প্রবন্ধ ২...
‘আধুনিক’ চিকিৎসাবিজ্ঞান বনাম মুক্তচিন্তা
প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীরা সাধারণত নিজেদের বিশ্বাসের খাঁচায় অন্তরিন থাকেন। খাঁচা মানে প্রতিষ্ঠান আর তার প্রাতিষ্ঠানিকতা। প্রতিষ্ঠান মানে বৈজ্ঞানিক যুক্তির খাঁচা। প্রতিষ্ঠান মানে একটা বিশ্বাসও বটে, কারণ প্রাতিষ্ঠানিক ধ্যান-ধারণা আবার এক সময় বিশ্বাসে পরিণত হয়ে যায়। ধর্মবিশ্বাসের মতোই।
প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা এমনই সর্বগ্রাসী যে তার বিরোধিতা করলে পরিতাপের আশঙ্কা। গালিলেয়ো থেকে মেন্ডেল, পরিতাপের ইতিহাস দীর্ঘ। তাই বোধ হয় ইতিহাসের শিক্ষা স্মরণ করে, গড়পড়তা বিজ্ঞানীর দল প্রতিষ্ঠানের নিপীড়ন সহ্য করেন, যাকে বলে ‘টাইরানি অফ ডমিন্যান্ট ওপিনিয়ন’। আবার, গণন্ত্রের নিয়মেই বোধহয় উপহাস ব্যঙ্গ আর অবজ্ঞা সহ্য করেও কেউ কেউ প্রতিষ্ঠানের পাঁচিল পেরোতে চান। তাঁরা ব্যতিক্রম বটে, কিন্তু সভ্যতার অগ্রগতির নিরিখে তাঁরাই আমাদের দিশারী।
একই কথা অবশ্য ডাক্তারদের বেলাতেও খাটে। প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁরাও তো বিজ্ঞানীই। বিশ্বাস, ঐতিহ্য আর পরম্পরায় তাঁদেরও ভক্তি কম না। খাঁচার নিরাপদ বেষ্টনীর মধ্যেই তাঁদের ভক্তিযোগ চলতে থাকে। নইলে স্তন ক্যানসারের চিকিৎসার ধরন নিয়ে একটা যুক্তিগ্রাহ্য সিদ্ধান্তে আসতে ডাক্তারদের যুগের পর যুগ মূল্যবান সময় নষ্ট করতে হত না।
স্তন ক্যানসারের চিকিৎসায়, বিংশ শতাব্দীর তিন-চতুর্থাংশ সময় কেটে গিয়েছিল বিচিত্র ধরনের অস্ত্রোপচারের ভরসায়। শল্যচিকিৎসকরা ভাবতেন, অস্ত্রোপচারের পরিধি যত বড় হবে, ক্যানসারকে তত বেশি জব্দ করা যাবে। এই সরল ধারণায় তাঁরা শুধু স্তনটুকু নয়, শৈল্পিক পদ্ধতিতে তার সঙ্গে বুক, গলা ও আশপাশের কোষকলা উপড়ে ফেলার মহড়া দিয়েছেন। ধ্বংসলীলায় যিনি যত বেশি নিপুণ, তিনি তত বেশি পূজনীয় হয়েছেন। বীরত্বপূর্ণ অসিঝংকারের তালে তালে ক্যানসার পরাভূত হয়ে নির্মূল হয়ে যাচ্ছে, এমন ভাবনাই ছিল প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাস।
এই বিশ্বাস যে রোগীদের বেলায় কতখানি কার্যকরী, তা নিয়ে অনেকের সংশয় ছিল, কিন্তু প্রশ্ন তোলার সাহস ছিল না। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন শল্যচিকিৎসার অধ্যাপক অলিভার কোপ। তিনি বলেছিলেন, এতকাল ধরে নারীর শরীরের উপর অমন নির্মম, বৈজ্ঞানিক ধ্বংসলীলার পরেও চিকিৎসার ফল মোটেই আশানুরূপ হয়নি, হয় না। যুক্তি, তথ্য আর পরিসংখ্যান নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠিত ডাক্তারি জার্নাল আর পারদর্শীদের দোরে দোরে ঘুরেছিলেন। কিন্তু উপেক্ষা ছাড়া তাঁর কিছুই জোটেনি।
এ দিকে পশ্চিম দুনিয়ায় তখন নারী-মুক্তি আন্দোলনের যুগ। অনেক পত্রপত্রিকাই ছিল নারীর স্বাধিকার রক্ষায় মুখর। উপায়ান্তর না দেখে অলিভার কোপ ডাক্তারি জার্নাল ছেড়ে মহিলাদের পত্রপত্রিকায় লিখতে শুরু করেন। ক্যানসার নিরাময়ের চেষ্টায় অবান্তর অস্ত্রপ্রয়োগের বিরুদ্ধে যুক্তি-সচেতন মহিলারা এ বার সরব হলেন। রাজনীতিকরা সন্ত্রস্ত হলেন। প্রতিষ্ঠানও সচকিত হল। দীর্ঘকালীন বিশ্বাস ঝেড়ে ডাক্তাররাও নড়েচড়ে বসলেন।
এ সবই গত শতাব্দীর ষাট আর সত্তরের দশকের কথা। বার্নার্ড ফিশার এবং উম্বের্তো ভেরোনেসির নেতৃত্বে যথাক্রমে আমেরিকায় এবং ইতালিতে শুরু হল নতুন করে হিসেব-নিকেশ। ১৯৮৫ সালে বেরল তাঁদের পরীক্ষার প্রাথমিক ফলাফল। প্রমাণিত হল, অমন ‘রাজকীয়’ চিকিৎসায় গত পঞ্চাশ বছরে স্তন ক্যানসারের পরিণতি আগের চেয়ে সুখকর হয়নি। এই অস্ত্রাভিযানের মূল্য যৎসামান্যই, কিন্তু ক্ষতির পরিমাণ মর্মান্তিক। বিশেষত ক্ষুদ্র আয়তনের ক্যানসারের উপর অমন দুরন্ত অসিচালনার কোনও যুক্তি নেই। অসির মূল্য আছে, তবে তা আরও সংযত ভাবে, ক্ষুদ্র পরিধি জুড়ে ব্যবহার করা যায়, আর তার সঙ্গে অন্যান্য ধরনের চিকিৎসা, যেমন রেডিয়োথেরাপি বা কেমোথেরাপির সাহায্য নিলে ক্যানসারগ্রস্ত মহিলারা সমানভাবে বা এমনকী আরও বেশি উপকৃত হতে পারেন। বিকলাঙ্গ হবার ভয় থেকে মুক্ত হতে পারেন।
এই পর্যবেক্ষণের পর অস্ত্র নিয়ে সংহার অভিযানের রমরমা আশির দশক থেকেই ক্রমশ কমতে থাকল। যাঁরা রাজকীয় অস্ত্রোপচারের সপক্ষে ছিলেন, তাঁদের বিশ্বাস যে একেবারে ছিন্নমূল ছিল তা নয়, তাঁদের হাতেও কিছু তাত্ত্বিক সমর্থন ছিল। কিন্তু তত্ত্বের বিবর্তন ঘটে। নতুন তথ্যের আলোয় পুরনো, যান্ত্রিক তত্ত্ব সরিয়ে নতুন তত্ত্ব রচিত হল। বলা হল, স্তন ক্যানসার যদি ক্ষুদ্র আয়তনের না হয়, তা হলে ধরে নিতে হবে যে তার উপস্থিতি সমস্ত শরীর জুড়েই রয়েছে।
এমতাবস্থায় অস্ত্রোপচার বা রেডিয়োথেরাপির উপযোগিতা আছে ঠিকই, কিন্তু ভরসা রাখতে হবে প্রধানত কেমোথেরাপির উপরেই। কেননা, কেমোথেরাপি বা হরমোন-এর প্রভাব পড়বে শরীরের সর্বত্র। এই ধারণার সপক্ষে নতুন নতুন তথ্যও প্রচারিত হল। অসির গর্জনধ্বনির বদলে এ বার শোনা গেল ভেষজের মূর্ছনা। মূর্ছনার তীব্রতা ক্রমশ এমন ভাবে বেড়ে গেল যে স্তন ক্যানসার মাত্রেই যেন কেমোথেরাপি। পুরনো বিশ্বাসের জায়গা দখল করল নতুন বিশ্বাস, নতুন ‘ডমিন্যান্ট ওপিনিয়ন’।
কিন্তু এই নতুন বিশ্বাসের তাত্ত্বিক আর প্রামাণিক ওজন খুব বেশি নয়। অস্ত্রোপচার যদি ঘাতকের কাজ করে, তা হলে কেমোথেরাপি করে গুপ্তচরের কাজ। তাই বলে বেশি-বেশি গুপ্তচর ছড়িয়ে দিলেই যে মঙ্গল হবে, এ বড় দুর্বল যুক্তি। ‘ঘাতক বাহিরে থাকে, গুপ্তচর রক্তের ভিতর’। অসংযমী ভেষজ চিকিৎসায় যদি রোগীর উপকার হয়, তা হলে এও মেনে নিতে হবে যে, ক্ষতিও সমধিক। শুধু শারিরীক ক্ষতিই নয়, তা আর্থিক, সামাজিক আর সাংসারিক। এ যদি বিজ্ঞান হয়, তবে জর্জ বার্নার্ড শ’-এর ভাষা ধার করে বলতে হয়, বিজ্ঞান মানেই আসলে একটা ভ্রান্তি,— একটা সমস্যার হাল করতে গিয়ে চিরকাল সে দশ-দশটা নতুন সমস্যা তৈরি করে দেয়।
অনেকে বলেন, তাতে কী? পরিসংখ্যান তো আছে। পরিসংখ্যান যদি চিকিৎসার তাৎপর্য প্রমাণ করতে পারে, তবে তা মেনে নিতেই হবে। কিন্তু অনেকে আবার বলেছেন, ওই ‘তাৎপর্য’ আসলে আলেয়ার আলো, মায়ামৃগ, কেননা অন্যান্য পরিসংখ্যান ওই তাৎপর্যকে নস্যাৎ করে দেয়। অতএব, আমরা যদি আমাদের বিশ্বাসের নিগড়েই বন্দি থাকি, তা হলে জনমানুষের কষ্টার্জিত লক্ষ লক্ষ মুদ্রার বিনিময়ে কেমোথেরাপির যে দুঃসহ, অতি-সক্রিয়তা এখন চলছে, তা ক্রমশ আরও ভয়াবহ হবে।
অবশ্য ওই ভয়াবহতা নিয়ে ক্যানসার প্রতিষ্ঠান যে খুব ব্যাকুল, তা নয়। তবে একেবারে যে সংশয়মুক্ত, তাও বলা যায় না। তাই আধুনিক, প্রাতিষ্ঠানিক মত হল, এত বাদ-বিবাদ পরিহার করে মহিলাদের ভিতর ছাঁকুনিপর্ব শুরু করা, যাকে বলে ‘স্ক্রিনিং’। সব কিছুই ছোট থেকে বড় হয়, ক্যানসারও। তাই ঠিকঠাক ছাঁকতে পারলে স্তন ক্যানসারকে তার অল্প অবস্থায় ধরে ফেলা সম্ভব। অল্প মানে ছোট, মানে শিশু,— তার ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা তৈরি হয়নি। অতএব তা সম্পূর্ণ নিধনযোগ্য। তার মানে অল্প অবস্থায় রোগ ধরা পড়লে সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত হওয়া যায়।
অবশ্য কতটা অল্প হলে তাকে ‘অল্প’ বলে ধরে নেওয়া যায় তা নিয়ে ধোঁয়াশা কম না। তা ছাড়া, আকারের ক্ষুদ্রতা মানেই যদি ক্যানসারের শৈশব বোঝায়, তা হলে দুনিয়ার তাবৎ বামনকে শিশু বলেই ধরে নিতে হয়। ক্যানসার বায়োলজির কাছে কিন্তু ক্যানসারের আয়তন বা বয়স না, যা বিচার্য, তা হল চরিত্র, তার বিধ্বংসী ক্ষমতা। অতি ক্ষুদ্র হলেও তা বিধ্বংসী হতে পারে। অথচ সেই বিধ্বংসী ধরনের ক্যানসার সাধারণ ‘স্ক্রিনিং’ করে ধরা পড়ে না।
তাতে ছাঁকুনির যুক্তিটা মাঠে মারা যায়। তা ছাড়া, ছাঁকুনি পর্বে যে দুর্ভোগের তালিকা অনেক দীর্ঘ, সে কথা তথ্য আর যুক্তি দিয়ে অনেকেই জানিয়েছেন। দুর্ভোগ শুধু শারীরিক নয়, মানসিক এবং আর্থিকও বটে। দুর্ভোগগুলো যতটা স্পষ্ট, উপকারগুলো ততটাই অস্পষ্ট। এমনই অস্পষ্ট যে, একটা হিসেব অনুযায়ী, দু’হাজার মহিলাকে দশ বছর যাবৎ স্ক্রিনিং করলে মাত্র এক জন মহিলা ক্যানসার-জনিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচলেও বাঁচতে পারেন। অনেকের মতে এমন অবস্থা শুধু হাস্যকর নয়, এ এক অন্যায়, অবান্তর কর্মসূচি। তা সত্ত্বেও আমাদের গোয়েন্দাগিরি চলছে। গোয়েন্দাগিরিই আমাদের নবতম বিশ্বাস।
তা হলে দাঁড়াল এই, গত পঞ্চাশ বছরে স্তন ক্যানসারের পটভূমিতে কয়েকটি বিবর্তন ঘটে গেছে। এক কথায় বললে, তা হল, ‘কেটে ফেলা’র চেয়ে বিষ প্রয়োগে ‘মেরে ফেলা’ই ভাল। আর মেরে ফেলার আগে ‘ধরে ফেলা’ সবচেয়ে বেশি লাভজনক। একই সঙ্গে এও লক্ষ করা যাচ্ছে যে, প্রতিষ্ঠান এখন আর আগের মতো তার বিরোধীদের উপেক্ষা করে না। তার বদলে অবজ্ঞা করে। অপ্রিয় সত্য উচ্চারণে এখন আর তেমন বাধা নেই, তবে প্রতিষ্ঠানের কাছে তার কোনও মান্যতাও নেই। তার মানে, প্রতিষ্ঠান ‘খাচ্ছে, কিন্তু গিলছে না’।
অনেকেই এখন বলেন যে, স্তন ক্যানসারের আধুনিক চিকিৎসার সঙ্গে বিজ্ঞানের যোগ যতটা, মুদ্রা বিনিময়ের যোগ তার চেয়ে বেশি। স্তন ক্যানসার তো আসলে একটা ক্রনিক ব্যাধি। অনেক কাল ধরে সে যেমন নিদ্রাতুর থাকে, তেমনই সজাগও হয়। তাই শুধু নিধন যজ্ঞে ঘৃতাহুতি দিলেই এ সমস্যা মিটবে না। বরং কী ভাবে এমন ক্রনিক ব্যাধির সঙ্গে বহুকাল ধরে বোঝাপড়া করা যায়, তার মারমুখী প্রবণতা কমিয়ে রাখা যায়, তার চেষ্টাই হওয়া উচিত গবেষণার প্রধান বিষয়। এ কথাও প্রতিষ্ঠান শোনে, অন্তত শোনার ভান তো করে, কিন্তু মানে না।
মানতে অবশ্য পারে, যদি বেধড়ক সামাজিক ধমক থাকে। আসলে, প্রতিষ্ঠান মানে একটা নিরাপদ বিশ্বাসের শয়নাগার। সেই সুষুপ্তি ছেড়ে নিরন্তর মুক্তচিন্তার প্রেরণা আমাদের প্রথাগত শিক্ষায় নেই।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.