|
|
|
|
প্রশাসনে থেকে নৈরাজ্য নয়, কড়া বার্তা প্রণবের
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
সরকার দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয়। জনপ্রিয়তার নামে নৈরাজ্য প্রশাসনের বিকল্প হতে পারে না। প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্-সন্ধ্যার বক্তৃতায় আজ এই কথা বললেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়।
রাষ্ট্রপতি কারও নাম করেননি। কাদের উদ্দেশে রাষ্ট্রপতির এই বার্তা, তা নিয়ে চাপানউতোর শুরু হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে। কংগ্রেস ও বিজেপি, উভয়েরই দাবি, রাষ্ট্রপতির এই মন্তব্যের ইঙ্গিত আম আদমি পার্টি তথা দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দিকে। দিন কয়েক আগে আচমকা রেল ভবনের সামনে ধর্নায় বসে কেজরিওয়াল বলেছিলেন, “ওরা যদি আমাকে অ্যানার্কিস্ট (নৈরাজ্যবাদী) বলে, তা হলে আমি অ্যানার্কিস্ট।” তাত্পর্যপূর্ণ ভাবে, প্রণববাবু আজ তাঁর বক্তৃতায় ‘জনপ্রিয়তার নামে নৈরাজ্য’ (পপুলিস্ট অ্যানার্কি) শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেছেন। ফলে কংগ্রেস-বিজেপি-র মতো দলগুলি মনে করছে, টিম কেজরিওয়ালেরই সমালোচনা করেছেন রাষ্ট্রপতি।
আপ নেতৃত্বের কিন্তু দাবি, রাষ্ট্রপতি আসলে সমালোচনা করছেন ইউপিএ সরকারের। যদিও সেই যুক্তি উড়িয়ে অনেকেই মনে করছেন, রাষ্ট্রপতি আপের রাজনৈতিক পন্থার সমালোচনা তো করেছেনই, পাশাপাশি অসন্তোষ প্রকাশ করছেন জনতাকে তাদের ‘অবাস্তব প্রতিশ্রুতি’ দেওয়া নিয়ে। ইউপিএ সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভকে কাজে লাগিয়েই রাজনীতিতে দ্রুত উঠে এসেছে আপ। দিল্লিতে ক্ষমতায় আসার ১৫ দিনের মধ্যে জন-লোকপাল বিল পাশ করানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারা। কিন্তু তা এখনও সম্ভব হয়নি (কেজরিওয়াল অবশ্য আজ বলেছেন, ফেব্রুয়ারিতেই রামলীলা ময়দানে বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন ডেকে ‘জনতার মাঝে’ জন লোকপাল বিল পাশ করাবেন)। এ ছাড়া, বিদ্যুতের বিল কমানো, জলের সরবরাহ বাড়ানোর ঘোষণা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু ওই প্রতিশ্রুতিগুলির বাস্তবায়ন পুরোপুরি সম্ভব কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে নানা শিবিরে।
দুর্নীতি নিয়ে যে মানুষের ক্ষোভ আছে, তা মেনে নিয়েছেন প্রণববাবুও। তিনি স্পষ্টই জানিয়েছেন, কোনও সরকার এই সমস্যা দূর করতে না পারলে মানুষ সেই সরকারকে সরিয়ে দেবে। কিন্তু তারই সঙ্গে তিনি এ-ও বলেছেন যে, মানুষের সেবার নামে ভণ্ডামি করাটা একই রকম বিপজ্জনক। রাষ্ট্রপতির কথায়, “নির্বাচন কাউকে অবাস্তব ভাবনা নিয়ে খেলা করার অধিকার দেয় না। অবাস্তব প্রতিশ্রুতি দিলে মানুষের মোহভঙ্গ হয়। তখন যারা ক্ষমতাসীন, তারাই বিপদে পড়ে।” দলীয় রাজনীতির গণ্ডি থেকে সরে এলেও রাষ্ট্রপতির এ দিনের বক্তৃতায় গণতন্ত্রে রাজনীতির কাঠামোটা কী হওয়া উচিত, তারই একটা দিশা দেওয়ার চেষ্টা স্পষ্ট। একে আপ-এর মতো দল বা আঞ্চলিক দলগুলির অবাস্তব প্রতিশ্রুতি ও আচরণের বিরুদ্ধে জোরালো বার্তা বলেই ধরে নিচ্ছে দেশের প্রধান দুই দল কংগ্রেস ও বিজেপি। স্বাভাবিক ভাবেই রাষ্ট্রপতির এই বক্তৃতায় তারা উচ্ছ্বসিত।
অরুণ জেটলির মতে, “আপের কার্যকলাপের বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টেও পৌঁছে গিয়েছে। আজ রাষ্ট্রপতিকেও তা নিয়ে মুখ খুলতে হল।” কংগ্রেস নেতা শাকিল আহমেদের কথায়, “নৈরাজ্যবাদী শক্তির উত্থানের আমরা বরাবরই বিরোধী। আজ রাষ্ট্রপতিও তা নিয়েই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন।”
কিন্তু কী বলছে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল? টুইটারে আপ নেতা যোগেন্দ্র যাদবের বক্তব্য, “রাষ্ট্রপতি আপকে উদ্দেশ করে কথা বলেছেন, এটা ভাবা ঠিক নয়। তিনি দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে। সরকার তো সত্যিই দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয়। জনকল্যাণই সরকারের অধিকার। রাষ্ট্রপতির কথা সব সময়েই ঠিক।”
মুখে এ কথা বললেও আপ নেতৃত্ব যে ঘোর অস্বস্তিতে, সারা দিনের ঘটনাপ্রবাহেই তা পরিষ্কার। এমনকী এই প্রথম বিদেশিনি নিগ্রহ-কাণ্ডে নিজের ভুল স্বীকার করে নিয়েছেন দিল্লির বিতর্কিত আইনমন্ত্রী সোমনাথ ভারতী। প্রণববাবুর বক্তৃতার কয়েক ঘণ্টা আগে সাকেত কোর্টের একটি অনুষ্ঠানে সোমনাথ বলেন, “সাধারণ মানুষের অভিযোগ পেয়েই সে দিন গিয়েছিলাম জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। কিন্তু কী ভাবে কাজটা করা উচিত ছিল, জানতাম না। তা হলে হয়তো এই ভুল অভিযোগগুলো আমার বিরুদ্ধে উঠত না। আমি সিস্টেমে নতুন। কেউ আমাকে একটু সাহায্য করুন না।”
সম্প্রতি দক্ষিণ দিল্লির একটি বাড়িতে মাঝরাতে চড়াও হয়ে সেখানে মাদক ও যৌন ব্যবসা চালানো হচ্ছে বলে শোরগোল করেন সোমনাথ। পুলিশকে তল্লাশি চালাতে চাপ সৃষ্টি এবং ওই বাড়ির বাসিন্দা চার বিদেশিনির শ্লীলতাহানিরও অভিযোগ ওঠে তাঁদের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে গত কয়েক দিন যাবত্ সোমনাথ যে ভাষা ও ভঙ্গিতে আত্মপক্ষ সমর্থন করে গিয়েছেন, আজ তাঁর ভুল স্বীকারের ধরন ছিল লক্ষণীয় রকমের আলাদা। এবং কিছুটা কৌশলীও।
তবে ভুল কবুলের আগে, এ দিন সকালেই সোমনাথের আরও একটি বিতর্কিত মন্তব্য নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। ইস্তফা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মেজাজ হারিয়ে এক সাংবাদিককে তিনি বলে বসেন, “এই প্রশ্নটা করার জন্য মোদী আপনাকে কত টাকা দিয়েছেন?” পরে অবশ্য ওই মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চান সোমনাথ। এ বারও তিনি নিজের সদ্য তৈরি হওয়া ভাবমূর্তির উল্টো পথে হেঁটে বলেন, “ভুল করে বলে ফেলেছি। ওই কথা বলা উচিত হয়নি। আমার মন্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।”
কিন্তু সোমনাথের মতোই আজ সংবাদমাধ্যমকে একহাত নেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালও। তিনি বলেন, “সাংবাদিকরাই আমাকে বলছেন, আপের বিরুদ্ধে খবর করার জন্য তাঁদের উপর চাপ দেওয়া হচ্ছে। কাগজের বিক্রি বাড়ানোর জন্য সম্পাদকরা তাঁদের এটা করতে বলছেন। সোমনাথের ওই কথা বলা উচিত হয়নি। তবে সংবাদমাধ্যমেরও তাঁর পিছু নেওয়া বন্ধ করা উচিত।”
মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যের পর আজ আপ-এর বিরুদ্ধে অসহিষ্ণুতার অভিযোগ তোলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। তাদের মতে, ক্ষমতার অলিন্দে থাকলে সমালোচনাও যে সহ্য করতে হয়, সেই সত্যিটাই এখনও বুঝে উঠতে পারেনি আপ শিবির। সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, “এত দিন সংবাদমাধ্যম যখন আপ-এর পক্ষে বলছিল তখন কোনও অসুবিধে ছিল না। এখন বিপক্ষে বলতেই সমস্যা?”
শুধু সংবাদমাধ্যমকে আক্রমণই নয়, ধর্নায় বসা নিয়ে নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ খণ্ডনেও আজ তত্পর হন কেজরিওয়াল। আজ প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে এক অনুষ্ঠানকেই জবাব দেওয়ার মঞ্চ হিসেবে বেছে নেন কেজরিওয়াল। তিনি বলেন, “অনেকে বলছেন আমি ধর্নায় বসে সংবিধান-বিরোধী কাজ করেছি। কিন্তু আমি ফের এক বার সংবিধান পড়লাম। কিন্তু সেখানে কোথাও লেখা নেই যে মুখ্যমন্ত্রী ধর্নায় বসতে পারবেন না। বরং আমার ধর্নায় ১৪৪ ধারা জারি করা সংবিধান-বিরোধী কাজ।” একই সঙ্গে তিনি আজ দাবি করেন, তাঁর এক মাসের সরকারে দিল্লিতে দুর্নীতি অনেক কমে গিয়েছে। অটোচালক, চা-বিক্রেতারা তাঁকে জানিয়েছেন, পুলিশ তাঁদের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। দুর্নীতি একেবারে মুছে দিতে আগামী মাসে জন-লোকপাল বিল নিয়ে আসবে সরকার।
এই জন-লোকপাল বিল নিয়েও আজ দিল্লি পুলিশের সঙ্গে কেজরিওয়ালের আর এক প্রস্ত সঙ্ঘাতের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। জন- লোকপাল বিলের দাবিতে আন্দোলনে নেমেই সর্বভারতীয় রাজনীতিতে উত্থান কেজরিওয়াল ও তাঁর দলের। তাই যে রামলীলা ময়দান থেকেই ওই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, সেখানেই ‘জনতার মাঝে’ বিলটি পাশ করানো হবে বলে আজ ঘোষণা করেন কেজরিওয়াল।
দিল্লি পুলিশের আপত্তি সত্ত্বেও আপ নেতৃত্ব এখনও সেই অবস্থানে অনড়। তাঁদের পাল্টা যুক্তি, এই রামলীলাতেই ক’দিন আগে বিজেপি-র জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠক হয়েছে। সেখানে শুধু নরেন্দ্র মোদীই নন, বিজেপি-র তাবড় নেতা উপস্থিতি ছিলেন। তখন নিরাপত্তা নিয়ে কোনও আপত্তি জানায়নি পুলিশ। স্রেফ সঙ্কীর্ণ রাজনীতির জন্যই কেন্দ্রের নির্দেশে পুলিশ এখন আপত্তি জানাচ্ছে। কেজরিওয়ালরা যখন বিজেপি-র অধিবেশনের যুক্তি দেখাচ্ছেন, তখন রামলীলা-প্রসঙ্গে তাঁদের বিঁধেছেন দিল্লির দায়িত্বপ্রাপ্ত কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক শাকিল আহমেদ। তিনি বলেন, “কেজরিওয়াল পুলিশকে মুচলেকা দিন, রামলীলায় জান-মালের ক্ষতি হলে সব দায় তাঁর। কেজরিওয়ালদের ব্যাপারটা হল এ রকমই। কোনও কিছু পছন্দ না হলেই বলবেন সংবাদমাধ্যম বিকিয়ে গিয়েছে।” |
|
|
|
|
|