উড়ো ছাই বাতাসে
লোকটার হাবভাবে একটা অমায়িক হিংস্রতা প্রকাশ পাচ্ছিল। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে, ও যা বলতে এসেছে, সেই কথাগুলো বলে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করছিল। বাড়ির দরজার সামনে পড়ে থাকা একটা গাছের গুঁড়ির ওপর ও বসেছিল। কথা বলছিল মাটির দিকে তাকিয়ে। হুয়ান ওকে ভাল করেই চেনে। ও হচ্ছে তার এক কালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাইমন আর্ভালোর ছেলে। ‘আপনারা এখান থেকে কেটে পড়লেই ভাল করবেন।’ লোকটা মাটির থেকে চোখ না তুলেই জানাল। হুয়ান এই কথার কোনও উত্তর দিল না। ভোর থেকে আজ আকাশ অন্ধকার। বাতাসে স্যঁাতসেঁতে গুমোট ভাব। হুয়ান লোকটার নোংরা টুপিটার উপর দিয়ে দূরের খেতগুলোর দিকে তাকাল সবুজ, হলুদ, পাকা ফসলের সোনালি রং, আবার সবুজ, উজ্জ্বল সবুজ। ‘কে এসেছে?’ রান্নাঘর থেকে তার বউয়ের উঁচু-গলার প্রশ্ন শোনা গেল। হুয়ান উত্তর দিল না। লোকটা তার ধুলোমাখা জুতোটাকে অন্য জুতোর পাটিতে ঘষে ঘষে মন দিয়ে কাদা ছাড়াচ্ছিল। ‘আপনারা ভালয় ভালয় কেটে পড়ুন’, সে আবার বলল, এ বার অবশ্য মুখটা তুলে।
‘কে ওখানে?’ এ বার উঠোনের দিকের খোলা দরজাটায় কারমেন তার বাচ্চা কোলে নিয়ে এসে দাঁড়াল। লোকটা তার কাঠের গুঁড়ির আসন থেকে উঠে পড়ল আর খানিকটা যান্ত্রিক ভাবেই তার পাতলুনের পিছনটা ঝেড়ে নিল। ‘সুপ্রভাত সেনোরা কারমেন’, লোকটা বলল। বাচ্চাটা তার মায়ের গলায় হাত দিয়ে তখন খেলা করছিল। ওর বয়স কয়েক মাস মাত্র, আর সারা গায়ে মায়ের দুধ আর ভেজা কাঁথার গন্ধ। হুয়ান কোনও কথাই বলল না। লোকটা দৃশ্যতই অস্বস্তি বোধ করছে। কিছু ক্ষণের জন্য একটা নৈঃশব্দ্য শুধু ঝুলে রইল, খোলা প্রান্তরের গ্রামীণ নৈঃশব্দ্য। পুরো উপত্যকাটাই যেন সেই বিষণ্ণ সকালে একমনে নিজের হৃত্‌কম্পনের ধুকপুক শব্দ শুনছিল। ‘কিন্তু সূর্য ঠিক আড়াল থেকে বেরিয়ে আসবে’ ভাবল হুয়ান।
লোকটা চলে যাওয়ার পর হুয়ান বলল, ‘বদমাইশ! বলে গেল, আমরা যদি এই হপ্তার মধ্যে চলে না যাই, তা হলে ওরা আসবে আর আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দেবে।’ ‘আমাদের মেরে না ফেলে বের করতে পারবে না’, বলল কারমেন। ‘আমিও ওকে সেই কথাই বললাম’, হুয়ান জানাল, যদিও তার মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। কারমেন তার বুকে আঁকড়ে থাকা বাচ্চাটাকে নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। আর হুয়ান দাঁড়িয়ে রইল একা তার বাড়ির সামনে একটা নিঃসঙ্গ গাছের মতো।
পাড়াটা একেবারেই হতদরিদ্র পাড়া আর সেই জন্যই হুয়ানের ওই সামান্য কুঁড়েঘর তার চারপাশের জমিটা নিয়ে নেতৃত্ব বা কর্তৃত্বের কী দরকার থাকতে পারে, তার কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া মুশকিল। দুটো ছোট ছোট খেত একটা পাহাড়ি আলুর আর অন্যটা সবজির। পাশ দিয়ে একটা ছোট্ট ঝরনা নেমেছে। কারমেনের কথায়, ‘ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো’। এর থেকে কত ভাল আর দামি জায়গা পড়ে আছে এই হুর্তাদোতেই। ওদের বাড়িটাকেও ঠিক বাড়ি বলা যায় না অর্ধেক পাকা আর অর্ধেক কুঁড়েঘর। আগের নির্বাচনে সে ভোট দিয়েছিল ঠিকই। তাতে কী! কে দেয়নি? কেউ এ পক্ষকে দিয়েছে, কেউ অন্য পক্ষকে। তার জন্য কি মারদাঙ্গা ফাটাফাটি করতে হবে? হুয়ান হঠাত্‌ নিজের মনে হেসে ওঠে। ‘ছেলেটা আমায় ফালতু ভয় দেখাবার চেষ্টা করল।’ কিন্তু তার মনে পড়ে গেল, গত হপ্তায় সে যখন শহরে গেছিল, কিছু পুলিশকে দেখেছিল বাজারে বন্দুক ছাড়াও হাতে চাবুক নিয়ে ঘুরে বেড়াতে। বন্দুক ঠিক আছে, কিন্তু চাবুক কেন? তা ছাড়া, চেনা লোকজনের চালচলনেও সে একটা বদল লক্ষ করছিল। বাজারের মুরুব্বি ডন রমুলো লিনারেসের লোকেরা তাকে তেল বিক্রি করতে রাজি হল না। বলে দিল তেল নেই, যদিও চোখের সামনেই তেল দেখা যাচ্ছিল ঘন আর চকচকে, কালো রঙের কাত করা ড্রাম থেকে ফোঁটা ফোঁটা তেল গড়িয়ে একটা ফানেলে পড়ছিল আর সেখান থেকে নল বেয়ে জমা হচ্ছিল কাউন্টারের পিছনে রাখা একটা বোতলে। সে অবশ্য এ নিয়ে আর কথা বাড়ায়নি। যে ভাবে ডন রমুলো তাকে খিঁচিয়ে উত্তর দিল, তার পর আর কথা বলার ইচ্ছেই হয়নি। তার পর সে ঢুকেছিল ওষুধের দোকানে, সুগন্ধি ভেসলিনের একটা কৌটো কেনার জন্য। বেনেভিদেস ওকে বেশ মোলায়েম কিন্তু রহস্যজনক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, ‘কী, সব ঠিকঠাক আছে? এখনও কিছু ঘটেনি তো?’ ও যখন উত্তর দিতে যাচ্ছিল, হঠাত্‌ই বেনেভিদেস ওকে অদ্ভুত ইশারা করে চুপ থাকতে বলল। একটা পুলিশ দোকানে ঢুকল আর তার পিছন-পিছন সাইমন আর্ভালোর ছেলেটা। পুলিশটা তার চাবুকের ডগা দিয়ে কাউন্টারে ঠুকতে লাগল। বেনেভিদেসের মুখ একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ‘কী হচ্ছে এখানে?’ পুলিশটা জানতে চাইল। তার পর হুয়ানের দিকে ঘুরে গেল আর চাবুকটা নিজের প্যান্টের গায়ে সশব্দে ঝেড়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিল, ‘কী রে, তুইও নাকি ওদের দলে আছিস, যারা সব কাজে বাধা দিচ্ছে?’ হুয়ানও নিশ্চয়ই ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল, সে বেশ টের পাচ্ছিল যে তার বুকের ধুকপুক অসম্ভব বেড়ে গেছে। আর্ভালো বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ও লালেদের এক জন ওই কাছেই থাকে।’ হুয়ান দাঁড়িয়ে রইল যেন তার পা দুটো মেঝেতে গেঁথে গিয়েছে। চাবুকটা খাকি পাতলুনের গায় মাথা ঠুকে সপ্ সপ্ আওয়াজ করছিল। ‘হু-ম, হু-ম।’ পুলিশটা গর্জন করতে লাগল। ‘ও অবশ্য চুপচাপই থাকে। বিশেষ গন্ডগোল করে না’, আর্ভালো বলল। ‘দেখে নেব, দেখে নেব, সবগুলোই তো আসলে কুত্তার বাচ্চা।’ একটা বীভত্‌স হাসিতে পুলিশটার মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল।
গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল প্রথমে কারমেনের, তার পর হুয়ানের, তার পর বাচ্চাটা জেগে উঠে কাঁদতে শুরু করল। বাইরে তখন আলো ফুটে গেছে, কারণ ঘরের ভিতরের জিনিসপত্র সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নামতে নামতে হুয়ান খুব দ্রুত আন্দাজ করে, পাঁচটার কাছাকাছি বাজে। আবার গুলির শব্দ। এ বার অনেক কাছাকাছি। কোনও মতে পাতলুনটা গলিয়ে সে ছুটে গিয়ে দরজা খুলল। আকাশ থেকে একটা দুধ-সাদা রং মাঠঘাটের উপর ছড়িয়ে পড়েছে। ‘হ্যঁা, পাঁচটাই বাজে আর দিনটাও খুব সুন্দর’, হুয়ান মনে মনে ভাবল, যদিও সচেতন ভাবে নয়। দুজন হুয়ানের বেড়ার ভিতর ঢুকল; এক জন আর্ভালো আর অন্য জন সেই দোকানের চাবুক-হাতে পুলিশটা। আর্ভালোর শাসানিটা তা হলে সত্যি হতে চলেছে? ঠিক বারো দিন আগে ও শাসাতে এসেছিল। ‘এক হপ্তা, এক হপ্তার মধ্যে এখান থেকে কেটে পড়ুন। না হলে...।’
পুলিশটা বাতাসে আর এক বার গুলি ছুড়ল। তার পর হুয়ানের দিকে এগিয়ে এল। ‘কী রে, শুনতে ভাল লাগছে? কাল সকালে এই সময় আরও অনেক আওয়াজ শুনতে পাবি, যদি তার আগেই কেটে না পড়িস। বুঝতে পারলি? মাথায় ঢুকল কিছু?’

(সংক্ষেপিত)
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী।
অনুবাদ সৌম্যশঙ্কর মিত্র।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.