জামবুনি থেকে শিক্ষা নিক সুবলপুর
অর্ঘ্য ঘোষ • লাভপুর |
খবরটা শোনার পর থেকেই সুবলপুরের নির্যাতিতা তরুণীর জন্য প্রার্থনা করে যাচ্ছেন বছর পঁয়তাল্লিশের দুলি মুর্মু।
ওই তরুণীর সঙ্গে অনেকখানি মিল রয়েছে দিনমজুর দুলিদেবীর। দু’জনেই বীরভূমের লাভপুর ব্লকের একই পঞ্চায়েতের বাসিন্দা। দু’জনেই সালিশিসভার শিকার। ঘরছাড়া হওয়ার সম্ভাবনার সামনে পড়তে হয়েছিল দুলিদেবীকেও। ‘ডাইন’ আখ্যা দিয়ে জরিমানা আদায় ও গ্রামছাড়া করার নিদান ঘোষিত হয়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে। তাই সুবলপুরের নির্যাতিতা তরুণীর সঙ্গে একাত্ম বোধ করেন তিনি। সহমর্মিতার পাশাপাশি তিনি চান অবিলম্বে বন্ধ হোক এই ধরনের সালিশিসভা। |
জামবুনির দুলি মুর্মু।—নিজস্ব চিত্র। |
সুবলপুর থেকে কিলোমিটার চারেক দূরের গ্রাম জামবুনির আদিবাসী পাড়ায় সাকুল্যে ২৭টি পরিবারের বাস। অধিকাংশই দিনমজুর। মাধ্যমিকের চৌকাঠ পেরোননি কেউই। প্রাথমিকের গণ্ডি ছাড়ানোর আগেই ইটভাটায় কাজ নেয় গ্রামের ছেলেমেয়েরা। এমনই একটি পরিবেশে বছর আটেক আগে (২০০৫) দুলিদেবীর বাড়িতে মদ খেয়ে এক প্রতিবেশী অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে অভিযোগ ওঠে। গ্রামের লোকেরা তাঁকে নিয়ে যান বর্ধমানের এক জানগুরুর কাছে। জানগুরু নাকি গ্রামবাসীদের জানিয়ে দেন, দুলিদেবী ‘তুক’ করেছেন ওই প্রতিবেশীকে। তাঁকে গ্রাম থেকে তাড়াতে হবে। না হলে বাকিদেরও একই অবস্থা হবে। এর পরেই গ্রামে বসে সালিশিসভা। সেখানে চিকিৎসা খরচ বাবদ হাজার টাকা এবং মদ খাওয়ার জন্য দু’শো টাকা আদায় করা হয়। ‘তুক’ করার অপরাধে জরিমানা ধার্য করা হয় ১০ হাজার টাকা। ওই টাকা দিতে না পারায় সালিশিসভার মাতব্বরেরা দুলিদেবীকে গৃহবন্দি করে পিটিয়ে মারার হুমকি দেন বলে অভিযোগ। দুলিদেবীর স্বামী বুদু মুর্মুকে মারধর করে গ্রামছাড়া করার অভিযোগ ওঠে তাঁদের বিরুদ্ধে।
ওই সময় গ্রামের মোড়ল ছিলেন সিপিএম কর্মী রুবাই টুডু। দলের নেতা এবং পুলিশকে জানিয়েও দুলিদেবী কোনও সুবিচার পাননি। বরং তাঁকে আদিবাসী সমাজের সালিশিসভার রায় আপসে মিটমাট করে নেওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ। আনন্দবাজারে সেই খবর প্রকাশিত হওয়ার পরে প্রশাসন সালিশিসভার মাতব্বরদের গ্রেফতারের পাশাপাশি দুলিদেবীর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে। ফেরানো হয় আদায় করা টাকাও।
সেদিন অতীত। কিন্তু সুবলপুরের ঘটনা আজও নাড়িয়ে দিয়ে যায় জামবুনি আদিবাসী পাড়াকে। মঙ্গলবার ওই গ্রামে গিয়ে দেখা গেল স্বামীর সঙ্গে ধান শুকোচ্ছেন দুলিদেবী। তিনি বলেন, “সে দিনের সেই দুঃসহ রাতের কথা কোনও দিন ভুলতে পারব না। সালিশিসভা ডাইন বলে দেগে দেওয়ার পরে ওরা সারা রাত আমাকে ঘরে আটকে রেখেছিল। পিটিয়ে মারার হুমকি শুনতে-শুনতে দুই মেয়েকে বুকে নিয়ে সারা রাত ঠকঠক করে কেঁপেছি। সংবাদমাধ্যম ছাড়া সেই সময়ে কেউ পাশে এসে দাঁড়ায়নি। তাই সুবলপুরের বিষয়টি জানার পরেই মারাং গুরুর থানে মানত করেছি। যাতে ওর অপরাধীরা উপযুক্ত শাস্তি পায়।” দুলুদেবীর স্বামী বলেন, “জরিমানা না দিতে পারায় স্ত্রী, দুই মেয়েকে ফেলে আমাকে তিন দিন গ্রাম ছেড়ে থাকতে হয়েছিল। এমন ঘটনা যেন আর কারও জীবনে না ঘটে।”
সেই রুবাই মুর্মু অবশ্য আজ আর মোড়ল নন। তাঁর জায়গায় মোড়ল হয়েছেন দুলিদেবীর এক দেওর কবিরাজ মুর্মু। তিনি বলেন, “আমি গ্রামের মোড়ল ঠিকই। সালিশিসভাও বসে। তবে তার ধরনটা আমরা বদলে ফেলেছি। এখন প্রশাসনের কাছে কোনও দাবিদাওয়া কিংবা গ্রামের মানুষের অভাব অভিযোগ নিয়ে বৈঠক ডাকি।”
বদলে গিয়েছেন সে দিনের সেই মোড়ল রুবাই টুডুও। তিনি বলেন, “পরে আমরা ভুল বুঝতে পেরেছি। আসলে সালিশিসভা ডেকে বিচারের নামে পরের পয়সায় মদ-মাংস খাওয়ার জন্যই জরিমানা করা হয়। সে দিনের আদায় করা টাকা খরচ হয়ে গিয়েছিল। পরে পুলিশের চাপে তা ফেরত দিতে গিয়ে বুঝেছি, নিজেকে জরিমানা দিতে হলে কী অবস্থা হয়। সালিশি ডেকে জরিমানা করার ঘটনা গ্রামে আর ঘটেনি।”
আর গ্রামবাসী?
নীলমণি টুডু, জয় মুর্মুরা বললেন, “আমরা জরিমানা করি না। নিজেদের সাধ্য অনুযায়ী চাঁদা তুলে রাতভর শুয়োরের মাংস আর হাঁড়িয়ার আসর বসিয়ে মারংগুরুর স্থানে মাদলের তালে নাচি।”
|