রবিবার দুপুরেও ফোনে বাবা-মায়ের সঙ্গে কুশল বিনিময় হয়েছিল তাঁদের। রাতেই খবর এল মধুচন্দ্রিমা সেরে আর বাড়ি ফেরা হবে না নববধূর। ওই দিন বিকেলে আন্দামানে লঞ্চ দুর্ঘটনায় জনা কুড়ি পর্যটকের সঙ্গেই সমুদ্রে তলিয়ে গেলেন দমদমের বাসিন্দা জুঁই দাস। পরে তাঁর দেহ উদ্ধার হয়।
|
জুঁই |
গত ডিসেম্বরের ১৩ তারিখে দমদমের সুভাষনগর এলাকার বাসিন্দা কৌশিক দাসের সঙ্গে বিয়ে হয় জুঁইয়ের (২২)। ২৫ জানুয়ারি বিমানে তাঁরা আন্দামান যান। ২৬ তারিখ একটি ট্র্যাভেল এজেন্সির সঙ্গে ভাইপার আইল্যান্ড দেখতে যান জুঁই-কৌশিক। দুর্ঘটনার কবলে পড়া ‘অ্যাকোয়া মেরিন’ লঞ্চটিতে করেই ভাইপার আইল্যান্ড থেকে ফিরছিলেন তাঁরা।
কৌশিক সাঁতার জানলেও জুঁই জানতেন না। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, লঞ্চটি প্রায় পৌঁছেই গিয়েছিল পোর্ট ব্লেয়ারে। মাত্র দু’কিলোমিটার দূরে ঘটনাটি ঘটে। সূত্রের খবর, হঠাৎ করে লঞ্চে জল ঢুকতে শুরু করে। এর পরেই ধীরে ধীরে ডুবতে থাকে সেটি। কিছু ক্ষণ পরেই প্রচণ্ড জোরে বিস্ফোরণের শব্দ। দু’টুকরো হয়ে যায় লঞ্চ। যাত্রীরা পড়ে যান মাঝ সমুদ্রে। বিস্ফোরণের শব্দ পেয়েই কাছাকাছি থাকা জেলে নৌকাগুলি সে দিকে এগিয়ে যায়। অভিযোগ, দুর্ঘটনার ঘণ্টাখানেক পরে ঘটনাস্থলে পৌঁছয় উদ্ধারকারী দল।
রবিবার রাতেই দমদমে কৌশিকদের বাড়িতে দুঃসংবাদ পৌঁছে যায়। খবর যায় বিরাটিতে জুঁইয়ের বাড়িতেও। সোমবার সকালে জুঁইয়ের এক মামা কল্যাণ ভৌমিক বারবার বলছিলেন, “দুপুরেও মেয়েটা জানাল, খুব ভাল বেড়াচ্ছে। তার ঘন্টাখানেকের মধ্যেই কী করে সব শেষ হয়ে গেল?”
সোমবার ভোরেই আন্দামান রওনা হয়ে যান কৌশিকের এক বন্ধু সুরজিৎ সাহা। আন্দামান থেকে তিনি বলেন, “কৌশিক ভীষণ মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে রয়েছে। ভাল করে কথা বলতে পারছে না। শুধু বলছে, অনেক চেষ্টা করেও ওকে বাঁচাতে পারলাম না।” কৌশিকের মামা জানান, কৌশিক তাঁদের পরে ফোনে জানান, শেষ পর্যন্ত স্ত্রীকে বাঁচানোর চেষ্টা চালিয়েছিলেন। ডুবে যাওয়ার আগেও কিছুক্ষণ হাত ধরে ছিলেন জুঁইয়ের। স্ত্রীকে নিয়ে ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে হেরে যান বছর তিরিশের ওই যুবক। |
জুঁইয়ের কফিনবন্দি দেহ ঘিরে পরিজনদের কান্না। সোমবার, কলকাতা বিমানবন্দরে। ছবি: শৌভিক দে। |
সোমবার বিকেল পাঁচটা নাগাদ আন্দামান থেকে স্ত্রীর কফিন নিয়ে দমদম বিমানবন্দরে নামেন কৌশিক। তাঁর চেহারায় তখনও আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। কার্গো থেকে স্ত্রীর কফিন নিয়ে আত্মীয়দের সঙ্গে চলে যান দমদমের বাড়িতে। কৌশিককে দেখে এক দিকে কান্নায় ভেঙে পড়েন জুঁইদের আত্মীয়েরা, কয়েক জন আবার জানতে চান কেন তিনি বাঁচাতে পারলেন না জুঁইকে? কফিন নিয়ে প্রথমে যাওয়া হয় দমদমে কৌশিকের বাড়িতে। সেখান থেকে কফিন যায় জুঁইদের বিরাটির বাড়িতেও।
এ দিকে, বিমানবন্দরে ক্ষোভে ফেটে পড়েন জুঁই ও কৌশিকের বাবা। তাঁদের বক্তব্য, লঞ্চের লোকেদের গাফিলতির জেরেই এমন মর্মান্তিক পরিণতি হল তাঁদের। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, জীর্ণ ওই লঞ্চটিতে লাইফ-জ্যাকেট ছিল না। ছিলেন না কোনও নিরাপত্তাকর্মী বা ডুবুরিও।
প্রশাসন সূত্রে খবর, ওই নৌকাটির যাত্রী বহনের ক্ষমতা ছিল ২৫ জন। তবু ৫১ জনকে নিয়ে রওনা হয়েছিল সেটি। দুর্ঘটনায় জুঁই-সহ ২১ জন মারা যান। ২৯ জন উদ্ধার হয়েছেন। এক জন নিখোঁজ। তাঁর খোঁজে তল্লাশি চলছে। লঞ্চের মালিক ও দুই কর্মীকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। |