পশ্চিমবঙ্গের পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র মহাশয় মাঝেমধ্যেই নানা রকম হুমকি দিয়া থাকেন। কখনও ভাড়া-বৃদ্ধির দাবিতে বাস-মালিকদের ধর্মঘটে যাওয়ার ক্ষোভে, কখনও রাস্তা হইতে মিনিবাস-ট্যাক্সি তুলিয়া লওয়ার বিরুদ্ধে। সবচেয়ে বেশি হুমকি শুনা যায় অটো-চালকদের দৌরাত্ম্যের প্রতিক্রিয়ায়। তবে বাস-মিনিবাস-ট্যাক্সির মালিক বা চালকরা এবং বিশেষ করিয়া অটো-চালকরা সম্ভবত পরিবহণ মন্ত্রীর এই সব হুমকিতে কর্ণপাত না-করার অভ্যাস রপ্ত করিয়া ফেলিয়াছেন। নিন্দকে বলিতেই পারে, ইহা এক গড়াপেটা খেলা। মন্ত্রিবর যাত্রিসাধারণের দুর্দশা মোচনের লক্ষ্যে হুমকি দিবেন, অথচ যাঁহাদের উদ্দেশে হুমকি, সেই চালকরা তাহাতে ভ্রুক্ষেপও করিবে না, ইহা আগে হইতেই স্থির করা। কারণ অটো-চালকরা ইউনিয়নে সংঘবদ্ধ। মন্ত্রীর নিজের দল তৃণমূল কংগ্রেসের অনুগামী ট্রেড ইউনিয়নেই অধিকাংশ অটো-চালক ইদানীং আনুগত্য স্থাপন করিয়াছেন। অতএব মন্ত্রীর সাধ্য কী, নিজের হুমকি কার্যকর করেন! নিন্দকের কথা ফেলিয়া দেওয়া কঠিন।
এ বারের হুমকিটি অবশ্য কিঞ্চিৎ ভিন্ন মাত্রা পাইয়াছে। মদনবাবু অটো-চালকদের ২৬ জানুয়ারি অর্থাৎ প্রজাতন্ত্র দিবস অবধি ‘সময়’ দিয়াছেন। সেই সময়সীমার মধ্যে অটো-চালকরা নিজেদের দুর্বৃত্ত চরিত্র না শোধরাইলে তিনি কড়া ব্যবস্থা লইবেন, দেখাইয়া দিবেন, ‘প্রশাসন কাহাকে বলে’! প্রজাতন্ত্র দিবসের নানা তাৎপর্য থাকিতে পারে। কিন্তু তাহা যে অটো-চালকদের যথেচ্ছাচারের সময়সীমা হিসাবেও নির্দিষ্ট হইতে পারে, ইহা রীতিমত রোমাঞ্চকর আবিষ্কার। ভয় হয়, অটো-চালকরা মন্ত্রী-বাক্যের নিজস্ব অর্থ তৈয়ারি করিয়া না লন। তাঁহারা মনে করিতে পারেন, দিনটির আগে পর্যন্ত কলিকাতা ও শহরতলির অটো-চালকরা যত খুশি দৌরাত্ম্য করিয়া লউন,তাঁহাদের বিরুদ্ধে কোনও কড়া ব্যবস্থা লওয়া হইবে না। হাজার হউক, প্রজাতন্ত্র তো প্রজাদেরই শাসনতন্ত্র, তাহাদের যথেচ্ছাচারের ছাড়পত্র। আর অটো-চালকরা দেশের মাননীয় প্রজা বইকী! আর প্রজাতন্ত্র দিবস কাটিয়া গেলে? তখন নিশ্চয়ই আবার পরবর্তী প্রজাতন্ত্র দিবস অবধি সময় মিলিবে।
তবু, কুহকিনী আশায় বুক বাঁধিয়া ধরিয়া লওয়া যাক, মন্ত্রী কথা রাখিবেন। তাহাতেও প্রশ্ন দূর হয় না। ‘কড়া ব্যবস্থা’ বলিতে ঠিক কী বুঝিতে হইবে, পরিবহণ মন্ত্রী তাহা বিশদ করেন নাই। কেবল বলিয়াছেন, অটো বন্ধ করিয়া দেওয়া হইবে। যাত্রীদের নিগ্রহ করার, মহিলা যাত্রীদের মাথা ফাটাইয়া দিবার কিংবা পথচারীকে চাপা দিয়া মারিয়া ফেলার জন্য কেবল এইমাত্র? ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের জন্য যথেষ্ট কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা না থাকায় এবং যেটুকু ব্যবস্থা আছে তাহাও কার্যকর না হওয়ায় কলিকাতা ও পশ্চিমবঙ্গে যান-বিশৃঙ্খলা এতটা বাড়িয়াছে। বাস-মিনি-ট্যাক্সি-অটোর এত অত্যাচার জনসাধারণকে সহ্য করিতে হয়। নিজেদের মধ্যে রেষারেষি করিতে গিয়া পথচারীকে চাপা দিয়া মারিলেও দোষী চালকের এখানে কোনও শাস্তি হয় না। ইউনিয়ন কিছু কাল তাহাকে আড়ালে রাখিয়া অন্য গাড়ির চালক হিসাবে পুনর্নিয়োগ করে। অটো-চালকরা উপরন্তু রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মীও বটে। ভোটের সময় অসংগঠিত ক্ষেত্রের বেপরোয়া, জঙ্গি মনোভাবাপন্ন স্বেচ্ছাসেবকদের যূথবদ্ধ শক্তি রাজনীতিকদের কাজে লাগে। তাই কোনও দলই ইহাদের দৌরাত্ম্য দমনে মুখর হয় না। এই ধারা অতীতেও ছিল, এখনও আছে। কে তাহার পরিবর্তন করিবেন? মদন মিত্র? ভরসা হয় না। |