে |
লগ্নি করুন দীর্ঘকালীন বহু-সম্পদ তহবিলে |
অ্যাক্সিস মিউচুয়াল ফান্ডের সিইও এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর চন্দ্রেশ নিগম-এর সঙ্গে আলাপচারিতায় সুপর্ণ পাঠক |
সেবির সঙ্গে একটা বিরোধের জায়গা তৈরি হয়েছে বিভিন্ন মিউচুয়াল ফান্ড সংস্থার। এই বিরোধটা হাইব্রিড ফান্ড নিয়ে। আপনাদের কেউ কেউ চাইছেন, যাতে বাজারের ওঠা-নামার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বন্ড, শেয়ার বা অন্য সম্পদের মধ্যে লগ্নি ঘোরানো যায়। যেমন শেয়ারের দাম কমলে, শেয়ার থেকে সরিয়ে বন্ডে। তবে আগে থেকে ঠিক করে দেওয়া অনুপাতে নয়। ফান্ড ম্যানেজার যতটা ঠিক মনে করবেন ততটা। কিন্তু সেবি তাতে রাজি নয়। সেবি চায় আগে থেকে এই অনুপাতটা ঠিক থাকবে।
দেখুন শিল্প মনে করছে, এই ধরনের তহবিলে কোথায়, কতটা এবং কখন লগ্নি করতে হবে, সেটা একজন ফান্ড ম্যানেজারই ভাল বুঝবে। কিন্তু সেবি চাইছে, কী ভাবে এই লগ্নি বদল হবে, তা আগে থাকতে জানতে। সেবি চাইছে একটা তহবিলের বিনিয়োগের ধাঁচ কী ভাবে এবং কোন যুক্তিতে বদলাবে সেটা জানতে। এবং আরও চাইছে যে, এই বদল যে আরও লাভের মুখ দেখাবে তার প্রমাণ। উদাহরণ হিসাবে বলি, এখন যে তহবিলগুলো আছে, তাতে বলা থাকে হয়ত শেয়ারে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বিনিয়োগ করা হবে, বন্ডে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। একজন ফান্ড ম্যানেজার তহবিলের লগ্নির ধাঁচ ওই ১০ শতাংশের মধ্যে অদল বদল করতে পারেন। কিন্তু শিল্পের চাহিদা হল আরও বেশি বদলের অধিকার। এই নিয়ে সেবির সঙ্গে আলোচনা চলছে। সেবি বুঝতে চাইছে, এর মধ্যে বিনিয়োগকারীর ঝুঁকির অঙ্কটা কোথায় দাঁড়াচ্ছে। আমি যতটা বুঝেছি, এই বিরোধটা এখানেই।
• আপনাদের, মানে শিল্পের যুক্তিটা যদি আর একটু পরিষ্কার করেন।
সাধারণ বিনিয়োগকারী বুঝতে পারেন না, কখন কোন সঞ্চয় প্রকল্প থেকে টাকা গুটিয়ে অন্য প্রকল্পে ঢাললে তাঁর লাভ বেশি হবে। এঁরা কিন্তু আমাদের উপরেই নির্ভর করে থাকেন ঠিক সিদ্ধান্তের জন্য। দেখুন, যেখানেই বিনিয়োগ করবেন, সেখানেই ঝুঁকি থাকবে। কথার কথা বলছি, আজ হয়তো শেয়ার লাভজনক, কিন্তু নির্মাণশিল্প নয়। তো আজ লাভের জন্য আপনি শেয়ারে টাকা রাখবেন। কিন্তু কাল পাল্লা উল্টো দিকে ঝুঁকলে, তখন শেয়ার থেকে টাকা সরিয়ে নির্মাণ শিল্পে ঢালতে হবে। কিন্তু এই বদল ঘটাতে হবে এমন সময়ে, যখন লগ্নি করলে আপনার লাভ আছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীর পক্ষে সিদ্ধান্তটা নেওয়া সহজ নয় বলেই মাল্টি অ্যাসেট ফান্ড বা বহু-সম্পদ নির্ভর তহবিলে তাঁরা বিনিয়োগ করেন। আর তাঁদের হয়ে যাঁরা এই বিষয়টা বোঝেন, তাঁরা এই বিনিয়োগ বদলের সিদ্ধান্তটা নেন।
কিন্তু তহবিলের উপর এই কর্তৃত্ব যদি ম্যানেজারের না-থাকে তাহলে এই সুবিধাটা সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ভোগ করতে পারবেন না।
দেখুন, যাঁরা আর্থিক ভাবে উচ্চ কোটির মানুষ, পরিভাষায় যাঁদের বলা হয় হাই নেটওয়ার্থ ইন্ডিভিজুয়াল, তাঁরা এই কাজের জন্য বিশেষজ্ঞ সংস্থার সাহায্য নিয়ে থাকেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ তো এটা পারবেন না। তাঁদের তো মিউচুয়াল ফান্ডের উপরেই নির্ভর করে থাকতে হবে। শিল্প চাইছে এমন তহবিল বাজারে ছাড়তে, যাতে বিনিয়োগ করে সাধারণ মানুষও এই সুযোগ পান।
• এটা তো গেল প্রেক্ষাপট। বাকিটা?
দেখুন এটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, সেবি-র একটা বড় অবদান রয়েছে সাধারণের লগ্নিকে আরও বেশি নিশ্চয়তা দেওয়ার ব্যাপারে। এ ব্যাপারটা কিন্তু কেউই অস্বীকার করতে পারবে না।
কিন্তু যুক্তির উল্টো দিকটাও আমাদের দেখতে হবে। আমরা সবাই বিনিয়োগকারীর শিক্ষা নিয়ে কথা বলছি। এবং এটা জরুরি। পাশাপাশি এটাও সত্যি যে, কেউই বাজারের ওঠা-নামার সঙ্গে যে-ঝুঁকি জড়িয়ে রয়েছে তা নিয়ে স্বস্তিতে থাকেন না। আমরা যদি দীর্ঘকালীন সঞ্চয়ের কথা বলি, তা হলে আমাদের লগ্নিকারীকে একটা স্বস্তির জায়গাও দিতে হবে। সব বিনিয়োগেই ঝুঁকি আছে, এটা বুঝেও আমরা সবাই চাইব কম ঝুঁকিতে বেশি লাভ করতে।
এই জায়গাতেই মিউচুয়াল ফান্ডের প্রয়োজনীয়তা। দীর্ঘকালীন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এই স্বস্তির জায়গাটা তৈরি করতে পারে বহু-সম্পদ নির্ভর তহবিল, যাতে ফান্ড ম্যানেজারের কর্তৃত্ব প্রায় সার্বিক। এটা যদি করা যায়, তা হলে সবারই লাভ হবে।
মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে আর একটা দিক আমাদের মাথায় রাখতে হবে। সেটা হল, লগ্নিকারী, তহবিল বিক্রেতা আর তহবিল সংস্থা এই তিন পক্ষের মধ্যে চাহিদার সামঞ্জস্য। এটা তখনই সম্ভব, যখন লাভ আর তহবিল পরিচালনার খরচের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকে।
• একটু বুঝিয়ে বলুন।
দেখুন, বিনিয়োগকারী যদি খুব কম সময়ের কথা ভেবে বিনিয়োগ করেন, তা হলে সেই তহবিল পরিচালনার খরচ বেড়ে যায়। আবার কম দিনের জন্য বিনিয়োগ করলে বিক্রেতার তাতে খুব একটা লাভ থাকে না। তখন বাজারে একটা প্রবণতা তৈরি হয়, ক্রেতাকে ভুল বোঝানোর। এমন তহবিল বিক্রি করার চেষ্টা চলে, যাতে বিনিয়োগ করলে ক্রেতার থেকেও বিক্রেতার লাভ বেশি। গোটা শিল্প জুড়েই তৈরি হয় এমন এক আবহের যা ক্রেতার স্বার্থবিরোধী।
আপনার মনে আছে, সম্প্রতি ঋণপত্রে বিপুল বিনিয়োগ হয়েছিল। এর ফলে যে-ভাবে নানা তহবিল তৈরি হয়েছে, সেগুলো খারাপ নয়, কিন্তু তা সাধারণ বিনিয়োগকারীর জন্য কতটা উপযোগী, তা নিয়ে এখন নানা আলোচনা চলছে।
দেখুন, গোটা বিশ্বে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রবণতাই হচ্ছে, গত ছ’মাসে কোনও প্রকল্পে কত লাভ হয়েছে, সেটা দেখে টাকা ঢালা। যদিও আমরা সবাই জানি যে, বিগত দিনের অঙ্ক নিশ্চয় প্রয়োজনীয়, কিন্তু তার উপর নির্ভর করে আগামী দিনের লাভের অঙ্ক কষা ঠিক নয়। বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন এইখানেই। কিন্তু প্রয়োজন হচ্ছে দীর্ঘকালীন বিনিয়োগের। এটা হলে সবারই লাভ। শিল্প অনেক কম খরচে ভাল তহবিল তৈরি করতে পারে। বিনিয়োগকারী নিজেও স্বস্তিতে থাকবেন তাঁর লগ্নি নিয়ে। কারণ দীর্ঘকালীন বিনিয়োগে ঝুঁকি কমিয়ে লাভ বাড়ানো সহজ। ক্রেতার ভুল বোঝার সম্ভাবনাও কমবে। প্রতি দু’সপ্তাহে তাঁকে তহবিল বিক্রেতার কাছে দৌড়তে হবে না।
দীর্ঘ মেয়াদে টাকা ঢাললে, লগ্নিকারীর বিনিয়োগ পিছু লাভের অঙ্ক অনেক বেশি হয়, অনেক কম খরচে। কারণ, ফান্ড ম্যানেজার জানেন, তাঁর কাছে আগামী নির্দিষ্ট কিছু দিনের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ থাকবে বিনিয়োগের জন্য। ফলে তাঁর পক্ষে তহবিলের কমা-বাড়া নিয়ে চিন্তা না-করে শুধুই বিনিয়োগ থেকে কী ভাবে লাভ বাড়ানো যায়, সেই অঙ্কটুকুই করতে হয়। কিন্তু তাঁর তহবিলও যদি ওঠা-নামা করে, তা হলে তাঁকে একাধিক ঝুঁকির মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে হয়। এতে তহবিলের লাভ কমে, খরচ বাড়ে, আর ক্ষতি হয় সবার।
দীর্ঘ মেয়াদি লগ্নিতে অর্থনীতিরও লাভ। এ দেশে দীর্ঘকালীন পুনর্বিনিয়োগযোগ্য সঞ্চয় প্রয়োজন, কিন্তু তার অভাব রয়েছে। ফলে এতে লাভ সবারই। সরকারও এটা চাইছে।
• আপনারা ‘স্মল ক্যাপ’ তহবিল ছেড়েছেন সম্প্রতি। কিন্তু যে ক’টা তহবিল বাজারে আছে, তাদের মধ্যে মাত্র কয়েকটিই ভাল করছে।
দেখুন সম্পদ তৈরি হয় একটা সংস্থার সাফল্যের জন্য। শেয়ারের দামে তার প্রতিফলন হয়। আমরা বলছি, সম্পদ শুধু সেই সংস্থাই তৈরি করে না, যাদের শেয়ারের দাম বেশি। আজ যাদের শেয়ারের দাম কম, তারাও কিন্তু সম্পদ তৈরি করে অগ্রগণ্য হয়। আমরা মনে করি, আমাদের সেই দক্ষতা আছে, যা দিয়ে আমরা বুঝতে পারি, কী ধরনের সংস্থা আজ ছোট থাকলেও আগামী দিনে বড় হবে।
এই তহবিল তৈরি হয়েছে সেই দর্শনের ভিত্তিতেই। এই তহবিল থেকে নির্দিষ্ট সময়ের আগে টাকা তোলা যাবে না। এটা করাই হয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীর দীর্ঘকালীন স্বার্থের কথা মাথায় রেখে। কারণ, বাজার পড়লেই সাধারণ মানুষ টাকা তুলে নিতে চান। তাতে তহবিলের ঝুঁকিই শুধু বাড়ে না, বিনিয়োগকারীর লাভের সুযোগও কমে যায়। যেটা আমি প্রথমেই বলেছি।
এতে সুবিধা হল, তহবিলে টাকা এল, কিন্তু বাজার হয়তো আজ সুবিধার নয়, সে ক্ষেত্রে, তহবিল পরিচালক সময় বুঝে বিনিয়োগকে ছড়িয়ে দিতে পারেন। অনেক নিশ্চিন্তে অপেক্ষা করতে পারেন ভাল সময়ের জন্য। যাতে রিটার্ন ভাল মেলে। |
|
|
|
|
|