ম্যাচটার আগে নাদালের সার্ভিস-হাতের তালুর ফোস্কা নিয়ে যা-ই আলোচনা হোক, ও যে ফেডেরারের সৌন্দর্যময় টেনিস জীবনে একটা বড়সড় ফোস্কা হয়ে থাকল তা নিয়ে বিন্দুমাত্র আর সন্দেহ নেই।
পায়ের মারাত্মক চোটে এক বছরের বেশি কোর্টের বাইরে ছিল নাদাল। ফিরে এসে গত বছর দু’টো গ্র্যান্ড স্ল্যাম-সহ পেশাদার ট্যুরে দশটা ট্রফি জিতেছিল। তা সত্ত্বেও শুক্রবার অস্ট্রেলীয় ওপেন সেমিফাইনালে ফেডেরারের বিরুদ্ধে নেমেছিল এক দিকে নিজের ওই ফোস্কার যন্ত্রণা আর অন্য দিকে প্রতিদ্বন্দ্বী যখন তুখোড় ফর্মে! কিন্তু ফেডেরারের নাদাল-ভূতের তাড়া খাওয়ার পুরনো ছবিটা আর পাল্টাল না।
এই লেখার সঙ্গে থাকা মেলবোর্ন ম্যাচের পরিসংখ্যান-চার্ট দেখলে একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করবেন। টেনিসের বেশির ভাগ বিভাগেই এ দিন ফেডেরার সমান-সমান ছিল নাদালের সঙ্গে। এমনকী কিছু ক্ষেত্রে এগিয়েও। তার পরেও স্ট্রেট সেটে হেরেছে শুধু নয়, প্রথম দু’টো সেটে একটাও ব্রেক পয়েন্ট পর্যন্ত পায়নি নাদালের সার্ভিসে। প্রথম সেটের টাইব্রেকে একবারও এগোতে পারেনি।
|
|
“...শটের সময় আমার আওয়াজ কারও অসুবিধে ঘটিয়ে থাকলে তার জন্য আমি দুঃখিত।
তবে রজার নিশ্চয়ই একশো ভাগ জানে, আওয়াজটা আমি বিপক্ষকে সমস্যায় ফেলতে করি না।
জানি না, এই নিয়ে ও কেন আম্পায়ারের সঙ্গে তর্কাতর্কি করল আজ! আমি মনে করি,
সব ম্যাচ যে ভাবে খেলি, সে ভাবেই এ দিন রজারের সঙ্গেও খেলেছি।” —নাদাল |
|
কেন সার্বিক ভাল খেলেও ফেডেরারের এ রকম একপেশে হার?
তিনটে কারণ মনে হচ্ছে আমার।
এক) ব্যাক কোর্টে বেশি আক্রমণাত্মক খেলতে গিয়ে অত্যাধিক আনফোর্সড এরর-এ নাদালকে অনেক পয়েন্ট দেওয়া।
দুই) নাদালের অসাধারণ ব্যাকহ্যান্ড উইনার। গোটা ম্যাচে নাদালের ১১টা ব্যাকহ্যান্ড উইনারের পাশে ফেডেরারের ব্যাকহ্যান্ডে মারা উইনার মাত্র দুটো।
তিন) সেকেন্ড সার্ভে নাদালের অনেক বেশি এগিয়ে থাকা। গোটা ম্যাচে নাদালের সার্ভিসকে এত বেশি ভাল দেখানোর কারণ ওর দ্বিতীয় সার্ভের প্রায় পঁচাত্তর শতাংশ সাফল্যের হার।
তবে আসল কারণ এই তিনটের একটাও নয়। সেটা নাদালের সামনে পড়লেই আদি ও অকৃত্রিম ফেডেরার-সমস্যা। বাঁ-হাতি নাদালের ফোরহ্যান্ড টপস্পিনগুলো সব সময় বাড়তি উচ্চতায় ডানহাতি ফেডেরারের ব্যাকহ্যান্ডে যেমন দু’জনের সব লড়াইয়ে যায়, এই ম্যাচেও গিয়েছে। আর ফেডেরারের ওয়ান হ্যান্ডেড ব্যাকহ্যান্ডে সেগুলো রিটার্ন করা অন্য দিনের মতো এ দিনও প্রবল সমস্যা হয়েছে। মরিয়া হয়ে বারকয়েক ইনসাইড-আউট হয়ে ফেডেরার ফোরহ্যান্ডে প্রচণ্ড জোরে রিটার্ন মেরেছে। কিন্তু সেটাও উল্টো দিকে সুপার অ্যাথলিট, কোর্টে প্রচণ্ড দ্রুত, সব বলের পিছনে পৌঁছে যাওয়ার অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে ক’বার করা সম্ভব? রড লেভার কোর্টের ম্যাচটা টিভিতে দেখতে বসে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। যখন ক্যামেরা ভিআইপি এনক্লোজারে বসা রড লেভার কিংবা পিট সাম্প্রাসকে দেখাচ্ছিল। মনে পড়ে যাচ্ছিল, গ্রেট লেভারও তো বাঁ-হাতি প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে খানিকটা সমস্যায় পড়তেন! লেভারের সময় টেনিসটা খেলেছি বলেই জানি, বিখ্যাত টনি রোচ, এমনকী রজার টেলর নামে এক ব্রিটিশ প্লেয়ারের সামনে পড়লে নিজে বাঁ-হাতি হওয়া সত্ত্বেও লেভারের জিততে বেশ ঝামেলা হত। সাম্প্রাসের আবার তেমন কোনও টেনিস-ভূত ছিল না গোটা কেরিয়ারে। তা হলে কি সাম্প্রাসই সর্বকালের সেরা?
আবার রবিবার ফাইনালে ওয়ারিঙ্কাকে হারিয়ে (যার সম্ভাবনাই বেশি) অস্ট্রেলীয় ওপেন চ্যাম্পিয়ন হলে নাদাল সাম্প্রাসেরই ১৪ গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেতাব স্পর্শ করবে। যার তিন ধাপ পরেই শুধু ফেডেরার। শুনলাম রাফা-রজার ম্যাচ এ দিনই প্রথম ‘লাইভ’ দেখল সাম্প্রাস। কিন্তু সাম্প্রাস-ও কি বিশ্বাস করে ও বা নাদাল টেনিসে সর্বকালের সেরা? কিন্তু রেকর্ড বই যে দিকে গড়াচ্ছে তাতে হয়তো দু’বছরের মধ্যে নাদালকেই সর্বকালের সেরা মেনে নিতে হবে। এখন সবে সাতাশ। আরও চার বছর তো খেলবেই। যে রকম খেলছে তাতে ১৮-২০টা গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতে কেরিয়ার শেষ করতে পারে। যদি না ফের কোনও বড় চোট পায়! |
|
“...রাফার আজ শটের সময় বেশি ঘোঁতঘোঁতানির জন্যই হেরেছি বলছি না। তবে কোর্টে
ওর
আওয়াজে আমার অসুবিধে হয়েছে। সার্ভিস করতেও বাড়তি সময় নিয়েছে। তার জন্য আমাদের
তেত্রিশ ম্যাচে রাফাকে মাত্র দু’বার পেনাল্টি পয়েন্ট দিতে হয়েছে। যে সংখ্যাটা বাড়তেই পারত। কোনও
আইন থাকলে সেটা সবার ক্ষেত্রেই সমান হওয়া উচিত। না হলে যার যা ইচ্ছে করে চলুক!” —ফেডেরার |
|
এ বছর তিনটে গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতলেও অবাক হব না। ঘাসের কোর্টটা ওর ঠিক খাপ খায় না বলে উইম্বলডনটা বাদ দিচ্ছি। কিন্তু এই ফর্মে থাকলে প্রিয়তম ক্লে কোর্টে ফরাসি ওপেন তো জিতবেই। ইউএস ওপেন মেলবোর্নের মতোই হার্ডকোর্টে। টিভিতে শুনছিলাম ২০০৭ উইম্বলডন ফাইনালের পর ফেডেরার যেমন কোনও গ্র্যান্ড স্ল্যামে নাদালকে হারাতে পারেনি, তেমনই জীবনে কখনও হার্ডকোর্ট গ্র্যান্ড স্ল্যামে নাদালের বিরুদ্ধে জয় নেই ফেডেরারের।
আসলে হার্ডকোর্টে বলের বাউন্স আরও বেশি। ফেডেরারের ব্যাকহ্যান্ড রিটার্নে আরও বেশি সমস্যা হয়। সেটা সামলাতে যে প্ল্যানিং দরকার এ দিন ঠিক সেটাই করেছিল ফেডেরার। ব্যাকহ্যান্ড এবং বেসলাইন থেকেও অ্যাটাকিং খেলা। যার জন্য নাদাল সার্ভিস রিসিভের জন্য বেসলাইনের ৮-১০ ফুট পিছনে দাঁড়ালেও ফেডেরার পাল্টা দাঁড়াচ্ছিল মাত্র ১-২ ফুট পিছনে। যার মানে, ও বেশি অ্যাটাকিং খেলতে চেয়েছিল। কিন্তু সেটাই আবার ওকে ডুবিয়েওছে। ৫০টা আনফোসর্ড এরর করে বসে। যার বেশির ভাগই ব্যাকহ্যান্ড আর ব্যাককোর্ট শটে।
তবে আমার কাছে সবচেয়ে তাৎপর্যের, নাদালের কেরিয়ার খতমের সম্ভাবনা তৈরি হওয়া হাঁটু আর গোড়ালির মারাত্মক চোট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে এই অসাধারণ ফর্মে প্রত্যাবর্তনটা। টেনিস কেন, সমস্ত খেলাধুলোর ইতিহাসে সেরা প্রত্যাবর্তন আমার মতে। একমাত্র তুলনা হতে পারত, লান্স আর্মস্ট্রংয়ের ক্যানসার থেকে ফিরে বহুবার ত্যুর দ্য ফ্রান্স জেতা। কিন্তু সেই নজির তো এখন ড্রাগ কেলেঙ্কারিতে ডুবে গিয়েছে! |
মেলবোর্ন মহাযুদ্ধ |
• সার্ভিস ‘এস’ মারায় ফেডেরার এগিয়ে (৮-৩),
ডাবল ফল্ট (১-১) সমান,
প্রথম সার্ভের
সাফল্যে
ফেডেরার (৬৬%-৬৫%)
একচুল এগিয়ে থাকলেও দ্বিতীয় সার্ভ নাদাল
(৭৩%-৫০%) অনেক ভাল করেছেন। • নেট প্লে ফেডেরার (৪২-১০) অনেক বেশি
নেটে
এসেছেন এবং সাফল্যেও (৫৫%-৩০%) এগিয়ে।
• ব্রেক পয়েন্ট নাদাল (১৪-২) অনেক এগিয়ে।
ফেডেরার ম্যাচে প্রথম ব্রেক পয়েন্ট পান তৃতীয় সেটে।
• রিটার্ন শট সাফল্যে নাদাল (৪০%-২৭%) অনেক এগিয়ে।
• পাসিং শট নাদাল (১৯-২) অনেক বেশি সফল।
• ভলি ফেডেরার (১৩-২) বেশি মেরেছেন। এমনকী ব্যাকহ্যান্ডে (৫)।
• উইনার ফেডেরার বেশি আক্রমণাত্মক (৩৪-২৮)।
• আনফোর্সড এরর নাদালের চেয়ে দ্বিগুণ
বেশি ফেডেরারের (৫০-২৫)।
• ম্যাচের সময় ২ ঘণ্টা ২৪ মিনিট • স্কোরলাইন নাদালের পক্ষে
৭-৬ (৭-৪), ৬-৩, ৬-৩ |
|
নিজের তৃতীয় গ্র্যান্ড স্ল্যামের সামনে সানিয়া
সংবাদ সংস্থা • মেলবোর্ন
২৪ জানুয়ারি |
অস্ট্রেলীয় ওপেনে মিক্সড ডাবলস ফাইনালে উঠলেন সানিয়া মির্জা। রোমানিয়ান সঙ্গী হোরিয়া তেকাউকে নিয়ে। সেমিফাইনালে ষষ্ঠ বাছাই সানিয়ারা হারান অস্ট্রেলীয় জুটি ম্যাথু এবডেন-জার্মিলা গাডোসোভাকে। সওয়া ঘণ্টার সুপার টাইব্রেকে। ২-৬, ৬-৩, ১০-২। ফাইনালে সানিয়ারা খেলবেন ড্যানিয়েল নেস্টর-ক্রিস্টিনা মাডেনোভিচের বিরুদ্ধে। বর্ষীয়ান কানাডিয়ান নেস্টরের ডাবলস সাফল্য আর দীর্ঘকায়া ফরাসি ক্রিস্টিনার জোরালো সার্ভিস সামলাতে হবে সানিয়াদের। সফল হলে সানিয়া তৃতীয় গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতবেন। ২০০৯ অস্ট্রেলীয় ওপেন এবং ২০১২ ফরাসি ওপেন মিক্সড ডাবলস জিতেছিলেন মহেশ ভূপতির সঙ্গে। ভূপতির সঙ্গেই ২০০৮-এ রানার্স হন মেলবোর্নেই। |