প্রবন্ধ ১...
লাল-দুর্গে বামফ্রন্টের ভরাডুবি হল কেন
শ্চিমবঙ্গে কয়েক দশকের নিরঙ্কুশ বাম শাসনের পর অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই পঞ্চায়েত, বিধানসভা ও লোকসভায় বাম পরাজয় নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এর কারণ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে, বৈঠকখানায়, চায়ের দোকানে, টুইটারের কিচিরমিচিরে অনেক আলোচনা ও জল্পনা-কল্পনা হয়েছে। সেই তুলনায় সরেজমিনে পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যের অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণের পরিশ্রমসাধ্য কাজ হয়েছে অনেক কম।
এই ক্ষোভের আঁচ ভোটে পড়েনি? নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলিচালনার
প্রতিবাদে মিছিল। ১৪ নভেম্বর ২০০৭। ছবি: দেবীপ্রসাদ সিংহ।
এই লেখায় আমাদের একটি বড় মাপের গ্রামীণ অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সমীক্ষার কিছু আংশিক ফলাফল জানাচ্ছি, যা থেকে ওই বিষয়ে কিছু আলোকপাত হতে পারে। ২০০৪ সালে আমরা গ্রামবাংলার ১৭টি জেলায় প্রায় ৯০টি গ্রামে ২৪০০র মতো পরিবারে একটি নমুনা সমীক্ষা করি, যা থেকে পুরো পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে একটা ধারণা করা যায়। ওই সমীক্ষায় পরিবারগুলির আর্থিক-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে নানাবিধ প্রশ্ন করার পরে তাঁদের রাজনৈতিক মতামত ও কার্যকলাপ বিষয়েও প্রশ্ন করা হয়, তাঁদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার সংস্থান ও অভাব-অভিযোগের খবর নেওয়া হয়। শেষে একটা ভোটের বাক্সে গৃহকর্তা বা কর্ত্রীর শাসক দল নির্বাচনের মহড়া নেওয়া হয়। এর পর ২০১১ সালের শেষ দিকে (তার কয়েক মাস আগে বিধানসভার ভোটে বামদলের নিদারুণ পরাজয় হয়েছে) আমরা আবার সেই ২৪০০ পরিবারের কাছে ফিরে গিয়ে পুরোনো প্রশ্নগুলির উত্তরে তাঁদের অবস্থা ও মনোভাবের পরিবর্তনের খবর নিই, এ ছাড়া কতকগুলি নতুন প্রশ্ন করে বিভিন্ন দল সম্পর্কে তাঁদের অভিযোগ ইত্যাদি যাচাই করে দেখি, এবং সব শেষে আবার একটা ভোটের বাক্সে তাদের দলনির্বাচনে বাছাই করতে বলা হয়। এই বিশাল তথ্যভাণ্ডারের ভিত্তিতে ও পরিসংখ্যানতত্ব ব্যবহার করে বামদলের পরাজয়ের হেতু সম্পর্কে আমরা কিছু আংশিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি, এই প্রবন্ধে তার কিছু হদিশ দেব। এখানে বলে নেওয়া ভাল যে আমরা শুধু ভোটারের মতামতের কথাই বলব। বাম পরাজয়ের পিছনে বিভিন্ন দলের সাংগঠনিক বা নেতৃত্বের বস্তুগত প্রভাবের আপেক্ষিক মূল্যায়ন সম্পর্কে আমরা কোনও দলীয় তথ্য আহরণ করিনি।
আমাদের ২০০৪-এর সমীক্ষায় দেখা গেছে যে গ্রামের প্রায় অর্ধেক লোক তার আগের ২৫ বছর ধরে সব নির্বাচনেই বামপন্থী দলকেই ভোট দিয়ে এসেছেন। এই বাম-অনুগত মানুষের একটা প্রধান অংশ দলিত বা জনজাতির মানুষ, প্রান্তিক বা ক্ষুদ্র চাষি। একের পর এক নির্বাচনে এঁরাই ছিলেন গ্রামে বাম সমর্থনের প্রধান খুঁটি। অথচ ২০১১ সালে আমাদের সমীক্ষায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এই এত দিনের বাম-অনুগতদের অর্ধেকের বেশি বামদের ভোট দেননি। সারণি ১-এ সমীক্ষায় বিভিন্ন গোষ্ঠীর ভোটের অনুপাত দেওয়া হল।
বাম পরাজয়ের কারণ নিয়ে আলোচনায় সাধারণত সবচেয়ে জোর দেওয়া হয় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম ঘিরে জমি অধিগ্রহণ ব্যাপারে বাম বিভ্রাট সম্পর্কিত বিক্ষোভের রাজ্যময় প্রতিফলনের উপর। শুনেছি, বাম দলের মধ্যেও কিছু কিছু নেতা অধিগ্রহণ নীতির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের এই নিয়ে দুষেছেন। এ সম্পর্কে আমাদের সমীক্ষার ফল অতটা সরল সিদ্ধান্তের পরিপন্থী। আমরা ভোটারদের অসন্তোষের সমীক্ষায় দেখছি সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের কাছাকাছি (আমাদের সমীক্ষার সমস্ত পরিবারের এক-চতুর্থাংশ যেখানে বাস করে) আঞ্চলিক অসন্তোষ নিশ্চয়ই প্রকট, কিন্তু সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম থেকে কিছু দূরে যে গ্রামগুলি (সমীক্ষার সমস্ত পরিবারের অর্ধেক যেখানে বাস করে) সেখানে নেতাদের সম্পর্কে এই অসন্তোষের মাত্রা ক্ষীণ হয়ে আসে। অর্থাৎ, সমগ্র পশ্চিমবাংলায় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের বিক্ষোভের জেরেই বামদল হেরে গেল এটা বলা অতিকথন হবে, অসন্তোষের অন্য কারণগুলি নিয়ে আরও চিন্তার প্রয়োজন।
অবশ্য বাম সমর্থনের জোর কিছু দিন ধরেই অল্প অল্প কমছিল। কেউ কেউ বলেন যে যত দিন যাচ্ছে ভোটারদের সনাতন আনুগত্যে চিড় ধরছে, কেননা ভোটারের গড়পড়তা বয়স কমছে, এ ছাড়া তারা আগের তুলনায় টিভি দেখেন বেশি, দিনরাত সংবাদমাধ্যমে বিক্ষোভ-অভিযোগের খবরে আগের তুলনায় সচেতনতা বাড়ছে। কিন্তু আমাদের তথ্যে এই সব কারণে বাম ভোট কমে যাবার বিশেষ লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
সমীক্ষার নির্বাচনে বাম ভোটের অনুপাত
পরিবারের গোষ্ঠীসূচক এই গোষ্ঠীর শতকরা কত জন বামকে ভোট দিয়েছেন
  ২০০৪ ২০১১
সব পরিবার ৫৮ ৩২
তফসিলি জাতির পরিবার ৬৫ ৩৭
তফসিলি জনজাতি পরিবার ৭৩ ৪২
হিন্দু ৫৮ ৩২
মুসলমান ৫৭ ৩৫
ভূমিহীন ৫৮ ৩২
প্রান্তিক চাষি
(১.২৫ একরের কম চাষের জমি)
৬৪ ৩৫
ক্ষুদ্র চাষি
(১.২৫ থেকে ২.৫ একর জমি)
৫৬ ৩১
মধ্য ও বড় চাষি
(২.৫ একরের বেশি জমি)
৪৭ ২৬
এর পর দেখা যাক যে ভোটের সঙ্গে যে স্থানীয় সরকারের কাছে বিভিন্ন সুযোগসুবিধার প্রাপ্তিযোগের যে রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে অনেক দিন ধরে বহাল, তার কোনও তারতম্যের ছায়া ভোটপর্বে পড়েছে কি না। গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্প, ঋণ, কৃষি-উপাদানের মিনিকিট ইত্যাদির জন্য কিছু দিন পর পরই পঞ্চায়েতের কর্তাদের শরণাপন্ন হতে হয়, এ ভাবে বাম নেতারা ভোটারদের সঙ্গে একটা পোষ্য-পোষক সম্পর্ক অনেক দিন ধরেই প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, আমাদের ২০০৪-এর সমীক্ষায় এটা স্পষ্ট ছিল। ২০১১-র সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে তৃণমূল দলের অধিকারে পঞ্চায়েতগুলিতে তারাও তত দিনে ভোটারদের সঙ্গে এই ধরনের সম্পর্ক স্থাপন করতে সফল হয়েছে। তবে পরিসংখ্যান তত্ত্ব ব্যবহার করে আমাদের হিসেবে দেখতে পাচ্ছি যে, ২০১১ সালে বাম সমর্থনে ভাটায় এই দুই দলের ভোটারদের সঙ্গে রাজনৈতিক পোষ্য-পোষক সম্পর্কে কোনও তারতম্যের অবদান নগণ্য।
বরং আমাদের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে পঞ্চায়েত ও রাজ্য স্তরে নেতাদের ব্যক্তিগত দুরাচার, সাধারণ মানুষের প্রতি মনোভাব, নীতিনির্বাহে, বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সেচ ইত্যাদি জনকল্যাণমূলক পরিষেবায় গাফিলতি, দুর্নীতি, দলীয় কোন্দল ইত্যাদি ব্যাপারে জনরোষ বাম পরাজয়ের জন্য অনেকাংশে দায়ী। আমাদের সমীক্ষার এক অংশে আমরা পরিবারগুলিকে বলেছিলাম নেতাদের মূল্যায়ন করে নম্বর দিতে, বিভিন্ন খাতে ১ থেকে ৫-এর মধ্যে নম্বর। ৫ হল সর্বাধিক অসন্তোষের মাত্রা, ১ হল ন্যূনতম অসন্তোষের মাত্রা। অসন্তোষের এই মূল্যায়নে সব দলের নেতাদেরই নম্বর প্রায়শই বেশ খারাপ। যেমন, বিদ্যালয়ে শিক্ষা পরিষেবার ব্যাপারে বাম পঞ্চায়েতের গ্রামগুলিতে স্থানীয় নেতাদের গড়পড়তা নম্বর হল ৩.১৭; তৃণমূল পঞ্চায়েতের গ্রামগুলিতে সেই নম্বর হল ৩.০১। এই পার্থক্য এমনিতে কম দেখায়, কিন্তু পরিসংখ্যান তত্ত্ব প্রয়োগ ক’রে আমরা দেখাতে পারছি যে, শিক্ষার ব্যাপারে স্থানীয় বাম নেতাদের প্রতি অসন্তোষের আধিক্য পরিসংখ্যানগত ভাবে নগণ্য নয়। এই রকম আরও কয়েকটি বিষয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পরিষেবায়, সেচ ব্যবস্থা ও রাস্তা নির্মাণ জাতীয় জনহিতকর প্রকল্পে, স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগসাজসে, ব্যক্তিগত সততায়, দলীয় সংগঠন ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে, এবং পুরোনো কর্মীদের তুলনায় বর্তমান রাজনৈতিক কর্মীদের কাজের অবনতিতে স্থানীয় বাম নেতারা তৃণমূল নেতাদের চেয়ে কিছু খারাপ নম্বর পেয়েছেন স্থানীয় মানুষের বিচারে, যেটা নগণ্য নয়। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা অবশ্য পুরোটা পঞ্চায়েতের হাতে নয়, কিন্ত দলের প্রভাব সর্ব স্তরেই এত জোরালো যে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে এ ব্যাপারে স্থানীয় দলনেতাদের দায়িত্ব খুব একটা কম নয়। এমনিতেও হয়তো বহু কাল ক্ষমতায় আসীন একটা দলের কাছে মানুষের প্রত্যাশা একটু বেশি থাকে। সমীক্ষায় একমাত্র বুদ্ধি-বিবেচনার খাতে স্থানীয় বাম নেতারা তৃণমূল নেতাদের তুলনায় ভাল নম্বর পেয়েছেন।
অসন্তোষের সূচক*
মহিলাদের প্রতি মনোভাব ৩.০৩
নেতাদের ভাবমূর্তি ৩.০১
কর্মীদের ভাবমূর্তি ২.৮০
গরিব মানুষের প্রতি মনোভাব ২.৭৭
এলাকার মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক ২.৭২
দলীয় সংগঠন ২.৫৮
অন্য দলের সঙ্গে সম্পর্ক ২.৪৯
দলীয়অন্তর্কলহ ২.২৩
হিংসা ও সন্ত্রাসের আশ্রয় ২.২২
দুর্নীতি ২.১৮
*২০১১ সালে রাজ্যস্তরের (প্রধানত বাম) নেতাদের প্রতি বিভিন্ন খাতে অসন্তোষের মূল্যায়ন (৫-চূড়ান্ত অসন্তোষ, ১-ন্যূনতম অসন্তোষ)
এবার আসা যাক রাজ্যস্তরের নেতাদের নম্বরে। সারণি ২-এ ২০১১ সালে আমাদের সমীক্ষায় বিভিন্ন পরিবারের কাছে রাজ্য স্তরের বামনেতারা বিভিন্ন খাতে অসন্তোষের মাত্রায় যে নম্বর পেয়েছেন তার গড়পড়তা হিসেব দেওয়া হল। ওই সারণিতে অন্তত প্রথম পাঁচ-ছয়টি খাতে রাজ্যের বামনেতারা বেশ বড় রকমের জনরোষের কারণ হয়েছেন বলে মনে হয়। এখানে আর একটা জিনিসও উল্লেখযোগ্য। অসন্তোষের কারণ অনুসন্ধানে আমরা সরাসরি সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের বা জমি অধিগ্রহণের কথা পরিবারগুলির সামনে তুলে ধরিনি, কেননা তা হলে উত্তরদাতাকে খেই ধরিয়ে দেওয়া হত, যেটা সমীক্ষার আচরণ-বিধিতে ঠিক সঙ্গত নয়। কিন্তু সারণিতে উল্লিখিত কারণগুলিতে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের পরোক্ষ ছায়া থাকা অসম্ভব নয়। যেমন, অসন্তোষের একটা বড় কারণ দেখা যাচ্ছে বাম নেতাদের ‘মহিলাদের প্রতি মনোভাব’। আমাদের সমীক্ষায় এ নিয়ে আর খুঁটিয়ে প্রশ্ন করা হয়নি। তবে কেউ কেউ মনে করেন এই মনোভাবের ব্যাপারে সিঙ্গুরের তাপসী মালিক সংক্রান্ত ঘটনার ছায়া পড়া অস্বাভাবিক নয় (তৃণমূলনেত্রীর প্রতি কিছু বাম নেতার কটূক্তির কথা ছাড়াও)।
আমরা পরিসংখ্যানতত্ত্বের পদ্ধতি ব্যবহার করে এই ধরনের গণ-অসন্তোষের বাম ভোটের উপর প্রভাব নিয়ে হিসেব করে দেখেছি। বলা বাহুল্য রাজ্য স্তরের ও স্থানীয় বাম নেতাদের প্রতি অসন্তোষ আমাদের সমীক্ষায় বাম ভোটের নিম্নগামিতায় যথেষ্ট প্রভাবশালী হয়েছে। অবশ্য, রাজ্য স্তরের বাম নেতাদের ভোট বিপর্যয়ে তাঁদের প্রতি জনগণের প্রত্যক্ষ অসন্তোষ আর সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের পরোক্ষ প্রভাব আমাদের তথ্যে পৃথক করা দুরূহ, কিন্তু কেবল সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জন্যই বামদলের ভরাডুবি হল, এ কথা বলা যাবে না। বিশেষ করে পঞ্চায়েত স্তরে, যখন বাম নেতারা গ্রাম পঞ্চায়েতে ও জেলা পরিষদে গদি দখল করেছিলেন, আমাদের হিসেবে দেখছি সেই স্থানীয় নেতাদের প্রতি গণ-অসন্তোষ ভোটের ফলাফলে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে, বিশেষত স্থানীয় নেতাদের দুর্নীতি আর বিদ্যালয়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে গাফিলতি বাম পরাজয়ের একটি (একমাত্র নয়) বড় কারণ বলে আমাদের তথ্যে দেখা যাচ্ছে।

প্রথম তিন লেখক যথাক্রমে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে; ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা; এবং বস্টন ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির শিক্ষক। অনুষা নাথ বস্টন ইউনিভার্সিটিতে গবেষণারত।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.