কখনও সাংবাদিকদের মোবাইলে ফোন করে, কখনও বা কম্পিউটারে টাইপ করা প্রেস বিবৃতি সাংবাদিকদের ই-মেল করে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ-প্রশাসনকে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন তিনি। কোনও বিবৃতিতে দাবি করছেন, জলপাইগুড়ির পাহাড়পুর-বজরাপাড়ায় সাইকেল বোমা বিস্ফোরণ তাঁদের কীর্তি নয়। কোথাও আবার বলছেন, নির্দোষদের উপর পুলিশি অত্যাচার বন্ধ না হলে, তাঁরা গণহত্যার রাস্তা বেছে নেবেন এবং অবধারিত ভাবে যার শিকার হবেন বাঙালিরা। টেলিফোনে কথা বলার সময়ে সাংবাদিকদের সম্বোধন করেন ‘দাদা’ বলে আর গলার স্বরে যথেষ্ট
বিনয় ও আন্তরিকতা থাকে তাঁর। তিনি কৈলাস কোচ, কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশন (কেএলও)-র সাধারণ সম্পাদক।
কিন্তু কৈলাস কোচ নামে আসলে কে বা কারা সাংবাদিকদের সম্প্রতি ফোন করছেন, তা নিয়ে পুলিশ ও গোয়েন্দারা ধন্দে। শুধু পশ্চিমবঙ্গের নন, অসমের পুলিশকর্তারাও এই নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন।
জলপাইগুড়ি জেলার কুমারগ্রামের তমির দাস-ই যে কেএলও-র বর্তমান চেয়ারম্যান জীবন সিংহ ও ময়নাগুড়ির জয়দেব রায়-ই যে ওই জঙ্গি সংগঠনের ভাইস চেয়ারম্যান টম অধিকারী, এই নিয়ে গত ১০-১২ বছর ধরে সংশয়ের কোনও জায়গা নেই। কিন্তু জটিলতা তৈরি হয়েছে সাংবাদিকদের টেলিফোন করা ওই কৈলাস কোচের প্রকৃত পরিচয় নিয়ে।
রাজ্য পুলিশের আইজি পদমর্যাদার এক অফিসারের বক্তব্য, “কৈলাস কোচের আসল নাম কেশব বর্মন। বছর পঁয়ত্রিশের ওই যুবক অসমের কোকরাঝাড় জেলার বহরাগুড়ি গ্রামের বাসিন্দা। কৈলাস কোচ হল সংগঠনের নাম।” তবে ওই পুলিশকর্তার বক্তব্য, “সম্প্রতি, বিশেষ করে ২৬ ডিসেম্বর জলপাইগুড়ি বিস্ফোরণের পরে অসম থেকে এক ব্যক্তি নিজেকে কৈলাস কোচ বলে দাবি করে পশ্চিমবঙ্গের কয়েক জন সাংবাদিককে ফোন করছে। কিন্তু আমরা জেনেছি, কেশব বর্মন ওরফে কৈলাস কোচ সেই সময়ে আদৌ অসমে ছিল না এবং এখনও সে অসমে নেই। সে ক্ষেত্রে অন্য কেউ সম্ভবত কৈলাস কোচের নাম করে ফোন করছে।”
গত বছরের ২১ মার্চ নেপালের ঝাপা জেলার কোনও এক গোপন আস্তানায় কেএলও-র শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বৈঠকে সংগঠনের ১৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি তৈরি করা হয় এবং গোয়েন্দারা সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের নাম জানতে পারেন। সেই প্রথম কৈলাস কোচের নাম সামনে আসে। কিন্তু মিল্টন বর্মার মতো আত্মসমর্পণকারী যে সব কেএলও জঙ্গি মূল স্রোতে ফিরেছেন, তাঁরা কৈলাস কোচ নামে কাউকে চেনেন না বলে পুলিশকে জানিয়েছিলেন। তার পরেই কৈলাস কোচ আসলে কে, তা নিয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়।
জঙ্গি সংগঠনের নামের আড়ালে প্রকৃত নাম হারিয়ে যাওয়ার উদাহরণ আকছার রয়েছে। মাওবাদী নেতাদের মধ্যে কোটেশ্বর রাওয়ের চেয়ে কিষেণজি ও বেঙ্কটেশ্বর রেড্ডির তুলনায় তেলুগু দীপক নামই বেশি পরিচিত। আবার এক সময়ে মাওবাদীদের রাজ্য সম্পাদক কাঞ্চন আসলে কে, সেটা গোয়েন্দারা প্রথমে বুঝতে পারেননি। তাঁরা জানতেন, কাঞ্চনের প্রকৃত নাম বরুণ শূর। সাত-আট মাস পরে তাঁরা জানলেন, সুদীপ চোংদার-ই কাঞ্চন। মাওবাদীদেরই হাতে তৈরি লালগড়ের পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সিধো সরেন নাম নিয়ে এক যুবক সশরীরে সাংবাদিকদের সামনে আসতেন। আসলে তাঁর নাম ছিল বটো বাস্কে।
সিআইডি-র হাতে গ্রেফতার হওয়ার পরে মাওবাদীদের রাজ্য কমিটির সদস্য তেলুগু দীপক স্বীকার করে নেন, মাসের পর মাস ধরে তাঁকে কিষেণজির ভেক ধরে থাকতে হয়েছিল, এমনকী কিষেণজির গলা নকল করে টেলিফোনে তিনি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথাও বলেন। কেএলও প্রধান জীবন সিংহের নামে এক সময়ে প্রেস বিবৃতি পাঠাতেন দক্ষিণ দিনাজপুরের কুমারগঞ্জের বয়রাপাড়া গ্রামের সুদীপ সরকার। সংগঠনে যাঁর নাম পিন্টু বরুয়া।
ঠিক সে ভাবেই কৈলাস কোচের নাম করে কিছু দিন যাবৎ কেএলও-র অন্য নেতা বা নেতারা ফোন করছেন বলে পুলিশের একাংশের সন্দেহ। তাঁরা জেনেছেন, যে নম্বর থেকে টম অধিকারী, নীলাম্বর রাজবংশী ওরফে মঞ্চলাল সিংহরা তোলা চেয়ে ফোন করছে, সেই একই নম্বর থেকে কৈলাস কোচের নাম নিয়ে সাংবাদিকদের ফোন করে প্রেস বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, কৈলাস কোচের নাম নিয়ে পিন্টু বরুয়া ফোন করতে পারেন। আবার অসম পুলিশের একটি সূত্রের বক্তব্য, কেএলও-র প্রচার সচিব রাজীব কাঠাল ওই সমস্ত ফোন করছেন।
তবে কৈলাস কোচের নামে যিনিই ফোন করুন, তিনি খুঁটিয়ে সংবাদপত্র পড়েন। কারণ, প্রেস বিবৃতি দেওয়ার পর দিন সংবাদপত্রে সেটা ছাপা না হলে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে অভিমানের সুরে কথা বলেন সাংবাদিকের সঙ্গে। |