আমি যে সব বিষয়ে জানতে চাই, সেগুলি বইয়ে আছে। যে আমাকে এমন বই এনে দেবে, যা আমার পড়া হয়নি, সে-ই আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু। —এব্রাহাম লিংকন
প্রথমেই কবুল করছি, আমি বইয়ের ভক্ত। বই সংক্রান্ত কিছু ঘটলে আমি আপনাআপনিই সে দিকে আকৃষ্ট হই। তাই কলকাতা বই মেলায় যোগ দিতে পারব বলে এ বার আমার খুব আনন্দ হয়েছে। আমি শুনেছি, পৃথিবীর আর কোনও বইমেলায় এত মানুষ আসেন না। আমার কলকাতায় আসতে চাওয়ার একটা বড় কারণই হল এ শহরের সাহিত্য-সংস্কৃতি, বই পড়ার ঐতিহ্য এবং বুদ্ধিবৃত্তির চর্চায় এখানকার মানুষের প্রবল আগ্রহ। এই সব কারণেই তো কলকাতায় দুনিয়ার অন্যতম বিশাল এই সাহিত্য উত্সবের আয়োজন হয়। বস্তুত, কেবল বইমেলা নয়, কলকাতার প্রসিদ্ধ ‘বইপাড়া’ও সেই ঐতিহ্যের স্পষ্ট প্রমাণ। বড়, মাঝারি, ছোট, নানা মাপের নানা ধরনের বইয়ের দোকান এবং প্রকাশনা সংস্থা নিয়ে সে এক দারুণ আকর্ষণীয় ব্যাপার। তা ছাড়াও, শহর জুড়ে রয়েছে রকমারি পুস্তক বিপণি ও গ্রন্থাগার। কলকাতার মানুষের সংবাদপত্র এবং বিভিন্ন পত্রিকা পড়ার অভ্যেসও আমাকে মুগ্ধ করে। কলকাতা এমন এক শহর, যেখানে পড়া ব্যাপারটা নিছক অভ্যেস নয়, একটা দারুণ ভাল-লাগার ব্যাপার। |
ভারতে বর্তমানমার্কিন রাষ্ট্রদূত ন্যান্সি পাওয়েল কূটনীতিক হওয়ার আগে শিক্ষকতা করতেন। শিক্ষক এবং কূটনীতিক হিসেবে বই পড়ার উপযোগিতার কথা বলতে গিয়ে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘কোটি কোটি শিশুর অর্থনৈতিক ভবিষ্যত্ নির্ভর করছে ছোটবেলার স্কুলজীবনে তারা ঠিক ঠিক পড়তে পারছে কি না তার ওপর।’ এবং তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘খুব কম বয়েস থেকে শিশুদের বই পড়ার অভ্যেস তৈরি করা কতটা জরুরি, আমি তা জানি।’ দুনিয়া জুড়ে অগণিত অভিভাবক এবং শিক্ষক শিশুদের পড়তে উত্সাহ দিয়ে থাকেন। কেন? তাতে কী লাভ হয়? শিক্ষালাভ নিশ্চয়ই অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। ছেলেমেয়েদের খুব ছোটবেলা থেকে বই পড়ে শোনালে ভবিষ্যতে তাদের লেখাপড়ায় ভাল হওয়ার সম্ভাবনা স্বভাবতই বেড়ে যায়। কিন্তু শুধু তা-ই নয়। ছোটদের বই পড়ে শোনানোর সময়টা বাবা-মা তাদের সঙ্গে কাটান, তাদের প্রতি মন দেন, সেটা তাদের বড় হওয়ার পক্ষে বিশেষ অনুকূল।
কলকাতার আমেরিকান সেন্টার বরাবর পড়ায় উত্সাহ দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এখানে আমেরিকান লাইব্রেরিতে প্রচুর বইপত্র আছে, নানা ধরনের জার্নালও রাখা হয়। নিয়মিত বই পড়ার আসর বসে, বিশেষত কমবয়সি ছেলেমেয়েদের জন্য। বইপত্র নিয়ে নানা ধরনের আলোচনারও আয়োজন করা হয়। লাইব্রেরি বললে আমাদের সাধারণত মনে পড়ে বিরাট বিরাট গম্ভীর এবং নিস্তব্ধ হলঘরের কথা। এখন কিন্তু লাইব্রেরি মানে আড্ডা এবং আলোচনার সুযোগও বটে, সেখানে চা-কফি খাওয়ার জায়গা থাকে, থাকে ওয়াই-ফাই-এর ব্যবস্থা, বরাদ্দ করা থাকে নানা অনুষ্ঠান আয়োজনের বিশেষ স্থান। অনেক সময়েই সেখানে কনসার্ট হয়, শিল্প প্রদর্শনী হয়, নানা সৃষ্টিমূলক অনুষ্ঠান হয়। ফলে বই পড়া ছাড়া অন্য নানা উদ্দেশ্যেও মানুষ সেখানে যান। সুতরাং কেবল পাঠক নয়, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীও আধুনিক লাইব্রেরিতে গিয়ে থাকেন। আমেরিকান লাইব্রেরিও তার ব্যতিক্রম নয়।
এ বছর কলকাতা বইমেলায় আমেরিকান প্যাভিলিয়নটি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের আদলে সাজানো হয়েছে। এখানে কেবল কলকাতার আমেরিকান লাইব্রেরি সম্বন্ধেই খোঁজখবর মিলবে না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষার সুযোগসুবিধা সম্পর্কেও নানা প্রয়োজনীয় তথ্য জানা যাবে। ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দুই দেশের কাছেই শিক্ষার অগ্রাধিকার প্রশ্নাতীত। দু’দেশের পারস্পরিক সহযোগিতা যে বিষয়গুলির পক্ষে সবচেয়ে বেশি সুফলপ্রসূ হয়েছে, শিক্ষা তাদের মধ্যে প্রথম এবং প্রধান। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক লক্ষের বেশি ভারতীয় ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করছেন, এ দিক থেকে চিনের পরেই ভারতের স্থান। কলকাতা বইমেলায় আমেরিকান সেন্টারের প্যাভিলিয়নে ইউনাইটেড স্টেটস ইন্ডিয়া এডুকেশনাল ফাউন্ডেশন (ইউসিয়েফ) ডেস্ক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সম্পর্কে বিশদ তথ্য জানানো হবে, সেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার জন্য কী ভাবে আবেদন জানাতে হয়, ভর্তির প্রক্রিয়া কেমন, সে বিষয়ে সেমিনার এবং কাউন্সেলিং সেশন হবে, বিভিন্ন পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় যে সব মেটিরিয়াল এবং কম্পিউটার ডেটাবেস লাইব্রেরিতে আছে, সে সম্বন্ধেও জেনে নেওয়া যাবে।
কলকাতা বইমেলার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ কেবল এই কারণে নয় যে, আমাদের দুই দেশই বই পড়ার গুরুত্ব সম্পর্কে বিশেষ ভাবে সচেতন; ‘জনসাধারণের সঙ্গে জনসাধারণের’ ঘনিষ্ঠ সংযোগই যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটা বড় উপায়, এই যোগাযোগ তার প্রতীকও বটে। আমি জানি, আমার মতোই এই রাজ্যের এবং অন্য জায়গারও অগণিত মানুষ বইমেলায় আসবেন, বইপত্র এবং সাহিত্য-আলোচনার জগতে যোগ দেবেন। আসলে বইমেলা হল এক আশ্চর্য জায়গা, যেখানে আমরা অন্য দুনিয়ায়, অন্য পৃথিবীতে পাড়ি দিতে পারি, বিচিত্র সংস্কৃতি ও ধারণার ভুবনে সফর করতে পারি। মার্কিন লেখক জয়েস ক্যারল ওটস-এর কথা ধার করে বলতে পারি, ‘রিডিং ইজ দ্য সোল মিনস বাই হুইচ উই স্লিপ, ইনভলান্টারিলি, অফ্ন হেল্পলেসলি, ইনটু আনাদার্স স্কিন, আনাদার্স ভয়েস, আনাদার্স সোল।’ অর্থাত্, ‘একমাত্র পড়ার মাধ্যমেই আমরা আপনাআপনি, অনেক সময় অসহায় ভাবে, অন্য এক জনের দেহে, অন্য এক জনের কণ্ঠে, অন্য এক জনের চেতনায় স্থান করে নিই।’ |