বনের মধ্যে একটা জরুরি সভা বসেছে। সভাপতি সিংহমশাই একটা ভাঙা জিপগাড়ির ছাদে উঠে বসেছিলেন। ওই গাড়িটায় চড়ে এক শিকারি বছরখানেক আগে আফ্রিকার সিংহ শিকার করতে এসেছিল। সিংহমশাই সেই শিকারিকে খুব তৃপ্তি করে খেয়ে এবং গাড়িটাকে তিনি সিংহাসন হিসেবে ব্যবহার করছেন।
সিংহমশাইয়ের সিংহাসন ঘিরে বনের অন্য সমস্ত পশুপাখি শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। কে ছিল না সে সভায়? চিতা, হাতি, হায়না, শিপাঞ্জি। হরিণ, জলহস্তি, গণ্ডার, জেব্রা। জিরাফ, বুনো মোষ, সাপ, কুমির। তা ছাড়া পাখি, পোকা, ইঁদুর, বাদুড় কেউ বাদ ছিল না। সকলেরই চিন্তিত মুখ। চোরটাকে খুঁজে বার করতে না পারলে মুশকিল।
চুরি হয়েছে একটা পাখির বাসা। বাওবাব গাছের উঁচু ডালে এক বাবুইপাখি অনেক খেটেখুটে একটা চমত্কার দোল দোলানো বাসা বানিয়েছিল। তার পর সে পাশের জঙ্গল থেকে তার বউকে ডেকে আনতে গিয়েছিল। মাত্র এক রাত্তির সে বাসার কাছে ছিল না। ব্যস, তার মধ্যেই আস্ত বাসাটা গায়েব। রেগেমেগে বাবুইপাখি সিংহমশাইয়ের কাছে নালিশ ঠুকে দিয়েছে। ‘কে আমার বাসা চুরি করল খুঁজে বার করুন। তা না হলে আপনাকে রাজা বলে মানব না।’
সিংহমশাই প্রথমে বাবুইপাখিকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলেন। ‘আহা তোর বাসায় এমন কী দামি জিনিস ছিল যে, কেউ সেটাকে চুরি করবে? দেখ, হয়তো ঝড়ে-টড়ে পড়ে গিয়েছে।’ |
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য। |
বাবুই তাই শুনে আরও রেগে বলল, ‘তুমি কোন জগতে থাকো? বুড়ো বয়সে কি ভিমরতি ধরেছে? গত এক মাস ধরে বনে একটু বাতাস অবধি বইছে না, গরমে সবাই হাঁসফাঁস করছি। আর তুমি বলছ ঝড়ে পড়ে গিয়েছে? থাকব না তোমার রাজ্যে। চললাম হনলুল কিংবা ম্যাডাগাস্কার।’
সিংহমশাই বাবুইয়ের কথার যুক্তি মেনে নিলেন। অমন শক্তপোক্ত বাসা তো আর এমনি এমনি পড়ে যেতে পারে না। কেউ বদমাইশি করেই সরিয়েছে। কিন্তু কে হতে পারে? তার নিজের মাথা থেকে কিছু বেরোল না বলেই তিনি আজ সভা ডাকলেন।
সভা ডেকেও কিন্তু বিশেষ উপকার হল না। এত জন্তুর মধ্যে চোরকে কেমন করে খুঁজে বের করা যাবে? সবাই যখন চিন্তিত মুখে মাছি তাড়াচ্ছে তখন হঠাত্ আফ্রিকান গ্রে প্যারট ডানা ঝাপটে একটা গাছের ডালে উঠে বসল। সবাই বুঝল গ্রে প্যারট কিছু বলতে চায়।
এই পাখিটাকে বনের বাকি বাসিন্দারা বেশ শ্রদ্ধাভক্তি করে। কারণ, খাঁচার তার কেটে পালিয়ে আসার আগে অবধি পাখিটা বেশ কিছু দিন কলকাতা বলে একটা জায়গায় ভারী ঝগড়ুটে এক বুড়ির বাড়িতে কাটিয়েছে। মানুষের কাছাকাছি অত দিন থাকার ফলে তার বুদ্ধিটা ধারালো হয়ে গিয়েছে, আর তার চেয়েও বেশি ধার হয়েছে তার কথায়। ঝগড়ুটে বুড়ির প্রায় সব কথাই তার ঠোঁটের ডগায়।
গ্রে প্যারট প্রথমেই বলল, ‘আপনারা হয়তো জানেন না, আমি এক টিকটিকি।’
এই কথা শুনেই সভায় যত আসল টিকটিকি ছিল তারা ভয়ঙ্কর টিক-টিক করে উঠল, ‘ইয়ার্কি নাকি? টিকটিকিদের গায়ে কখনও পালক, দুটো ঠ্যাঙ থাকে? কখনও তুমি টিকটিকি নও।’
গ্রে প্যারট বলল, ‘কী মুশকিল। টিকটিকি মানে গোয়েন্দা, সেটাও জানো না! যা-ই হোক, আমি অনেক ভেবে দেখলাম গাছে উঠে বাসা চুরি করতে পারে এই ক’জন চিতা, বাঁদর, ভালুক আর অজগর সাপ। এরা সকলেই দিব্যি গাছে চড়তে পারে। কিন্তু এরা বাসা চুরি করবে কেন? মোটিভটা কী? বাবুইয়ের সঙ্গে কি এদের কারও শত্রুতা ছিল?’
বাবুই ঘাড় নেড়ে বলল, একদমই না।
‘তার পর ধরো, উড়ে এসে বাসা নষ্ট করতে পারে ঈগলপাখি, বাজপাখি এরা। কিন্তু এরাও কি বাবুইয়ের শত্রু?’
বাবুই বলল, ‘ছি, ছি। এরা আমাদের বড় কুটুম। শত্রু কেন হবে?’
‘ভাবুন, তা হলে ওই পনেরো ফুট উঁচু গাছ থেকে কী ভাবে বাসা চুরি হল?’
সবাই এক সুরে বলল, ‘কী ভাবে?’
গ্রে প্যারট ভয়ঙ্কর রেগে গিয়ে বলল, ‘গোয়েন্দারা কখনও ও রকম এককথায় অপরাধীর পরিচয় দেয় না। খেলিয়ে বলতে হয়। আমিও সে ভাবেই বলব।’
সবাই ভয়ে ভয়ে বলল, ‘আচ্ছা বেশ, তাই বলো।’
‘তবে শুনুন, কলকাতায় আমি যে বাড়িতে থাকতাম সেই বাড়ির বুড়ি ঠাকুমা প্রায়ই ঝগড়ার মধ্যে নানান আপ্তবাক্য আওড়াতেন, আর সেই আপ্তবাক্য ছিল একেবারে মোক্ষম সত্যি। কোনও কথাটাই ফেলে দেওয়ার মতন নয়। তিনি ঝগড়ার সময় অপোনেন্টকে প্রায়ই বলতেন, ‘ইশ্, চোরের মায়ের বড় গলা।’ তা হলে আমাদের ভেবে দেখতে হবে এখানে কার মায়ের বড় গলা। সে-ই চোর।’
কথাটা শোনা মাত্র সমস্ত জন্তুর চোখ সভার একদম শেষ প্রান্তে ঘুরে গেল। সেখানে দাঁড়িয়ে জিরাফ এতক্ষণ নির্বিকার মুখে কাঁটাগাছ চিবোচ্ছিল। সবাই জানে, শুধু তার মায়ের কেন, তার চোদ্দোপুরুষের সবারই বড় গলা। ছ’ফুট, সাত ফুট লম্বা গলা একএকজনের সব মিলিয়ে তার মা ছিল পনেরো ফুট লম্বা, আর সে নিজে আঠেরো ফুট।
সিংহমশাই হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, ‘কী রে? দোষ স্বীকার করবি? নাকি...’
জিরাফ বেচারা কথা বলতে পারে না। সে লম্বা গলা ঝুঁকিয়ে দোষ স্বীকার করে নিল। ইশারায় বুঝিয়ে দিল, অন্ধকারের মধ্যে বাওবাবের ফল ভেবে বাসাটাকে সে খেয়ে ফেলেছিল।
জিরাফের শাস্তি হল বাবুইকে নতুন বাসা বাঁধার জন্য তক্ষুণি দু’আঁটি খড় জোগাড় করে দিতে হবে।
সভা ভাঙল। সমস্ত জন্তু গ্রে প্যারট আর কলকাতার সেই বুড়িকে ধন্য ধন্য করতে করতে বাসায় ফিরল। |