|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
কর্তৃত্বপর্বের পরে এখন নৈরাজ্যপর্ব? |
গরিব গরিবকে মারবে, পুরুষ নারীকে লাঞ্ছনা করবে, শহর গ্রামকে শেষ করবে, ছোট ব্যবসাদার
ছোট শ্রমিককে মারবে,
চাষিতে চাষিতে ঝগড়া লাগবে, সাঁওতাল মুসলমানকে মারবে,
মুসলমান সাঁওতালকে মারবে, এই হল আধুনিক মুষলপর্ব। বলছেন
রণবীর সমাদ্দার |
পশ্চিমবঙ্গে নারী-নির্যাতনের বিভিন্ন সংবাদে জনমানসে বিভীষিকা, ক্ষোভ এবং ভয়ের পরিবেশের ছাপ স্পষ্ট। বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে নারী-নির্যাতনের সংবাদ গত এক বছর ধরে প্রাধান্য পেয়েছে। বুদ্ধিজীবীরা রাস্তায় নেমেছেন। এবং হয়তো অস্বাভাবিক নয়, প্রচারমাধ্যম এবং শিক্ষিত সমাজ শাসক দল ও প্রশাসনকে দায়ী করেছেন। যদিও দোষারোপের পর আলোচনা কোথাও এগোয়নি। বিরোধী দলনেতা ও কর্মিবৃন্দ সরকারকে এই বলে দায়ী করেছেন যে, নারী-নির্যাতকরা শাসক দল-পুষ্ট। অথবা, পুলিশের ওপর সেই দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ নেই, যাতে প্রশাসন এবং পুলিশ দিয়ে নারী-নির্যাতন বন্ধ করা যায়। রাজ্যপাল বলেছেন, লাভপুরের কাছের গ্রামের ঘটনায় নির্যাতনকারীদের দৈহিক সাজা দেওয়া উচিত।
নারী-নির্যাতনের ঘটনা বৃদ্ধিতে শিক্ষিত ও রাজনৈতিক সমাজের এই প্রতিক্রিয়া অনেকটা ভাবের ঘরে চুরির। শাসক দল বলবেন, নারী-লাঞ্ছনাকারীরা বিরোধী দলের সঙ্গে যুক্ত, বিরোধীরা বলবেন নারী-নির্যাতকরা শাসক দল-পুষ্ট। এর বেশি আমরা এগোলাম কোথায়? আশু রাজনৈতিক লাভ হতে পারে এতে, যদিও সেই লাভও নিশ্চিত নয়। কিন্তু, এটা নিশ্চিত যে পশ্চিমবঙ্গের ক্রমবিবর্তমান সমাজের পক্ষে উপযোগী রাজনীতি এই ভাবে করা যাবে না।
কর্তৃত্বপর্বের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে অনুশাসনপর্ব আসার এখনই কোনও লক্ষণ নেই। হয়তো নৈরাজ্যপর্বের অবসানে অনুশাসন ফিরে আসবে। দীর্ঘ বামফ্রন্ট শাসনে পার্টি সংগঠনের সাহায্যে এবং আনুকূল্যে গ্রামাঞ্চলে এবং ছোট শহরে এক ধরনের অনুশাসন ছিল। তার মূলে ছিল কর্তৃত্ব। কর্তৃত্বপর্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল গ্রামস্তর পর্যন্ত এক ধরনের বিরোধ নিদান ব্যবস্থা। বামফ্রন্ট শাসনের সালিশি বিলের কথা অনেকের মনে থাকবে। কিছু মূল্যবোধ, কিছু কর্তৃত্ব, কিছু মধ্যস্থতা, সব কিছু ব্যর্থ হলে পুলিশি ও দলীয় দাওয়াই, এই সবের যোগে গ্রামাঞ্চলে কর্তৃত্বপর্ব বহাল ছিল।
এই কর্তৃত্বের মধ্যে আলাপ-আলোচনার উপাদান ক্রমে কমে গিয়েছিল। শেষ দিকে আলাপচারিতার স্থান নিয়েছিল দলীয়, আর্থিক ও উপদলীয় পরাক্রম। সমাজের শিক্ষিত শ্রেণির নেত্ৃত্বে গ্রামাঞ্চল শাসিত হত এই ভাবে। গত দশকের প্রথম থেকে কর্তৃত্বপর্বের নিম্নগামী যাত্রা শুরু। সেই সময় থেকে কর্তৃত্বভিত্তিক সালিশের সীমাবদ্ধতা দেখা দিতে শুরু করে। অন্যমতাবলম্বী, নারী, অন্যধর্মাবলম্বীসমাজের দুর্বল অংশের উপর নিপীড়ন প্রকট হয় এই সময় থেকে। আদিবাসী সমাজে নারী-লাঞ্ছনা ডাইনি প্রথার মাধ্যমে চলতে থাকে। সম্পত্তি দখলের গৃহযুদ্ধের সূচনা সেই থেকে। |
|
শিকার। ধর্ষণভূমির অদূরেই। বীরভূম, ২৪ জানুয়ারি, ২০১৪। ছবি: রয়টার্স। |
বামফ্রন্ট শাসনের অবসানে কর্তৃত্বপর্ব গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে অনুশাসনও গিয়েছে। সমাজ চলছে খানিক স্বয়ংক্রিয় ভাবে, খানিক অভ্যাসে, খানিকটা পুরনো মানবিকতায়। কিন্তু নতুন সরকারি প্রশাসনের বৈশিষ্ট্য অন্য রকম। বর্তমান শাসক দল কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) নয়, হতেও চায় না। তা ছাড়া দল হিসেবে গড়ে উঠতেও তার সময় লাগবে। ফলে নৈরাজ্যের উপযোগী বা অনুকূল নানা লক্ষণ প্রকাশ্যে। সরকার, নেত্রী, প্রশাসন স্বাভাবিক কারণেই সচেষ্ট হবেন এই নৈরাজ্য থামাতে। কিছু পরিমাণে আত্মশাসন ও সরকারি তত্পরতা এই চেষ্টার মূল কথা। কিন্তু অনুশাসনের নতুন রূপ ছাড়া এই নৈরাজ্য দ্রুত বন্ধ করা যাবে কি না, সে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
পূর্ব ইউরোপের উদাহরণ আমাদের সামনে। সমাজতান্ত্রিক শাসনের পতনের পর সমাজে হিংসাত্মক ঘটনা বেড়ে গিয়েছিল। নারী-লাঞ্ছনা, বর্ণ-বৈষম্য পূর্ব জার্মানির সমাজে ভয়াবহ আকার নেয়। এতে খুব বিস্মিত হওয়ার নেই। নৈরাজ্য এক ধরনের গৃহযুদ্ধ, তার প্রথম বলি নারীরা। গরিব গরিবকে মারবে, পুরুষ নারীকে লাঞ্ছনা করবে, শহর গ্রামকে শেষ করবে, ছোট ব্যবসাদার ছোট শ্রমিককে মারবে, চাষিতে চাষিতে ঝগড়া লাগবে, সাঁওতাল মুসলমানকে মারবে, মুসলমান সাঁওতালকে মারবে এই হল আধুনিক মুষলপর্ব।
মুষলপর্বের এই অধুনা সংস্করণে গরিব সাঁওতালরা নারীলাঞ্ছনায় জড়িয়েছে। শুধু তা-ই নয়, গ্রামের সাঁওতাল মেয়েরাও বলেছে, নষ্ট মেয়ের যোগ্য শাস্তি। গ্রামকেন্দ্রিক, কৌমকেন্দ্রিক, পুরুষকেন্দ্রিক, সম্পত্তিকেন্দ্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে যে সালিশি প্রথা, তার অগ্নিরূপ আমরা প্রত্যক্ষ করছি। রাজনৈতিক সমাজ এর থেকে বেরিয়ে আসার পথের বিষয়ে চিন্তা না করে আত্মপ্রতারণার পথ বেছে নিয়েছে। এই পথের নির্যাস হল দোষারোপ।
ব্যক্তিস্বাধীনতার মূল্যবোধের প্রয়োজন নেই বলব না। কিন্তু সে পথে বেশি দূর এগনো যাবে না; সে পথে নারীর মর্যাদাও নিশ্চিত হবে না। নৈরাজ্য থেকে উত্তরণের জন্য যে অনুশাসনের প্রয়োজন, তার উত্স নিহিত সমাজের রূপান্তরকামী প্রযোজনায়। রূপান্তর নৈরাজ্য থেকে আসে না, আসে নতুন মূল্যবোধ এবং নতুন প্রশাসনবোধ ও পদ্ধতি থেকে। রূপান্তরকামী অনুশাসনের এক দিক হল দৃঢ় প্রশাসনিক কর্তৃত্ব, অন্য দিক হল আলাপচারিতা। এই পথই হল ব্যক্তি-নিরাপত্তার প্রকৃষ্ট পথ, সমাজ সংস্কারের পথও।
অর্থনীতির বদ্ধদশা, বিশ্বায়নের আঘাত, ক্ষুদ্র উত্পাদনের প্রভাব এবং কাঁচা টাকার লীলা এর মধ্যে দিয়ে রূপান্তরের পথ বার করা সহজ কথা নয়। কিন্তু দুরূহ হলেও, সে পথে এগনো সম্ভব। তার জন্য সামাজিক রূপান্তরের অভিমুখী প্রশাসনিক দৃঢ়তা চাই।
এক সময় বাঙালি সমাজে তর্ক চলত, রাষ্ট্রিক সহায়তা ছাড়া কি সমাজ সংস্কার সম্ভব? ঔপনিবেশিক যুগের এই বিতর্কের ঐতিহাসিক রায় কোন দিকে গিয়েছে, জানি না। সম্ভবত, সাক্ষ্য দু’দিকেই সমান। কিন্তু আজ এটা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে প্রশাসনিক দৃঢ়তা, রাষ্ট্রিক দিগ্নির্দেশ ছাড়া সামাজিক রূপান্তরের পথে বেশি দূর এগনো সম্ভব নয়।
এই প্রশ্ন হয়তো সঙ্গত যে, বামফ্রন্টের প্রবর্তিত প্রশাসনিকতায় প্রত্যাবর্তনে লাভ আছে কি না। যে দিকেই মত থাকুক না কেন, সে পথে প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। রাজনৈতিক সমাজকে ভাবতে হবে নতুন প্রশাসনিক রূপের কথা।
শুধু নাগরিক অধিকারের ধারণা এই রূপান্তরের কথা ভাবায় না। তার কারণ, নাগরিক অধিকার মূলত ব্যক্তি-অধিকার-কেন্দ্রিক। তার মূল্য আছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। আলাপচারিতা এবং রূপান্তরকামী প্রশাসনিক দৃঢ়তার সমন্বয় পথ দেখাতে পারে নতুন অনুশাসনপর্বের।
মুষলপর্বে নারী-নির্যাতক কে? আমার, আপনার পাশের মানুষ। দরিদ্র যে লোকটি সংসার চালাতে ব্যস্ত, হয়তো সে-ও। আর ক্ষুদ্র লুণ্ঠনবৃত্তি যার পেশা, সে তো বটেই। নিপীড়নের এই ব্যাপক সামাজিক ভিত্তির পরিপ্রেক্ষিতে শুধু প্রশাসনিক দৃঢ়তায় কতটা ন্যায়বিচার আসবে বলা শক্ত। হয়তো ন্যায়বিচার ব্যবস্থা অথবা আইনের বহুরূপ চাই, যাকে পোশাকি ভাষায় বলা হয়, লিগাল প্লুরালিজ্ম।
কিন্তু বহুত্ববিশিষ্ট ন্যায়ব্যবস্থার মূলেও কিছু নীতির স্বীকৃতি চাই, যা ন্যায় সম্পর্কিত সংলাপের ভিত্তি হতে পারে। যে নীতিগুলোকে বলা যায় আলাপচারী ন্যায়ব্যবস্থার ভিত্তি। সেই নীতি প্রবর্তনে গণক্ষমতার দৃঢ়তা প্রদর্শন ছাড়া অন্য পথ নেই। সংলাপী ন্যায়ব্যবস্থা, যদি সালিশি প্রথাও তার নাম দেওয়া যায়, সেই নীতিসমূহ এবং গণক্ষমতাকে সমর্থন করবে। এবং গণতান্ত্রিক উপাদানে সমৃদ্ধ হয়ে দণ্ডব্যবস্থা গ্রামাঞ্চলে পুনর্বৈধতা পাবে।
রূপান্তরেরও রূপকল্প আছে। জঙ্গল সাঁওতালের কথা সবাই জানেন। ক’জন জানেন তাঁর স্ত্রী বাহামণির কথা? নিরাভরণ বাহামণি নকশালবাড়ি মহিলা কৃষক সমিতির পদযাত্রায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন, ক’জন দেখেছেন? মহিলা কৃষক সমিতির সভায় বাহামণি মত রাখছেন, ক’জন শুনেছেন? আশির দশকের গোড়ায় বাংলার গ্রামাঞ্চলে যে নারী-সক্রিয়তা দেখা দিয়েছিল, ক’জন আজ তা স্মরণ রাখেন? এই আলাপচারিতার পথে বাংলার মানুষ আগেও ব্রতী হয়েছে। রূপান্তরকামী নতুন অনুশাসনের ভিত্তি সেই নতুন চৈতন্যভিত্তিক আত্মশাসন। প্রশাসনিক দৃঢ়তা সেই পথেরই পাথেয়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ-এর অধিকর্তা। মতামত ব্যক্তিগত। |
|
|
|
|
|