বামেদের ক্ষয় অব্যাহত, ভোট বাড়ছে বিজেপির
পুজোর বেশ আগে থেকেই যেমন বাদ্যি বাজা শুরু হয়ে যায়, লোকসভা ভোটের ক’মাস আগেই তেমনই শুরু হয়ে গিয়েছে জনমত সমীক্ষার পর্ব! এবং বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের করা জনমত সমীক্ষার যে ফল গত ক’দিন ধরে প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে রাজ্য রাজনীতির সাম্প্রতিক ধারা মেনে এক নম্বরে তৃণমূলই। যদিও দলের অন্দরের আলোচনায় যতটা সাফল্য আশা করছেন তৃণমূল নেতারা, ততটা ভাল ফলের ইঙ্গিত দিচ্ছে না কোনও সমীক্ষাই। বাম ভোটের ক্ষয় অবশ্য অব্যাহতই থাকছে। আর শতাংশের হিসেবে বিজেপি-র ভোট অনেকটা বাড়ার কথা বললেও আসনের নিরিখে তাদের তেমন কোনও লাভের কথা শোনাচ্ছে না জনমত সমীক্ষা।
এটা ঠিক যে, জনমত সমীক্ষার পূর্বাভাস অনেক সময়ই মেলে না। তা ছাড়া, ভোটের এখনও বেশ কয়েক মাস দেরি। ফলে অনেক অঙ্কই শেষ পর্যন্ত বদলে যেতে পারে। কারণ, অনেকেরই মতে, শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের জোট বা অন্য সমঝোতা হবে কি না, তা নিয়ে শেষ কথা বলার সময় এখনও আসেনি। তা সত্ত্বেও ঠিক এই মুহূর্তে ভোটারদের মনোভাব কী, তার একটা আঁচ পেতে জনমত সমীক্ষার গ্রহণযোগ্যতা মোটামুটি ভাবে স্বীকৃত।
লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গের ফল নিয়ে আজ তক-সি ভোটার, সিএনএন-আইবিএন সিএসডিএসের সমীক্ষা ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। এ দিন প্রকাশিত হল এবিপি আনন্দ-এ সি নিয়েলসেনের সমীক্ষা। সব ক’টি সমীক্ষাই হয়েছে, রাজ্যে কোনও জোট হবে না, এটা ধরে নিয়ে। এবং তৃণমূলের নিরিখে তিনটি সমীক্ষার ফলই খুব কাছাকাছি।

এবিপি আনন্দের সমীক্ষা বলছে, এখনই ভোট হলে রাজ্যের ৪২টি আসনের মধ্যে তৃণমূল পেতে পারে ২৬টি। আজ তক তাদের ২৩টি এবং সিএনএন-আইবিএন ২০ থেকে ২৮টি আসন দিয়েছে। তৃণমূলের নিজের হিসেব কিন্তু বলছে, এর থেকে অনেক বেশি আসন তারা পাবে। এবং একা লড়েই। কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্কচ্যুতি বা বিজেপি-র সম্ভাব্য উত্থান, কিছুই তাদের ৩৫টির কাছাকাছি আসন পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হবে না। প্রসঙ্গত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইউপিএ-২ সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়ার পরে কংগ্রেস ও তৃণমূল জোট-হীন অবস্থায় আলাদা লড়বে, এমনটা ধরে নিয়ে গত বছর মে মাসে একটি সমীক্ষা করেছিল এবিপি আনন্দ-এ সি নিয়েলসেন। সেখানে দেখা গিয়েছিল, বামফ্রন্ট পেতে পারে ১৮টি আসন। তৃণমূল ১৪টি এবং কংগ্রেস ৯টি। এ বারের সমীক্ষার সঙ্গে তুলনা করলে বোঝা যাচ্ছে, এই সময়ের মধ্যে বাম ও কংগ্রেসের ভোট আরও কমে ফায়দা হয়েছে তৃণমূলেরই। তবে ততটা হয়নি, যতটা তৃণমূল নেতৃত্ব আশা করছেন। তৃণমূলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন অবশ্য বলছেন, “সার্বিক ভাবে ভাল কাজ এবং উন্নয়নের ভিত্তিতে বাংলার মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর দলকে দু’হাত ভরে আশীর্বাদ করবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস। সিপিএম, কংগ্রেস বা বিজেপি, কেউই এখানে বাধা হতে পারবে না।”
রাজ্যের শহর ও গ্রামাঞ্চলে মোট ৪৮৭৭ জনের মতামতের ভিত্তিতে তৈরি এবিপি আনন্দের সমীক্ষা কিন্তু বলছে, তৃণমূলকে কোনও একটা জোটের শরিক হওয়ার পক্ষে রায় দিয়েছেন অধিকাংশ মতদাতা। ২৮ শতাংশের মতে বিজেপি-র সঙ্গে গেলে তৃণমূলের লাভ হতে পারে। কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলানোর পক্ষে রায় দিয়েছেন ২৪ শতাংশ মতদাতা। আর ১৯ শতাংশ মতদাতা বলেছেন তৃণমূলের তৃতীয় ফ্রন্ট গঠন করা উচিত। বাকিরা কোনও মতামত দেননি। (পাশাপাশি, সারদা-কাণ্ড তৃণমূলের ফলাফলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করেছেন ৪২% উত্তরদাতা। প্রভাব ফেলবে না বলেছেন ৩৮%।)
তৃণমূলের শীর্ষ নেতারা অবশ্য এ দিনও জোর গলায় জানিয়েছেন, তাঁরা একলাই চলবেন। একক ভাবে তৃণমূলের পাশে যে বাংলার মানুষ আছেন, সাম্প্রতিক কালে লোকসভা ও বিধানসভার উপনির্বাচন, পঞ্চায়েত ও পুরভোটে তা প্রমাণিত বলেই তাঁদের মত। কিন্তু ঘটনা হল, গত লোকসভা ভোটে কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের পক্ষে পড়েছিল প্রায় সাড়ে চুয়াল্লিশ শতাংশ ভোট। ২০১১-র বিধানসভা ভোটে যা বেড়ে হয় ৪৮ শতাংশ। আর এবিপি আনন্দের সমীক্ষা বলছে, একলা লড়লে এ বার তৃণমূল ৪১ শতাংশ ভোট পেতে পারে।
শেষ পর্যন্ত যদি কংগ্রেস-তৃণমূল কোনও সমঝোতা না-হয়, তা হলে বাম শিবিরের পক্ষে সেটা মস্ত স্বস্তির খবর হবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কারণ, ২০০৯-এর লোকসভা ভোট থেকে তাদের যে ক্ষয় শুরু হয়েছিল, তা এখনও অব্যাহত। এবিপি আনন্দ বলছে, বামেরা এ বার ১৩টি আসন পেতে পারে। গত বারের তুলনায় দু’টি কম। আজ তক তাদের ১৬টি এবং সিএনএন-আইবিএন ৭ থেকে ১৩টি আসন দিয়েছে। আসনের হিসেবে বামেদের ক্ষতি তেমন বড় বলে মনে না-হলেও ভোট শতাংশের নিরিখে তাদের চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। গত লোকসভা ভোটে তাদের ভোট ছিল ৪৩ শতাংশ। বিধানসভা ভোটে তা কমে হয় ৪১ শতাংশ। এ বার বাম ভোট আরও কমে ৩৪ শতাংশ হতে পারে বলে এবিপি আনন্দের সমীক্ষার পূর্বাভাস। কংগ্রেস-তৃণমূল সমঝোতা হলে বাম ভোটের ক্ষয় আরও গভীর হবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
বাম শিবির অবশ্য প্রকাশ্যে এই সমীক্ষাকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য, “এই মুহূর্তে যে কোনও জনমত সমীক্ষারই সমস্যা হল, আগের কোন নির্বাচনকে ভিত্তি ধরে জনমত যাচাই করা হবে? গত বারের লোকসভা বা বিধানসভা ভোটের সঙ্গে এখনকার পরিস্থিতির মিল নেই। আবার পঞ্চায়েত বা পুরভোটকে মাপকাঠি ধরা যাবে না, কারণ, সেখানে সুষ্ঠু ভোটই হয়নি!” তাঁর মতে, পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন দ্রুত পরিবর্তনশীল এবং সেই জন্যই জনমত সমীক্ষাকে প্রামাণ্য ধরে নেওয়ার কারণ নেই।
সমীক্ষাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না কংগ্রেস নেতারাও। তাঁরা কত আসন পেতে পারেন তা নিয়ে সমীক্ষাগুলির মধ্যে মতবিরোধও রয়েছে। এবিপি আনন্দ এবং আজ তক কংগ্রেসকে ২টি আসন দিলেও সিএনএন-আইবিএন বলছে তারা ৫ থেকে ৯টি আসন পেতে পারে। কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়ার দাবি, “আমাদের ৬টা আসন আমরা নিশ্চিত ভাবেই জিতব। তৃণমূলও এত আসন পাবে না!” বস্তুত, জোট না-হলে তৃণমূলের মতো তাঁদেরও ক্ষতি হবে, সমীক্ষার এই ইঙ্গিতকে পাত্তা না-দিয়ে একলা চলার সিদ্ধান্তে অনড় কংগ্রেস নেতারাও।
বিজেপি-র পক্ষে ভাল এবং খারাপ দু’রকম খবরই বয়ে এনেছে জনমত সমীক্ষা। মোদী-হাওয়ায় তাদের ভোটের হার ১১%-য় পৌঁছতে পারে বলে এবিপি আনন্দের সমীক্ষায় ইঙ্গিত। গত লোকসভায় যে হার ছিল ৬.২২% এবং বিধানসভায় প্রায় ৪%। রামমন্দিরের হাওয়ায় ১৯৯১ সালের লোকসভা ভোটে এ রাজ্যে বিজেপি সর্বাধিক ১০% ভোট পেয়েছিল। তার পরে ২০১২ সালে জঙ্গিপুর লোকসভার উপনির্বাচনে তারা ১০% ভোট পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সে বার তৃণমূলের কোনও প্রার্থী ছিল না।
কিন্তু ভোটের হারে এই বৃদ্ধি আসনের নিরিখে বিজেপির জন্য কোনও সুখবর আনছে না। এবিপি আনন্দ এবং আজ তকের সমীক্ষা তাদের কোনও আসনই দেয়নি। সিএনএন-আইবিএন বলেছে, বিজেপি ০ থেকে ২টি আসন পেতে পারে।
বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ অবশ্য মনে করছেন, “এই সমীক্ষার কোনও ভিত্তি নেই। অন্যান্য সমীক্ষায় বিজেপি-র ভোটের হার অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে। আমরা আসনও যে জিতব, তা-ও অন্যান্য সমীক্ষায় উঠে আসছে। আর যত দিন এগোবে, ততই মোদী-ঝড় উঠবে। আমরা সমীক্ষা নয়, মানুষের উপরে ভরসা রাখছি।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.