পথে নামলেন, নিজের মতো করে রোগ নির্ণয় করলেন, দাওয়াইও দিলেন পরিবহণমন্ত্রী। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেল, সেই দাওয়াইয়ে রোগ সারবে কি? তারই সঙ্গে প্রশ্ন উঠছে, পথে ঘুরে এই কাজ কি আদৌ মন্ত্রীর?
কলকাতার রাস্তায় যে অটোর লাগামছাড়া দৌরাত্ম্য চলছে, পরিবহণমন্ত্রী হওয়ার আড়াই বছর পরে শনিবার পথে নেমে তার খানিকটা আভাস পেলেন মদন মিত্র। দেখলেন, লাইসেন্স-পারমিট ছাড়াই চলছে বহু অটো। দক্ষিণ কলকাতার দু’-একটি জায়গায় গিয়ে কয়েক জন অটোচালকের সঙ্গে কথাও বললেন তিনি। অটোকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে এর পরেই কয়েকটি নতুন নিয়ম ঘোষণা করেন পরিবহণমন্ত্রী।
কিন্তু মন্ত্রী রাস্তায় নামলেই কি অটোর বহুমুখী ‘অসুখ’ সেরে যাবে? মন্ত্রী নিজেও অবশ্য তেমনটা মনে করেন না। এটা যে সমাধানের পথ নয়, তা-ও মেনে নিয়েছেন তিনি। তবু তিনি রাস্তায় নেমেছিলেন জনপ্রতিনিধি হিসেবে। তাঁর কথায়, “সমস্যা মেটাবে প্রশাসনই। কিন্তু কেন অটোচালকেরা এত হিংস্র হয়ে উঠছেন, তা বুঝতেই বেরিয়েছিলাম।” আবারও তাঁর আশ্বাস, সোমবার থেকে অটো-পরিস্থিতির উন্নতি হবে। ওই দিন প্রশাসন ও অটো ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি। |
শহরের পথে অটো-শাসনে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। শনিবার, হাজরায়।—নিজস্ব চিত্র। |
কলকাতা ও শহরতলি মিলিয়ে যে ৬০ হাজার অটো চলে, তার অর্ধেকেরই লাইসেন্স নেই। তিন চাকার এই যানের স্টিয়ারিং হাতে উঠলে প্রায় কোনও চালকই পথের নিয়ম মানেন না। অটোচালকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, বেশি লাভের জন্য তাঁরা একটি রুটকেই ভেঙে দু’তিন টুকরো করে যাত্রী তুলছেন। যাত্রীদের অভিজ্ঞতা হল, ভাড়া ও খুচরো নিয়ে অটোচালকদের অভব্য আচরণ ও অশালীন কথাবার্তা প্রায় সব রুটেই নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সম্প্রতি এ সমস্ত ছাপিয়ে অটোচালকদের হাতে যাত্রী-নিগ্রহের মতো ঘটনারও সাক্ষী থেকেছে এই শহর। এ দিন মন্ত্রী যখন রাস্তায়, তখন নিউ আলিপুরে অটোচালকের হাতে ফের এক তরুণীর নিগৃহীত হওয়ার অভিযোগ জমা পড়েছে পুলিশের কাছে।
মন্ত্রীর বক্তব্য, চালকদের এই হিংস্র হয়ে ওঠার কারণ বুঝতেই তিনি পথে নেমেছিলেন। কী অভিজ্ঞতা হল তাঁর? এ দিন বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ প্রথমে হাজরা মোড়ে হাজির হন মদনবাবু। সেখানে ফরিদ নামে এক অটোচালকের কাছে রুটের ভাড়া জানতে চান তিনি। ফরিদ জানান, পাঁচ কিলোমিটারের জন্য ভাড়া ছিল ১২ টাকা। জ্বালানির দাম বাড়ায় সম্প্রতি এক টাকা বাড়ানো হয়েছে। তাঁর লাইসেন্স এবং গাড়ির পারমিট নিয়ে মন্ত্রী প্রশ্ন করায় নিজেকে স্থানীয় তৃণমূলকর্মী পরিচয় দিয়ে ফরিদ জানান, আইন ভাঙার জন্য পুলিশ তাঁর লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত করেছে। সেটা ছাড়ানো হয়নি। আর পারমিট রয়েছে মালিকের বাড়িতে। যার অর্থ, বৈধ লাইসেন্স ও পারমিট ছাড়াই ওই চালক রোজ অটো চালাচ্ছেন। |
মদনের পঞ্চশর
|
• অটোয় চোখ ধাঁধানো আলো, তারস্বরে গান চলবে না |
• পারমিটহীন কোনও অটো রাস্তায় নামবে না |
• সচেতনতা বাড়ানোয় জোর |
• অটোচালকদের বৈধ কাগজ তৈরিতে সরকারি সাহায্য |
• অটো নিয়ে অভিযোগ জানাতে ১০৭৩ নম্বরে ফোন করা যাবে লালবাজারে |
|
মন্ত্রীর পরের গন্তব্য প্রিয়নাথ মল্লিক রোড-হাজরা রোডের মোড়। সেখানে রাজেশ বসু নামে এক অটোচালককে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন, হাজরা-বন্ডেল গেট রোডের তিন কিলোমিটার অটো রুটকে চার ভাগে ভাঙা হয়েছে। প্রতি ভাগের ভাড়া ৯ টাকা করে। অর্থাৎ, তিন কিলোমিটারের খরচ ৩৬ টাকা। রাজেশও লাইসেন্স-পারমিট দেখাতে পারেননি মন্ত্রীকে। বালিগঞ্জ-হাজরা এবং রাসবিহারী-বেহালা রুটের অটোচালকদের কাছে গিয়েও একই অভিজ্ঞতা হয়েছে মন্ত্রীর। দেখেছেন, কী ভাবে নিয়ম ভেঙে নতুন স্ট্যান্ড গজিয়ে উঠেছে। অটোর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা যাত্রীদের কাছ থেকে জেনেছেন চালকদের দুর্ব্যবহার-অশালীন আচরণের কথা। পরে যাত্রীরা জানান, অটো-দৌরাত্ম্য নিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের কাছে বারবার অভিযোগ জানিয়েও লাভ হয় না। যথেচ্ছ আইন ভাঙলেও ইউনিয়নের হস্তক্ষেপে অটোকে জরিমানা করতে পর্যন্ত ভয় পায় ট্রাফিক পুলিশ।
অটোর দাদাগিরির মূল কারণ ‘রাজনৈতিক’ বলেই মনে করে পরিবহণ দফতরের একাংশ। তাঁদের মতে, বাম আমলে অটো নিয়ন্ত্রণ করত সিটু। ২০১১ সালে রাজ্যে পালাবাদলের পরে নিয়ন্ত্রণ যায় তৃণমূলের হাতে। এ দিনও যে অটোচালকদের কাছ থেকে লাইসেন্স-পারমিট পাননি মন্ত্রী, তাঁরা প্রত্যেকেই নিজেদের তৃণমূলকর্মী বলে পরিচয় দিয়েছেন।
বাসভাড়া বৃদ্ধির দাবি নিয়ে মালিক-সরকার টানাপোড়েনে বাসের সংখ্যা কমে যাওয়ায় কার্যত শহরে এখন অটোই গণপরিবহণ হয়ে উঠেছে। এক নিত্যযাত্রীর কথায়, “অফিসটাইমে বাসের জন্য দাঁড়ানোর সময় কোথায়! তখন অটোই ভরসা।” অথচ, এই অটোকে এখনও আইনের বেড়াজালে বাঁধতে পারেনি প্রশাসন। শহরে কত অটো চলে, সেই তথ্যও পরিষ্কার নয়।
পরিবহণমন্ত্রী এর আগে অটো নিয়ন্ত্রণে বারবার কমিটি করলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। এখন অবাধ্য অটোকে বাগে আনতে নির্বিচারে ধরপাকড় শুরু করলে তিন চাকার এই যানও উধাও হয়ে যাবে না তো, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছে পুলিশ। |