কন্যা ভ্রূণ হত্যা ঠেকানো না গেলে সমাজে বিপর্যয় নেমে আসবে। এর ফলে নারীদের উপর অত্যাচারের ঘটনা আরও বাড়বে। এমনই মত উঠে এল ‘কন্যা সন্তান বাঁচাও’ শীর্ষক এক কর্মশালায়। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা স্বাস্থ্য দফতরের উদ্যোগে মঙ্গলবার মেদিনীপুর শহরের শহিদ ক্ষুদিরাম পরিকল্পনা ভবনের সভাঘরে এই কর্মশালার আয়োজন করা হয়। কর্মশালায় এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত অরুন্ধতী চক্রবর্তী বলেন, “লিঙ্গ অনুপাত কমে যাওয়ার ফলে নারীদের উপর অত্যাচার আরও বাড়বে। নারী পাচার বেড়ে যাবে। মেয়েদের লড়াই করার ক্ষমতা কমে যাবে।” এই পরিস্থিতিতে কন্যা ভ্রূণ হত্যার প্রতিরোধে সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বানও জানান অরুন্ধতীদেবী। তাঁর কথায়, “ছোটবেলা থেকে মেয়েদের শিক্ষা দিতে হবে যে, তারাও ছেলেদের থেকে কোনও অংশে কম নয়। এ নিয়ে সর্বত্র সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।” স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কাজ করে ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) বাসব বন্দ্যোপাধ্যায়, জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরীশচন্দ্র বেরা, আইএমএ’র সদস্য, মেদিনীপুর মেডিক্যালের চিকিৎসক-সহ বিভিন্ন ব্লকের বিএমওএইচরা। |
কন্যা ভ্রূণ হত্যার বিভিন্ন দিক নিয়ে কর্মশালায় আলোচনা হয়। পুরুষ-মহিলা অনুপাত কমে যাওয়া নিয়ে অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কর্মশালায় উপস্থিত বক্তাদের মতে, গোটা দেশেই কন্যা ভ্রূণ হত্যা বেড়ে চলেছে। ছোট থেকেই সমাজ এমন ভাবে ভাবতে শেখায় যে বেশিরভাগ মেয়েই ছেলের মা হওয়ার স্বপ্ন দেখে। ছেলের মা হতে পারলে শ্বশুরবাড়িতে কদর বাড়বে, পরিবারে রোজগেরে সদস্য হবে। কিন্তু এই প্রবণতা চলতে থাকলে আমরা আর মা, বোন, দিদি পাব না। জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, এখন গোটা দেশে প্রতি এক হাজার পুরুষপিছু মহিলার সংখ্যা ৯৪০। এ রাজ্যে ৯৪৭। আর পশ্চিম মেদিনীপুরে সংখ্যাটা ৯৬০। ঠিক কী হারে কমছে কন্যার সংখ্যা? ১৯৬১ সালে গোটা দেশে ১ থেকে ৬ বছর বয়সী প্রতি এক হাজার পুত্র সন্তানপিছু কন্যা সন্তানের সংখ্যা ছিল ৯৭৬। আর ৫০ বছর পর ২০১১ সালে ওই সংখ্যাটা কমে হয়েছে ৯১৪। অন্য দিকে, ’৬১ সালে এ রাজ্যে ১ থেকে ৬ বছর বয়সী প্রতি এক হাজার পুত্র সন্তানপিছু কন্যা সন্তানের সংখ্যা ছিল ১০০৮। আর ৫০ বছর পর ২০১১ সালে ওই সংখ্যাটা কমে হয়েছে ৯৫০।
কর্মশালায় জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক কৌশিক নন্দী বলেন, “এটা সামাজিক এবং মানসিক সমস্যা। আমাদের সকলের কাছে এটা খুব লজ্জার বিষয় যে, ২০১৪ সালে দাঁড়িয়েও এরকম একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে হচ্ছে।” জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের বক্তব্য, “আমাদের রাজ্যে কন্যাশ্রী প্রকল্প চালু হয়েছে। এত ভাল প্রকল্প আগে ছিল না। কন্যা ভ্রূণ হত্যার প্রতিরোধে আলোচনার পাশাপাশি গ্রামে গ্রামে ব্যাপক প্রচার করতে হবে।” হরিয়ানা, দিল্লি, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে মেয়েদের সংখ্যা কমছে। অন্য দিকে, কেরলে কিন্তু এখনও প্রতি এক হাজার পুরুষপিছু মহিলার সংখ্যা ১০৭৮। কর্মশালায় মেদিনীপুর মেডিক্যালের চিকিৎসক কিংশুক বসু বলেন, “কেরল পারলে আমরা পারব না কেন? আমাদের দুর্বলতা কোথায়? এই সামাজিক সমস্যা দূর করতে সর্বত্র সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।”
কন্যা ভ্রূণ হত্যা রোধে অনেকে জেলার ইউএসজি ক্লিনিকগুলোতে নিয়মিত পরিদর্শন করার উপরও জোর দেন বক্তারা। তাঁদের মতে, নিয়মিত পরিদর্শন হলে জন্মের আগে লিঙ্গ নির্ধারণ কমবে। লিঙ্গ নির্ধারণের ফলেই বোঝা যায়, সদ্যোজাত শিশুটি কী হতে চলেছে, ছেলে না মেয়ে। লিঙ্গ নির্ধারণ কমলে কন্যা ভ্রূণ হত্যাও কমবে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত অরুন্ধতীদেবী বলছিলেন, “কম বয়সে বিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে এখন অনেক মেয়েরাই এগিয়ে আসছে। পুরুলিয়ার মতো জেলার মেয়েরাও প্রতিবাদ করছে। তারা বলছে, কম বয়সে বিয়ে করব না। নিরন্তর প্রচারের ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও সর্বত্র সচেতনতামূলক কর্মসূচি করতে হবে। তবেই পরিস্থিতি বদলাবে।” কর্মশালায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জেলা পরিষদের জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ কর্মাধ্যক্ষ জারিনা ইয়াসমিন, তিন উপ-মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সৌম্যশঙ্কর সারঙ্গি, নিমাইচন্দ্র মণ্ডল এবং রবীন্দ্রনাথ প্রধান প্রমুখ। |