টেনেটুনে শ’খানেক লোক। তাঁদের বিক্ষোভ প্রায় ১২ ঘণ্টা স্তব্ধ করে দিল শিয়ালদহ মেন লাইনের ট্রেন চলাচল। সারা দিনের এই অচলাবস্থা কাটাতে এগিয়ে এলেন না রাজ্য প্রশাসনের কোনও কর্তাই। একটি চটকলে শ্রমিক-মালিক বিরোধের খেসারত দিতে হল নিত্যযাত্রীদের। সন্ধ্যার পরে পুলিশকর্তাদের মাধ্যমে কথার্বাতা চালিয়ে অবরোধ তোলা হয়।
সোমবার সকাল আটটা থেকে টিটাগড় স্টেশনে শুরু হওয়া এই অবরোধের ফলে কর্মস্থলে পৌঁছতেই পারলেন না বহু মানুষ। সপ্তাহ শুরুর দিনেই স্টেশনে স্টেশনে আটকে রইলেন অফিসযাত্রী, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী-সহ জরুরি প্রয়োজনে বের হওয়া মানুষ। রানাঘাট স্টেশনে আটকে পড়ে রইলেন রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরীও। |
রেল অবরোধ। টিটাগড় স্টেশনে। সোমবার সজল চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি। |
পরিস্থিতি সামাল দিতে রেল কর্তৃপক্ষ বেলা ১০টা নাগাদ ব্যারাকপুর থেকে আপ লাইনের বিভিন্ন গন্তব্যে এবং শিয়ালদহ থেকে সোদপুরের মধ্যে কিছু কিছু ট্রেন চালাতে শুরু করেন। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পর পর সে রকম কয়েকটি ট্রেন চালিয়ে এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়নি। ট্রেন চলাচল বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায় বিটি রোডেও উপরে আছড়ে পড়ে নিত্যযাত্রীদের ভিড়। অল্প কিছু বাস এই ভিড়ের চাপ সামলাতে পারেনি। বয়স্ক, মহিলা ও শিশুদের পক্ষে বাদুড়ঝোলা ভিড়ের ওই সব বাসে ওঠা কার্যত অসম্ভব ছিল। যাঁরা বিক্ষোভ শুরুর আগেই কর্মস্থলে রওনা হয়েছিলেন, বেলা শেষে ফেরার সময়ে তাঁরাও আটকে রইলেন শিয়ালদহ-বিধাননগর রোড-দমদম স্টেশনে। রেল সূত্রের খবর, অবরোধ ওঠার পরে রাত আটটা নাগাদ ওই শাখায় ট্রেন চলাচল শুরু করা হয়।
রেল কর্তৃপক্ষের দাবি, রেল সংক্রান্ত কোনও কারণে বিক্ষোভ হয়নি। অবরোধ হয়েছে টিটাগড় লুমটেক্স চটকলের শ্রমিকদের বকেয়া টাকা না পাওয়ার সমস্যা নিয়ে। বামপন্থী, ডানপন্থী-সহ মোট ১১টি শ্রমিক সংগঠন সোমবার সকাল থেকে এই অবরোধে শামিল হয়েছেন। অবরোধ শুরু সময়ে টিটাগড় স্টেশনে থাকা যাত্রীরা জানান, সওয়া আটটা নাগাদ স্টেশনে ঢোকে ডাউন কল্যাণী লোকাল। ওই সময়ে বিক্ষোভকারীরা রেল লাইনে বসে পড়েন। ট্রেন থেকে নেমে বাস ধরার জন্য যাত্রীদের উদ্দেশে মাইকে ঘোষণা করতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা। ট্রেনের সামনে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় ‘সংগ্রামী মজদুর ইউনিয়ন’-এর ব্যানার। লাইনের পাথরের মধ্যেই পুঁতে দেওয়া হয় আইএনটিটিইউসি-সহ সমস্ত শ্রমিক সংগঠনগুলির পতাকা।
কী দাবি নিয়ে রেল-অবরোধ করেছিল শ্রমিক সংগঠনগুলি?
গত ২৮ অক্টোবর থেকে লুমটেক্স চটকল বন্ধ। প্রভিডেন্ট ফাণ্ড, গ্র্যাচুইটি-সহ অন্যান্য বকেয়া মেটানো এবং কারখানা খোলার দাবিতে আন্দোলন করছে ১১টি শ্রমিক সংগঠন। শ্রমিক সংগঠনগুলির পক্ষে সংগ্রামী মজদুর ইউনিয়নের নেত্রী শর্মিষ্ঠা চৌধুরী এ দিন জানান, ইউনিয়নগুলিকে বিভ্রান্ত করছে রাজ্য সরকারের শ্রম দফতর ও মালিকপক্ষ। তিনি অভিযোগ করেন, “এ ব্যাপারে মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলে তাঁরা বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন।” শ্রমিক সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই চটকলে স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলিয়ে প্রায় সাত হাজার কর্মী কাজ করেন। চটকল কর্তৃপক্ষ অবশ্য এই কারখানা বন্ধ হওয়ার জন্য শ্রমিক বিক্ষোভকেই দায়ী করেছেন। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কর্মী বিক্ষোভের জেরে উৎপাদন প্রায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেই কারণেই অক্টোবর মাস থেকে চটকলের দরজা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
রাতে শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু বলেন, “জেলাশাসকের সামনে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হলেও কয়েকটি সংগঠন তা অমান্য করে কারখানার গেটে মঞ্চ বেঁধে আন্দোলন করছিল। এ দিন তারাই রেল অবরোধ করে আইনশৃঙ্খলা ভাঙে। এদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” |
ট্রেন বন্ধ। তাই কৃষ্ণনগরে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে
বাস ধরার ভিড়। সোমবার সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি। |
মন্ত্রী কড়া ব্যবস্থার কথা বললেও দিনভর অবরোধের জেরে আটকে থাকা যাত্রীদের অভিজ্ঞতা কিন্তু অন্য কথা বলছে। টিটাগড় স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের অনেকেই জানিয়েছেন, অবরোধকারীরা সরকারি কর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতেই চাইছিলেন। কিন্তু বিক্ষোভ শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরেও সরকারি কর্তাদের কাউকেই ঘটনাস্থলে দেখা যায়নি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকালে যখন অবরোধ শুরু হয়, তখন অবরোধকারীর সংখ্যা ছিল একশোর মতো। তাঁদের ঘিরে রেখেছিলেন প্রায় আড়াইশো জন পুলিশ। সঙ্গে ছিলেন আরপিএফ, জিরআরপি এবং ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের কর্তারাও। কিম্তু প্রত্যেকেই ছিলেন নীরব দর্শক। রেলের যাত্রীরাই তখন প্রশ্ন তুলেছিলেন, কেন কোনও পদস্থ সরকারি কর্তা ঘটনাস্থলে এসে অবরোধকারীরা আলোচনায় বসছেন না? কেন সরকারি কর্তারা কেউ অবরোধ তোলার ব্যাপারে দ্রুত উদ্যোগী হলেন না? উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক সঞ্জয় বনশল বলেন,“ অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলাম।”
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শেষপর্যন্ত অবরোধ শুরু হওয়ার প্রায় সাত ঘণ্টা পরে, বেলা সাড়ে ৩টে নাগাদ ঘটনাস্থলে আসেন শিয়ালদহের রেল পুলিশ সুপার উৎপল নস্কর। শর্মিষ্ঠা চৌধুরী এবং আইএনটিটিইউসি-র পক্ষে লক্ষ্মী চৌধুরীর কাছেও অবরোধ তুলে নেওয়ার আর্জি জানান তিনি। দুই নেত্রীই সাফ জানিয়ে দেন, সরকার যতক্ষণ না তাঁদের সমস্যা নিয়ে আলোচনার রাস্তায় আসছে, ততক্ষণ অবরোধ চলবে। সন্ধ্যায় সরকারের সঙ্গে আলোচনার পর রেল পুলিশ সুপার ফের শর্মিষ্ঠাদেবীর কাছে আর্জি জানান, ৬ ফেব্রুয়ারি শ্রম কমিশনারের সঙ্গে বৈঠকে এই সমস্যার মীমাংসা সূত্র বের করা হবে। তার আগে অবরোধ তুলে নেওয়া হোক। সাড়ে সাতটা নাগাদ অবরোধ তোলা হয়।
এ দিনের অবরোধে কলকাতায় আসার পথে রানাঘাটে আটকে পড়েন রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরীও। এ দিন লালগোলা প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে লাগানো একটি সেলুনকারে মন্ত্রী রানাঘাটে পৌঁছন দুপুর দেড়টা নাগাদ। তাঁকে অবরোধকারীদের সঙ্গে কথা বলার অনুরোধও জানান অনেক যাত্রী। দুপুর আড়াইটের পর কৃষ্ণনগরের দিক থেকে একটি ইঞ্জিন এসে মন্ত্রীর সেলুনটিকে ফের বহরমপুরের দিকে টেনে নিয়ে যায়। |