|
|
|
|
একশোরও নীচে নেমে যেতে পারে কংগ্রেস
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
লোকসভা নির্বাচনের রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেশ জুড়ে শুরু হয়ে গিয়েছে জনমত সমীক্ষা। কে কত আসন পাবে, সেই আনুমানিক হিসেবে উনিশ-বিশ ফারাক থাকলেও সব সমীক্ষার মূল বক্তব্য একটাই। তা হল, কংগ্রেসের প্রতি মানুষের আস্থা তলানিতে ঠেকেছে এবং একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে উঠে আসছে বিজেপি।
এটা ঠিক, যে জনমত সমীক্ষার পূর্বাভাস অনেক সময়ই মেলে না। তা ছাড়া ভোটের এখনও আড়াই-তিন মাস বাকি। ফলে অনেক অঙ্কই শেষ পর্যন্ত বদলে যেতে পারে। কিন্তু ভোটারদের মনোভাবের আঁচ পেতে এই জনমত সমীক্ষার গ্রহণযোগ্যতা মোটামুটি ভাবে স্বীকৃত। আর সেই সমীক্ষার ফল জানাচ্ছে, এখনই লোকসভা নির্বাচন হলে অভূতপূর্ব ভাল ফল করতে পারে বিজেপি। অভূতপূর্ব এই কারণেই যে বাজপেয়ী-জমানার থেকেও দলকে বেশি
আসনে জয় এনে দিতে পারেন নরেন্দ্র মোদী। পাল্লা দিয়ে খারাপ ফল হতে পারে কংগ্রেসের। এই প্রথম কংগ্রেসের আসন সংখ্যা একশোরও নীচে চলে যেতে পারে। এক মাত্র দক্ষিণ ভারত বাদ দিলে উত্তর, মধ্য, পূর্ব বা পশ্চিম দেশের সব অংশেই কংগ্রেস তথা ইউপিএ-কে পিছনে ফেলে দিতে পারে বিজেপি তথা এনডিএ জোট।
বিজেপি নেতৃত্বের দাবি, জনমত সমীক্ষা থেকেই স্পষ্ট যে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদীই দেশের মানুষের পছন্দ। দেশ জুড়ে আক্ষরিক অর্থেই মোদী-ঢেউ উঠেছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এর পরেও কি মোদী স্থায়ী সরকার গড়তে পারবেন? জনমত সমীক্ষাগুলি খতিয়ে দেখলে বলা যায়, বিজেপি যদি এনডিএ জোটের পুরনো শরিকদের ফিরিয়ে আনতে পারে এবং টিআরএস-এর মতো নতুন শরিকদের কাছে টানতে পারে, তা হলে মোদীর প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসা হয়তো কঠিন হবে না। আর একটি তাত্পর্যপূর্ণ বিষয় হল, আগামী লোকসভায় তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে উঠে আসতে পারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস। সমীক্ষাগুলির অনুমান, তৃতীয় বৃহত্তম দল হওয়ার দৌড়ে জয়ললিতা, মায়াবতী ও মুলায়মের দলকে পিছনে ফেলে দিতে পারেন মমতা। লোকসভা নির্বাচনে আম আদমি পার্টি (আপ) কী করবে, সেটাও বড় প্রশ্ন। সমীক্ষাগুলি বলছে, দিল্লির বাইরে উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, চণ্ডীগড় ও মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যে একটি-দু’টি করে আসন পেতে পারে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল। তবে দেশ জুড়ে আপ তেমন প্রভাব না-ও ফেলতে পারে।
গত কাল আইবিএন-সিএসডিএস ও ইন্ডিয়া টুডে-সি ভোটারের জনমত সমীক্ষা প্রকাশ হয়েছিল। আজ এবিপি আনন্দ-এসি নিয়েলসেনের দেশ জোড়া জনমত সমীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। দেশ জুড়ে ২৮০টি লোকসভা কেন্দ্রে ৬৪ হাজার ৬ জনের মতামতের ভিত্তিতে সমীক্ষা করেছে তারা। আইবিএন-সিএসডিএস-এর সমীক্ষা যেখানে এনডিএ জোটের সম্ভাব্য আসন প্রাপ্তি দেখাচ্ছে ২১১ থেকে ২৩১, সেখানে ইন্ডিয়া টুডে-সি ভোটার জানাচ্ছে, এই জোট পেতে পারে ২০৭ থেকে ২১৭টি আসন। আর এবিপি আনন্দ-এসি নিয়েলসেনের সমীক্ষা বলছে, এনডিএ জোট পেতে পারে ২২৬টি আসন। যার মধ্যে বিজেপি একাই পেতে পারে ২১০টি আসন। অন্য দিকে কংগ্রেস-সহ ইউপিএ জোটকে আইবিএন-সিএসডিএস-এর সমীক্ষা ১০৭ থেকে ১২৭টি আসন দিলেও ইন্ডিয়া টুডে-সি ভোটার দিয়েছে ৯৮ থেকে ১০৮টি আসন। আর এবিপি আনন্দ-এসি নিয়েলসেনের বক্তব্য, ইউপিএ জোট পেতে পারে মাত্র ১০১টি আসন। এবিপি আনন্দ-এসি নিয়েলসেনের দাবি, তৃণমূল পেতে পারে ২৬টি আসন। বামেরা সব মিলিয়ে ৩০টি আসন জিততে পারে বলে জানিয়েছে ওই সমীক্ষা। দিল্লির ৭টির মধ্যে ৬টি-সহ আপ পেতে পারে মোট ১১টি আসন। এবিপি আনন্দ-এসি নিয়েলসেনের সমীক্ষায় ৫৩ শতাংশই জানিয়েছেন, তাঁরা মোদীকে প্রধানমন্ত্রীর গদিতে চাইছেন। রাহুলকে চাইছেন মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ। ৫ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন, তাঁরা অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান। মজার কথা হল, রাজধানী দিল্লিতে ৪১ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন, তারা কেজরিওয়ালকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান। বাকিরা মোদীকে। রাহুলের পক্ষে প্রায় কেউই মত দেননি! তিনটি সমীক্ষার ফলে আসন সংখ্যায় কম-বেশি ফারাক থাকলেও একটি বিষয়ে কোনও পার্থক্য নেই। তা হল, বিজেপি ও কংগ্রেসের মধ্যে প্রায় ১০০টি আসনের ফারাক থাকতে পারে। কংগ্রেসের সঙ্গেই ইউপিএ-র শক্তিও ক্ষয় হবে।
দুর্নীতি, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ ও কর্মসংস্থান যে আগামী লোকসভা ভোটের অন্যতম নির্ধারক বিষয় হতে চলেছে, তা জনমত সমীক্ষা থেকে স্পষ্ট। এই সবক’টি ক্ষেত্রেই মনমোহন-সরকারের ব্যর্থতার মাসুল দিতে হচ্ছে কংগ্রেস তথা ইউপিএ-নেতৃত্বকে। উল্টো দিকে সুশাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মোদী যে তাঁর প্রচারে ভোটারদের উপর প্রভাব ফেলেছেন, তা-ও স্পষ্ট। এবিপি আনন্দ-এসি নিয়েলসেনের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, অধিকাংশ মানুষই আশা করছেন, বিজেপি ক্ষমতায় এসে মূল্যবৃদ্ধিকে লাগাম পরাতে পারবে। উল্টো দিকে কংগ্রেস তথা ইউপিএ-সরকারের প্রতি যে মানুষের আস্থা নেই, তা-ও সমীক্ষা থেকে স্পষ্ট। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বা ইউপিএ-নেত্রী সনিয়া গাঁধী, কারও কাজকেই মানুষ খুব বেশি নম্বর দিতে চাইছেন না। দেশের একটা বড় অংশের মানুষই মনমোহন তথা ইউপিএ-র কাজকে ‘খারাপ’ থেকে ‘খুব খারাপ’-এর গোত্রে ঠেলেছেন। এবিপি আনন্দ-এসি নিয়েলসেনের সমীক্ষায় ৫২ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন, অতীতের এনডিএ-সরকার বর্তমান ইউপিএ-সরকারের তুলনায় অনেক ভাল ছিল।
লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ২৭২-এর ম্যাজিক সংখ্যা। বর্তমান চেহারার এনডিএ এতগুলি আসন পাবে বলে কোনও সমীক্ষাই মনে করছে না। যা থেকে স্পষ্ট, পাঁচ বছরের জন্য স্থায়ী সরকার গড়তে হলে বিজেপিকে নতুন শরিকের সন্ধানে নামতেই হবে। আজ প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে বক্তৃতায় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ও স্থায়ী সরকারের প্রয়োজনীয়তা মনে করিয়ে দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের পরে স্থায়ী সরকার না এলে বিপর্যয় হবে। মোদীর নেতৃত্বে এনডিএ-সরকার গঠিত হলেও বিজেপিকে যে আঞ্চলিক দলগুলির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে, তা-ও জনমত সমীক্ষার সমীকরণ থেকে স্পষ্ট। গত দশ বছরে ইউপিএ-সরকারকেও শরিকদের উপর এই নির্ভরশীলতার মাসুল গুনতে হয়েছে। যে কথা মনে করিয়ে দিয়ে আজ রাষ্ট্রপতি বলেছেন, “সুবিধাবাদী শরিকদের খামখেয়ালিপনার উপর নির্ভরশীল দুর্বল সরকার সব সময়ই খারাপ পরিস্থিতি ডেকে আনে। ২০১৪ সালে তা হলে বিপর্যয় হতে পারে।”
বিজেপি নেতাদের দাবি, মোদীর নেতৃত্বে তাঁরা ম্যাজিক সংখ্যা ছোঁয়ার ‘মিশন ২৭২’ নিয়ে মাঠে নেমেছেন। শুধু দেশের মানুষ নন, শিল্পমহলও মোদীতেই আস্থা রাখছেন। কংগ্রেসের দুর্নীতি ও মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার বিরুদ্ধে মোদীই প্রধান মুখ। কাজেই ভোট বাড়াতে অসুবিধা হবে না। বিজেপি নেত্রী স্মৃতি ইরানির দাবি, “আগামী তিন মাসে সংগঠনের শক্তি আরও বাড়বে। আমরা আরও জোরদার প্রচারে যাব। ভোটের পরিমাণও বাড়বে।” এনডিএ-র সম্ভাব্য শরিকের তালিকায় রয়েছে এডিএমকে, তেলুগু দেশম, টিআরএস ও বিজেডি। এই চারটি দল মিলে ৫০টিরও বেশি আসনে জিতে আসতে পারে বলে সব জনমত সমীক্ষাই একমত। অন্ধ্রে জগন্মোহন রেড্ডির ওয়াইএসআর-কংগ্রেসও এনডিএ-তে যোগ দিতে পারে বলে জল্পনা চলছে। এবিপি আনন্দ-এসি নিয়েলসেনের সমীক্ষা বলছে, অন্ধ্রের ২২টি আসনে জিততে পারে জগনের দল। বিজেপি নেতাদের
যুক্তি, অনেক রাজনৈতিক দলই এখন দোটানার মধ্যে রয়েছেন। আর কিছু ছোট দল রয়েছে, যারা বরাবর ক্ষমতাসীন সরকারের সঙ্গে থাকতে চায়। দেশ জুড়ে মোদী-ঢেউ উঠলে এবং তাঁর নেতৃত্বে সরকার হলে এরাও এনডিএ-তে যোগ দেবে। কাজেই স্থায়ী সরকার গড়তে অসুবিধা হবে না।
কংগ্রেস নেতৃত্ব সরকারি ভাবে কোনও জনমত সমীক্ষার ফলকেই মানতে রাজি নন। কংগ্রেসের আসন সংখ্যা একশোর নীচে নেমে যাবে, এমন তত্ত্বও খারিজ করে দিচ্ছেন তাঁরা। প্রকাশ্যে তাঁদের দাবি, রাহুল গাঁধী সবে তেড়েফুঁড়ে প্রচারে নেমেছেন। যত সময় যাবে, কংগ্রেসের দিকেই হাওয়া ঘুরবে। কিন্তু ঘরোয়া আলোচনায় কোনও কংগ্রেস নেতাই খুব একটা ভাল ফলের আশা করছেন না। রাহুল-ঘনিষ্ঠ এক কংগ্রেস নেতার মতে, এখন লোকসভা নির্বাচন হলে বিজেপি ১৬০টি আসন পাবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা বেড়েও যেতে পারে। উল্টো দিকে কংগ্রেসের আসন সংখ্যা ১৪০-এর নীচেই থাকবে বলে ধারণা ওই নেতার। খাদ্যের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, তথ্যের অধিকারের মতো আইন এনে আম জনতার মন জয়ের চেষ্টা করেছিলেন সনিয়া গাঁধী। এ বারও এই সব আইনই কংগ্রেসের অন্যতম অস্ত্র। কিন্তু তাতে খুব বেশি ফল মিলবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সমীক্ষায় তিন ভাগের এক ভাগের মত, এ সবই রাজনৈতিক চমক। অন্য এক-তৃতীয়াংশের মতে, সঠিক রূপায়ণ হলে তবেই এই সব আইনের সুফল মিলতে পারে।
সব শক্তি দিয়েও কি মোদী-ঢেউ রুখতে পারবেন রাহুল? এবিপি আনন্দ-এসি নিয়েলসেনের সমীক্ষা বলছে, শুধু আসন নয়, কংগ্রেস তথা ইউপিএ-র ভোটের হারও ভাল মাত্রায় কমতে পারে। এখনই লোকসভা ভোট হলে ইউপিএ মাত্র ২৩ শতাংশ ভোট পেতে পারে। ২০০৯ সালে ইউপিএ পেয়েছিল ৩১.৫ শতাংশ ভোট। অন্য দিকে এনডিএ-র ভোটের হার ২১.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩১ শতাংশে পৌঁছতে পারে। সমীক্ষা অনুযায়ী, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশের মতো বড় রাজ্যগুলিতে লাভবান হতে পারে বিজেপি। অন্য দিকে অন্ধ্র, তামিলনাড়ু, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও দিল্লিতে কংগ্রেসের আসন কমতে পারে বলে ইঙ্গিত সমীক্ষায়।
বিভিন্ন জনমত সমীক্ষা থেকে আরও একটি বিষয় স্পষ্ট। তা হল, দেশের একটা বড় অংশের মানুষ কংগ্রেস ও বিজেপির বাইরে তৃতীয় শক্তি বা আঞ্চলিক দলগুলির উপর ভরসা রাখছেন। কোথাও তার সুবিধা পাচ্ছে এডিএমকে, কোথাও আম আদমি পার্টি। এবিপি আনন্দ-এসি নিয়েলসেনের সমীক্ষা অনুযায়ী, আঞ্চলিক দলগুলি সব মিলিয়ে প্রায় ৪১ শতাংশ ভোট পেতে পারে। যা এনডিএ বা ইউপিএ-র থেকে বেশি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো জয়ললিতাও অনেক আসন পেতে পারেন। কিন্তু বিজেপির সঙ্গ ত্যাগ করে নীতীশ কুমারের সমস্যা হতে পারে বলে ইঙ্গিত সমীক্ষায়। বিহারে জেডি (ইউ)-র তুলনায় বিজেপি অনেক বেশি এগিয়ে থাকবে বলে সমীক্ষাগুলির মত। উত্তরপ্রদেশে বিজেপির শক্তিবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভোট কমতে পারে মুলায়মের। তবে ঝুলিতে সব থেকে বেশি ভোট গেলেও সব আঞ্চলিক দল মিলে একজোট হয়ে সরকার গঠন সম্ভব হবে না বলেই মনে করছেন অনেকে। তাঁদের ব্যাখ্যা, বাম যেখানে থাকবে, সেখানে তৃণমূল যাবে না। আবার সপা-বিএসপি এক দিকে যাবে না বলেই মনে হয়। ভোট এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বা লোকসভা নির্বাচনের পরে এই আঞ্চলিক দলগুলির কী ভূমিকা হতে চলেছে, সেটাও তাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। |
পুরনো খবর: জনমত সমীক্ষা, মোদী-ঝড়ের ইঙ্গিত উত্তরপ্রদেশে |
|
|
|
|
|