সকাল ১০টায় রাজপুর থেকে গড়িয়া যাবে বলে পাঁচ জন যাত্রী নিয়ে রওনা হয়েছিল অটোটি। গড়িয়া ব্রিজের এ-পারে মেট্রো স্টেশনের কাছে এসে অটোওয়ালা ঘোষণা করলেন, “এখানেই নেমে যেতে হবে। ও-পারে যাব না।” কেন? উত্তর এল, “ঠিকঠাক কাগজ না থাকলে গড়িয়া মোড়ে অনেক টাকা ফাইন করছে পুলিশ। এখন ও-সব ঝামেলায় যাব না।”
যাদবপুর-টালিগঞ্জ ট্রামডিপো রুটের দৃশ্য অন্য রকম। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে দশটায় যাদবপুর ৮বি-তে অটোর প্রায় দেখা নেই বললেই চলে। অনেকক্ষণ পরে একটি অটো পাওয়া গেল। চালক বললেন, “ভাঙড় হাসপাতালের কাছে কলকাতা পুলিশের সার্জেন্ট দাঁড়িয়ে আছেন। অটোর কাগজ দেখছেন। এই রুটে কোনও অটোতেই ঠিকঠাক কাগজ নেই। প্রচুর টাকা ফাইন দেওয়ার ভয়ে বেশির ভাগ চালক তাই গাড়ি বার করেননি।” আপনি চালাচ্ছেন কী করে? একগাল হেসে চালক বললেন, “আমাদের ইউনিয়নের নেতার ঘনিষ্ঠ যে সব চালক আছেন, তাঁদের ভয় নেই। তিনি পুলিশকে ফোন করলেই সেই অটো ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে।” |
সিএনজি-চালিত নতুন এই গাড়িই হয়ে উঠতে পারে অটোর বিকল্প,
এমনই মনে
করেন পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র।
এই গাড়িতে পিছনে
তিন জন ও সামনে দু’জন বসতে পারেন। —নিজস্ব চিত্র। |
লাগামছাড়া অটো-দৌরাত্ম্য রুখতে সোমবার থেকে অভিযান শুরু করেছে পুলিশ। তার জেরে রাতারাতি কলকাতার রাস্তা থেকে উধাও হয়ে গেল হাজার-হাজার অটো। কলকাতার বিভিন্ন মোড়ে অটোর যে ভিড় চোখে পড়ে, এ দিন তা অনেকটাই ফিকে। যা দেখেশুনে এক পরিবহণ-কর্তার বক্তব্য, “বেআইনি অটোর কথা আমরা বলেই থাকি। তবে আসলে, সংখ্যাটা যে কত আর সমস্যাটাই যে কতটা গভীরে, তা পুলিশি অভিযান শুরু হতেই সামনে আসছে।”
পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের বক্তব্য, কোনও অবস্থাতেই বেআইনি অটো বরদাস্ত করবে না সরকার। তিনি বলেন, “অটোর কাগজপত্র ঠিকঠাক করে নিতে যদি ইউনিয়নগুলি সময় চায়, সরকার ভেবে দেখবে। কিন্তু বেআইনি অটো চালানো যাবে না।”
পরিবহণ দফতর সূত্রের খবর, আইনি অটোয় সাতটি নথি থাকা জরুরি। সেগুলি হল: পরিবহণ দফতরের রেজিস্ট্রেশন, রুট পারমিট, ফিটনেস সার্টিফিকেট, কর, দূষণ ও বিমা সংক্রান্ত কাগজপত্র এবং চালকের বৈধ লাইসেন্স। এর মধ্যে কোনও একটি না থাকলেই সংশ্লিষ্ট অটোকে অবৈধ বলে গণ্য করা হয়।
এর মধ্যে বেশির ভাগ অটোর ক্ষেত্রেই ফিটনেস সার্টিফিকেট (সিএফ) ঠিকঠাক থাকে না বলে পরিবহণ-কর্তাদের দাবি। এক পরিবহণ-কর্তা বলেন, “সব বাণিজ্যিক গাড়িকেই প্রতি বছর পরিবহণ দফতর থেকে ফিটনেস সার্টিফিকেট নিতে হয়। গাড়িটি যে রাস্তায় চলার উপযুক্ত অবস্থায় আছে, তার প্রমাণ ওই শংসাপত্র। বেশির ভাগ অটোচালকই সময়মতো তা করান না।”
ঠিকঠাক থাকে না রুট পারমিটও। পরিবহণ দফতর সূত্রের খবর, সাধারণ ভাবে পারমিটের ‘অফার লেটার’ পেলে তবেই অটো কেনা যায়। পরে রেজিস্ট্রেশন ও পাকা পারমিট তৈরি হয়। কিন্তু পরিবহণ দফতরের এক কর্তা বলেন, “সরকারি নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের চাপে ডিলারদের একাংশ বেআইনি ভাবে অটো বিক্রি করে। দালাল ধরে রেজিস্ট্রেশনও হয়ে যায়। তার পরে ইউনিয়নের নেতাদের দাক্ষিণ্যে নির্দিষ্ট রুটে সেটি চলতেও শুরু করে।” সেই সুবাদে কলকাতায় এখনও পারমিট ছাড়া কয়েক হাজার অটো চলছে বলে দাবি তাঁর। এক রুটের পারমিট থাকলেও ইউনিয়ন নেতাদের ধরে অন্য রুটে চালানো কিংবা একটি অটোই অনেক রুটে চালানোর মতো রোগও আছে।
এর ছাড়া আছে বেআইনি চালকের সমস্যাও। সাধারণত, প্রত্যেকটি অটোর সঙ্গে দু’তিন জন করে চালক যুক্ত থাকেন। সারা সপ্তাহে সকাল-সন্ধ্যা হিসেবে ওই চালকেরা ভাগাভাগি করে একটি অটো চালান। প্রতি বেলার জন্য তাঁরা মালিককে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা (অটোর ভাষায় যাকে বলে বাতচিত) দিয়ে দেন। বাকি টাকা ওই চালকের। পরিবহণ-কর্তাদের মতে, “অটোর দাদাগিরি অনেকটাই বেআইনি চালকের জন্য। বেশির ভাগ এলাকায় ১৬-১৭ বছরের ছেলেরা সহজে রোজগারের জন্য অটো চালায়। তাদের অনেকের বৈধ লাইসেন্স থাকে না। কিন্তু ইউনিয়ন সে সব জেনেও তাদের গাড়ি চালানোর অনুমোদন দেয়। এদের কোনও দায়বদ্ধতাও নেই। অন্যায় করার জন্য মালিক তাড়িয়ে দিলে সহজেই তারা অন্য মালিকের অধীনে আবার গাড়ি চালাতে শুরু করে।”
কলকাতা পুলিশ সোমবার থেকে ধরপাকড় শুরু করায় এমন সব বিষয়ই সামনে আসছে। এই অভিযানকে স্বাগত জানিয়েছেন শাসক আইএনটিটিইউসি ও বিরোধী সিটু ইউনিয়ন দু’পক্ষই। আইএনটিটিইউসি নেতা মেঘনাথ পোদ্দারের বক্তব্য, “এমন পুলিশি অভিযান সব সময়েই স্বাগত। যাঁদের সঠিক নথি নেই, তাঁদের সব কিছু ঠিকঠাক করে নিতে যে সরকার সময় দিতে চাইছে, তাতেও আমরা খুশি।” সিটু নেতা বাবুন ঘোষ বলেন, “আইনের অনুশাসন আমরাও চাইছি। তবে চালকদের লাইসেন্স নিয়ে একটা সমস্যা হচ্ছে। পরিবহণ দফতর থ্রি-হুইলার গাড়ির লাইসেন্স দিচ্ছে না। দিচ্ছে ফোর-হুইলারের লাইসেন্স। এতে অটোচালকদের সমস্যা হচ্ছে। এই ব্যাপারটিও সরকার দেখুক।”
পরিবহণ-কর্তারা অবশ্য বেআইনি অটোর রমরমার পিছনে ইউনিয়নের নেতাদেরই দায়ী করছেন। তাঁদের আশঙ্কা, “পুলিশের ধরপাকড় কিছুটা ঢিলে পড়লেই পরিস্থিতি আবার আগের মতো হয়ে যাবে। রমরমিয়ে আবার রাস্তায় বেরিয়ে পড়বে বেআইনি অটো।” এক পরিবহণ-কর্তার মতে, “যে দল শাসনে থাকে, তাদেরই অটো ইউনিয়ন থাকে। ইউনিয়নের দাদাদের ভরসায় অনেক বেআইনি কারবারই চলে। শাসক দলের ইউনিয়ন হওয়ার কারণে পুলিশও ঘাঁটায় না।” ওই কর্তাদের মতে, ক্ষমতা বদলের পরে সেই ‘ট্র্যাডিশন’ একই রয়ে গিয়েছে। ধরপাকড়ের রেশ কাটলে সেই ট্র্যাডিশনই ফিরবে কি, সেটাই দেখার।
|