মৃত্যুদণ্ডিত অপরাধীর মানবাধিকার মূল্যবান— সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশ যথাযথ। কিন্তু এমন মূল্যবান অধিকার রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ আদালত কেন আরও অনেক বেশি সক্রিয় হইবে না, সেই প্রশ্ন অনিবার্য। নির্দেশটির প্রেক্ষাপট বিচার করিলে ইহা স্পষ্ট হইয়া ওঠে। কোনও অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত হইয়া যাওয়ার পরেও দেশের আইন অনুসারে তিনি রাজ্যপাল বা রাষ্ট্রপতির নিকট মার্জনা ভিক্ষা চাহিতে পারেন। এই মার্জনাভিক্ষার বন্দোবস্ত ন্যায়সংগত কি না, তাহা লইয়া তর্ক আছে। বিচারব্যবস্থার সমস্ত স্তর পার হইয়া যে দণ্ড বহাল রহিল, তাহা রদ করিবার কোনও অধিকার কেন প্রশাসনের হাতে থাকিবে? এই অধিকার কি প্রকৃতপক্ষে রাজতন্ত্রের উত্তরাধিকার বহন করিতেছে না? প্রশ্নগুলি যুক্তিযুক্ত, কিন্তু তাহা ভিন্ন তর্ক। ঠিক যেমন, মৃত্যুদণ্ডের যৌক্তিকতা লইয়াও বহু প্রশ্ন, বহু তর্ক। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেই সব প্রশ্ন ওঠে না, সুপ্রিম কোর্টও তাহা তোলে নাই। আদালতের বক্তব্য, মার্জনার আবেদন অস্বাভাবিক রকমের দীর্ঘ সময় ধরিয়া পড়িয়া থাকিলে দণ্ডিতের উপর যে তীব্র মানসিক চাপ পড়ে, তাহা অন্যায় ও অনৈতিক। সংবিধানে যে সুস্থ ও মর্যাদাসম্পন্ন জীবনের অধিকার স্বীকৃত, তাহা ফাঁসির জন্য প্রতীক্ষারত ব্যক্তিরও প্রাপ্য। এই কারণেই সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ: মার্জনার আবেদন সম্পর্কে যথাসম্ভব দ্রুত সিদ্ধান্ত লইতে হইবে। তাহার পাশাপাশি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করিবার পদ্ধতিতেও একাধিক সুনীতি মানিয়া চলিবার নির্দেশ জারি করিয়াছে সুপ্রিম কোর্ট। এবং মৃত্যুদণ্ড রূপায়ণে অস্বাভাবিক বিলম্বের কারণেই পনেরো জন দণ্ডিতের ফাঁসি রদ করিয়া দিয়াছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্ব কতটা গুরুত্বপূর্ণ, এই রায় তাহাই বুঝাইয়া দিতে চাহিয়াছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।
প্রশ্ন একটিই। দণ্ডাজ্ঞা দ্রুত কার্যকর করাই যদি আদালতের লক্ষ্য হয়, তবে দণ্ড ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই তাহা রূপায়ণের সময়সীমা নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হইবে না কেন? সুপ্রিম কোর্ট এই বিষয়ে অস্বাভাবিক বিলম্বের জন্য প্রশাসনের চালকদের দায়ী করিয়াছে। ঠিকই করিয়াছে। কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে তৎপরতার অভাবেই মার্জনা বিষয়ক সিদ্ধান্ত বিলম্বিত হয়। কিন্তু অন্য বহু বিষয়ে তো প্রশাসনকে তৎপর করিবার জন্য আদালত নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কাজ করিবার নির্দেশ দিয়া থাকে। বস্তুত, অনেক সময়েই প্রশ্ন ওঠে, আদালত আপন এক্তিয়ারের বাহিরে গিয়া তেমন নির্দেশ জারি করিতেছে কি না। এ ক্ষেত্রে প্রশ্নটি সর্বোচ্চ আদালতের নির্ধারিত বা অনুমোদিত দণ্ডাদেশ কার্যকর করিবার, সুতরাং সাধারণ বুদ্ধি বলে যে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দিষ্ট সময়সীমা বলিয়া দিবার যুক্তিও অনেক বেশি জোরদার। তাহা সত্ত্বেও কেন আদালত যথেষ্ট কঠোর হয় নাই? মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট তথা বিচারবিভাগের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রাখিয়াই একটি সংশয় প্রকাশ করা চলে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করিবার ব্যাপারে, প্রশাসনের কর্তাদের মতোই, বিচারপতিদের মনেও কি এক ধরনের দ্বিধাবোধ কাজ করে? প্রশাসকরা যত দিন পারেন মার্জনাভিক্ষার আবেদন ফেলিয়া রাখেন, যাহাতে দণ্ডদান বিলম্বিত করা যায়, বিচারবিভাগও প্রশাসনকে এই বিষয়ে তৎপর হইতে বাধ্য করেন না? যদি এই সংশয় যথার্থ হয়, তবে তাহা দুর্ভাগ্যজনক। মৃত্যুদণ্ডের বিধান বহু দেশেই রদ হইয়াছে, বিশেষত গণতান্ত্রিক দুনিয়ায়। ভারতে এই ব্যবস্থা চালু রাখিবার যৌক্তিকতা লইয়া তর্ক হইতে পারে, হওয়া জরুরি। কিন্তু যত দিন তাহা আছে, তত দিন এই দণ্ড রূপায়ণে তৎপরতাই কাম্য। ইহাই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকাটিরও লক্ষ্য। কিন্তু সেই লক্ষ্য পূরণে আদালত আরও কঠোর এবং তৎপর হইলে ভাল হইত। |