|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
মানুষের কথায় সজীব ইতিহাস |
বাংলার শিল্পকলা নিয়ে আলোচনা কম হয়নি। তবু দুই মলাটে প্রাচীন শিল্পনিদর্শনের ধারাবাহিক বিবরণ-বিশ্লেষণের অভাব ছিলই। প্রাচীন বাংলার মাটিতে পাথর পোড়ামাটি স্টুকো ধাতুনির্মিত মূর্তিভাস্কর্য, পট ও পুথিচিত্র, অন্যান্য বিচিত্র শিল্পের বিকাশ-বিস্তার নিয়ে কালক্রমিক আলোচনা করেছেন মলয়শঙ্কর ভট্টাচার্য, তাঁর আর্ট অ্যান্ড লাইফ: বেঙ্গল আর্ট থ্রু এজেস (সাগ্নিক বুকস, ১৬৫০.০০) বইয়ে। শতাধিক ছবি বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে।
বাংলার বিপুল লোকশিল্পের সম্ভার নিয়ে আলোচনার ঐতিহ্যে যুক্ত হল প্রদ্যোৎ ঘোষের ফোক আর্ট অব বেঙ্গল (দাশগুপ্ত অ্যান্ড কোং, ৮০০.০০)। বাংলার লোকঐতিহ্যের প্রেক্ষিত থেকে শুরু করে ভৌগোলিক-নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য খুঁটিয়ে দেখেছেন লেখক, চেয়েছেন লোকশিল্পকলার বহুপ্রসারী দিগন্তকে ছুঁয়ে দেখতে। পুতুল খেলনা হাঁড়ি সরা তুলসীমঞ্চ পট নকশি তাস আলপনা মুখোশ কাঠের কাজ বাড়িঘর জলটুঙ্গি বস্ত্রশিল্প শীতলপাটি শোলা ডোকরা শঙ্খশিল্প হাতির দাঁতের কাজ থেকে মাছধরার সরঞ্জাম পর্যন্ত তাঁর অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে। সঙ্গে আছে বহু ছবি।
বাংলার আঞ্চলিক ইতিহাসের বিস্তৃত ভুবন নিয়ে আলোচনা পুরোদমে চলছে। জেলায় জেলায় ক্ষেত্রানুসন্ধানীরা ব্যস্ত গ্রাম শহর জেলার ইতিবৃত্ত সংকলনে। চল্লিশ বছর ধরে বীরভূমের হাজার দুই গ্রামে ঘুরেছেন আদিত্য মুখোপাধ্যায়, সংগ্রহ করেছেন ইতিহাস-জনজীবনের তথ্য। তারই দেড়শো গ্রামের বিবরণ সংকলিত হয়েছে রাঙামাটির গ্রাম (বলাকা, ৪৩০.০০) বইয়ে। রাঢ়ের এই প্রাচীন ভূখণ্ডের অতীত এবং বর্তমানের চমৎকার সংযোগ তাঁর বইয়ে। শুষ্ক তথ্যের ভার তাকে নীরস করেনি, লালমাটির মানুষের কথা ইতিহাসকে সজীব করেছে। বলাকা থেকেই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বাংলার বহুরূপী (৩৫০.০০), সরেজমিন অনুসন্ধানে বোনা এক বর্ণময় জীবন জীবন-সংগ্রামের কাহিনি। এর আগে প্রকাশিত তাঁর রায়বেঁশে/ জীবন ও শিল্প (আনন্দ, ২০০.০০) লুপ্তপ্রায় ‘যুদ্ধনৃত্য’ রায়বেঁশের ইতিবৃত্ত। উত্তর দিনাজপুরের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন, বরেন্দ্রভূমির সঙ্গে বাংলার ইতিহাসের আদি পর্ব ওতপ্রোত। ভূপ্রকৃতি জীবজগৎ থেকে পুরাতত্ত্ব ইতিহাস হয়ে সমাজ সংস্কৃতি শিক্ষা, কৃষি ও অর্থনীতি নিয়ে বিভিন্ন গবেষকের কাজ একত্র করেছেন মলয়শঙ্কর ভট্টাচার্য (উত্তর দিনাজপুর চর্চা, নন্দিতা, ৪০০.০০)। উত্তর চব্বিশ পরগনার ঐতিহ্যশালী জনপদগুলির অন্যতম ছিল ছোট জাগুলিয়া। মনোমোহন বসু-ছবি বিশ্বাসের এই গ্রাম একদা ‘ছোট কলকাতা’ নামে অভিহিত হত। তারই পূর্ণাঙ্গ ইতিবৃত্ত সংকলনে ব্রতী হয়েছেন ভূমিপুত্র নীলরতন ঘোষ (ছোট জাগুলিয়ার ইতিবৃত্ত, পরি: জে এন ঘোষ অ্যান্ড সন্স, ২১০.০০)। তাঁর পুঙ্খানুপুঙ্খ ক্ষেত্রসমীক্ষা প্রশংসার দাবি রাখে। আর এক ভূমিপুত্র দেবানন্দ বিশ্বাস বলাগড়ের ইতিহাস (শ্রুতি, বলাগড়, ১২০.০০) স্থানিক বিবরণের সঙ্গে শিল্প শিক্ষা সংস্কৃতি ও বিশিষ্ট জনের কথা তুলে ধরেছেন। হুগলির এই ইতিহাস-সমৃদ্ধ এলাকার পরিচয় মেলে বইটিতে। সুকুমার মাইতির তাম্রলিপ্তের সাংস্কৃতিক ইতিহাস (পরি: প্রিটোনিয়া, ৪৫০.০০) প্রকাশ করেছে বিজন-পঞ্চানন সংগ্রহশালা ও গবেষণা কেন্দ্র। প্রায় পাঁচশো পাতার বইটিতে প্রাচীন তাম্রলিপ্ত থেকে আধুনিক মেদিনীপুরের তমলুক অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি ধর্ম লোকসংস্কৃতি ভাষা শাসনব্যবস্থা ও সাহিত্য চর্চা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। বাংলার শহরগুলি নিয়ে গবেষণা জরুরি— সেই লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ কাজ শহর মেদিনীপুরের কথা (সম্পা: তাপস মাইতি, উপত্যকা, মেদিনীপুর, ৭০০.০০)। ছ’শো পাতারও বেশি আয়তনে শহরের নানা দিকে আলো ফেলা হয়েছে ঘরবাড়ি/ প্রতিষ্ঠান, ধর্ম-পার্বণ, ভাষা, মিথ, সংস্কৃতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসন, পরিবহণ, জলাশয়, বিশিষ্ট জন সব কিছুর কথা। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার রাজপুর-সোনারপুর অঞ্চলের ইতিবৃত্ত সংকলিত হয়েছে জীবন মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত রাজপুর-সোনারপুর অতীত ও ঐতিহ্য ১ম খণ্ড (প্রোগ্রেসিভ, ১১০.০০) বইয়ে। মালঞ্চ, হরিনাভি, রাজপুর, বোড়ালের মতো প্রাচীন বসতি বিবরণের সঙ্গে আছে পুরাতত্ত্ব, ব্যক্তিত্ব, পাঠাগারের কথা। প্রণব সরকার ‘স্বদেশচর্চা লোক’ পত্রিকার মাধ্যমে দীঘর্র্ দিন তন্নিষ্ঠ আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন (‘বাংলার নদনদী, জলাশয়’ নিয়ে সংখ্যাটি খুবই উল্লেখযোগ্য), এ বার সোনারপুরের লোক প্রকাশন বার করেছে চব্বিশ পরগনা ও সুন্দরবন/ পুরনো ও দুষ্প্রাপ্য রচনা ১ (সম্পা: প্রণব সরকার, পরি: পুস্তক বিপণি, ২০০.০০)। অনেকগুলি মূল্যবান রচনার সমাবেশ এই বইয়ে। ওঁরাই ছেপেছেন সুভাষ মিস্ত্রী-র লোকায়ত সুন্দরবন ১ম খণ্ড (৩০০.০০), আছে লোকচিকিৎসা, গোয়াল পূজা, বনের সাজনের মতো বিচিত্র প্রসঙ্গ। জন ক্লার্ক মার্শম্যানের বঙ্গদেশের পুরাবৃত্ত (বলাকা, ২০০.০০) ফণী পালের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে। ১৮৫৯-এ শ্রীরামপুর থেকে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়।
আঞ্চলিক ইতিহাসে অন্য ধরনের সংযোজন শ্যামলী চক্রবর্তীর বঙ্কিমচন্দ্র এবং ভাটপাড়ার পণ্ডিতসমাজ (এবং মুশায়েরা, ২৫০.০০)। বাংলায় সংস্কৃতশিক্ষা ও সংস্কৃতির চর্চায় টোল-চতুষ্পাঠী, ভাটপাড়ার পণ্ডিতসমাজ, বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ও বঙ্কিমের ব্রাহ্মণ-ভাবনা ইত্যাদি প্রসঙ্গে সযত্ন অনুসন্ধান।
বিষ্ণুপুর থেকে প্রদীপ কর ও তুলসীদাস মাইতির সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘টেরাকোটা’ পত্রিকা প্রত্নতত্ত্ব নৃতত্ত্ব লোকসংস্কৃতি চর্চায় তারাপদ সাঁতরার ক্ষীণকায় ‘কৌশিকী’র কথা মনে করায়। স্থানিক ইতিহাসের খুঁটিনাটি বহু বিষয় এ ভাবেই আগ্রহীজনের গোচরে আসা সম্ভব। মনফকিরা প্রকাশ করেছে ‘লোককথা’ প্রথম সংখ্যা (সম্পা: মানিক দাস ও সন্দীপন ভট্টাচার্য), বিষয় ‘কার্বি লোককথা’। ভাস্করব্রত পতি সম্পাদিত ‘পুণ্যিপুকুর’ রাবণ বিষয়ে দুটি সংখ্যা প্রকাশ করেছে, বঙ্গসংস্কৃতিতে এই মহাকাব্যিক চরিত্রটির ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ‘সহজিয়া’ নবম বার্ষিক সংকলনে (সম্পা: মধুসূদন মুখোপাধ্যায়, পরি: সহজপাঠ, ১৫০.০০) বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘বেতার জগৎ, বেতার জীবন’, সুভাষ দে-র ‘দৃষ্টিপ্রদীপ’ অন্য জগতের চাবিকাঠি। রত্না রশীদের খোলামেলা সাক্ষাৎকার ‘আধ্যাত্মিকতার জন্য ধর্মের দরকার নেই’, রামকুমার মান্না-র আত্মজীবনীর অংশ, শেখ মকবুল ইসলাম, শ্যামল বেরা ও রত্না রশীদের সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে ‘দুয়োবিবির গীত’ গুরুত্বপূর্ণ। রামকেলি, জয়দেব, যুগলকিশোর, অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ, ঘোষপাড়ার সতীমা-র মেলা আর মহোৎসব ছুঁয়ে ছুঁয়ে লীনা চাকী-র বই মেলা-মোচ্ছব-ধুলোট (কারিগর, ২৫০.০০)। লেখকের মন্তব্য, ‘মহোৎসবে গানের আসরে সাধুরা কান খাড়া করে থাকতেন। বেলাইনে গেয়েছ কি তাকে পিটিয়ে দিলেন।’ |
|
|
|
|
|