প্রবন্ধ ১...
মানুষ শেষ পর্যন্ত কী পারে কী পারে না
রবিন্দ কেজরিওয়ালের চার পাশে এখন যাঁরা হইচই লাগিয়েছেন, ক্ষুব্ধ, বিক্ষুব্ধ, উচ্চাশী, সুযোগসন্ধানী: তাঁদের দেখেশুনে মনে পড়ছে একটি ঐতিহাসিক মন্তব্য: ‘ইয়োর পিপল, স্যর, ইজ নাথিং বাট আ গ্রেট বিস্ট!’ সাধারণ মানুষ ভারী হিংস্র, তাদের হাতে তাদের নিজেদের ছেড়ে দিলে খেয়োখেয়ি হিংসাহিংসির চোটে শেষে পড়ে থাকবে কেবল পেনসিল! এই বাক্যের মধ্যে খানিক সত্যতা তো আছেই, দুর্ভাগ্য। কথাটি বলেছিলেন আলেকজান্ডার হ্যামিলটন, আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নামে একটি গণতান্ত্রিক দেশ যাঁরা তৈরি করেছিলেন, তাঁদের অন্যতম পুরোধা, জর্জ ওয়াশিংটনের বিশ্বস্ত চিফ অব স্টাফ। আদি গণতন্ত্রীদের মধ্যে তখন থেকেই সাধারণ মানুষ বিষয়ে রীতিমত আতঙ্ক, ঠিক ভাবে নেতৃত্ব না দিলে কী যে তারা করে ফেলবে, তা নিয়ে বেদম অনিশ্চয়তা।
‘আপ’কে কেন্দ্র করে এই অনিশ্চয়তার হাওয়া ইতিমধ্যেই ভারতজোড়া ঝড়। ‘আপ’ এবং ‘আম’ নিয়ে ব্যঙ্গ-বঙ্কিমতার তোলপাড়। সম্প্রতি এতটা সিনিসিজম আর কিছু নিয়ে দেখা গিয়েছে কি? দিল্লির নতুন সরকার ঠিক কী জাতীয় পদার্থ, হাম ‘আপ’-কে হ্যায় কওন, ‘আম’ আসলে কীদৃশ ফল, ইত্যাদি। এতখানি বঙ্কিমতার কারণ নিশ্চয়ই আম আদমি নিয়ে দক্ষিণ ও বাম দুই দিকেরই প্রবল অস্বস্তি। দক্ষিণপন্থী অস্বস্তিটা ব্যাখ্যা করার দরকার নেই, গণতন্ত্রে আস্থা রেখেও হ্যামিলটনীয় যে সাধারণ্য-বিমুখ রক্ষণশীলতা, সেটাই আজও দক্ষিণের বড় পরিচয়। আর বাম অস্বস্তি ফুটে ওঠে ক্রমাগত আম-এর সীমারেখাটা মনে করিয়ে দেওয়ার মধ্যে, মধ্যবিত্ত স্বার্থপরায়ণতা ছাড়া এর যে আর কোনও সম্বল নেই, সেটা খেয়াল করানোর মধ্যে।
আপ-এর আম-এর মধ্যে যে মধ্যবিত্তই আদি-মধ্য-অন্ত, তাতে সন্দেহই চলে না। এবং এই মধ্যবিত্ত যে সাধারণ ভাবে রক্ষণশীল, সুবিধাবাদী, তা-ও অভ্রান্ত। কিন্তু যেটা বোঝা যায় না— এতে আপ-এর গুরুত্বটা কমবে কেন? আপ তো ঠিক বিপ্লবী দল নয়, গোড়াতেও তার কোনও বিপ্লবাত্মক অ্যাজেন্ডা শোনা যায়নি, যা কিছু তার নতুন কথা, নতুন দাবি, সে তো দেশের যে চালু রাজনীতি, আর সেই রাজনীতির যে পোষা সমাজ, তার বিরুদ্ধে। সেই রাজনীতি-পুষ্ট সমাজের বাইরের যে মানুষ, মধ্যবিত্ত পেরিয়ে যে সাধারণ মানুষ— আম আদমি বলতে তাদের বোঝানোর চেষ্টা হয়নি। সে দিক দিয়ে, আম শব্দটি এখানে আলঙ্কারিক। একটি বিশেষ প্রেক্ষিতে খাস-এর বিপরীতে তার অবস্থান নির্ধারিত। রাজনীতি বা সমালোচকদের বাইরের মানুষ কিন্তু আপ-কে ঠিকই বুঝেছেন। তাই কিছু মাল্টিন্যাশনাল, কর্পোরেট, এক্সিকিউটিভ বা প্রফেশনালদের যদি বা ধেয়ে আসতে দেখা যায়, অটোচালক-রিকশাচালক পেরিয়ে দরিদ্রতর জনসাধারণকে আপ আন্দোলনের ধারেকাছেও দেখা যায়নি।
কেউ বলতে পারেন যে, এত দিন পর এই প্রতিবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একটা বৃহত্তর সমাজকে রাজনীতি-মঞ্চে টেনে আনার সম্ভাবনা ছিল, সেটা বিনষ্ট হল। এই অভিযোগের যথেষ্ট কারণ আছে। কেজরিওয়ালের আন্দোলন কিংবা সরকার, কোনওটাই একটি সীমিত সামাজিক গণ্ডির বাইরে যেতে অক্ষম। তাই, কেন তাঁর নতুন সরকার বিদ্যুৎ-মাসুল কমিয়ে মধ্যবিত্তের সুরাহা না করে বিদ্যুৎহীন নিম্নবিত্ত ঘরে বিদ্যুৎ-সংযোগ তৈরি করল না, বুঝতে অসুবিধে হয় না। আপ-রাজনীতি শ্রেণিগত ভাবে কংগ্রেস বা বিজেপি (এবং হ্যাঁ, কমিউনিস্ট) রাজনীতির অনপনেয় রকম সীমিত শ্রেণি-চরিত্র থেকে আলাদা নয়। আবার উপরিতলের শ্রেণি-চরিত্র সত্ত্বেও এই সব দল যেমন কখনও সখনও সামাজিক সাম্যের লক্ষ্যে গভীরচারী সংস্কারে উদ্যোগী হয়েছে, আপও যে তেমন কিছু করতে পারবে না, এ-ও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। সুলভ জল, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, শিক্ষার ধুয়োর সঙ্গে যে গ্রামসভার ক্ষমতায়ন কিংবা অরণ্যাঞ্চলে স্থানীয় মানুষের অধিকার আপ-অর বক্তব্যে উঠে আসছে, সেগুলো সব এক আঁচড়ে ভাঁওতা বলে উড়িয়ে দেওয়ার কারণ ঘটেনি এখনও। কথাটা হল, শ্রেণিগত বিপ্লব নয়, আপ-রাজনীতি কেবল সমাজগত একটা বেড়া ভাঙতে চাইছে। যে সমাজ একই শ্রেণির মধ্যে থেকেও রাজনৈতিক ক্ষমতার সোনার কাঠির ছোঁওয়ায় প্রথম স্তরের নাগরিক হয়ে যায়, এবং বাকিরা সেই সংযোগ খুঁজে না পেয়ে গণতান্ত্রিক দেশের দ্বিতীয় স্তরের নাগরিকে পরিণত হয়, আপ সেই বিভাজন-রেখার বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার পর সপ্তম দশকে এসে ‘শ্রেণি’ ও ‘সমাজ’-এর এই ‘ওভারল্যাপ’ ও পার্থক্যের ব্যাপারটা আমাদের মাথায় রাখতেই হবে।
ঘটনা হল, পরিচিত রাজনীতির গণ্ডিটা মুছে ফেলতে উদ্যত আপ অবধারিত ভাবেই নিজেকে পরিচিত রাজনীতির তকমা ও ক্ষেত্র থেকে আলাদা করে নিয়েছে। বামবাদ, দক্ষিণবাদ, মধ্যবাদ, সব কিছু থেকেই সচেতন দূরত্ব ঘোষণা করেছে, এবং অনিবার্য পার্শ্ব-ঘোষণা হিসেবে এসেছে— কোনও বৃহত্তর লক্ষ্য অস্বীকার, বৃহৎ নীতি বা আদর্শ বিষয়ে নীরবতা কিংবা বিমুখতা। বলতে হয়েছে, বড় আদর্শ চাই না, ছোট ছোট সমাধান চাই। আপ-এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চারিত্রবৈশিষ্ট্য সম্ভবত এটাই, যাকে হয়তো আমরা বলতে পারি ‘উত্তর-আদর্শবাদ’ অবস্থান।
বিশ শতকের শেষাংশেই এই উত্তর-আদর্শবাদ-এর চিহ্ন দেখতে শুরু করেছি আমরা। সোভিয়েত-উত্তর বিশ্বে একটা স্পষ্ট ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে যে, কমিউনিজম-এর অব্যর্থ দোসর রাষ্ট্রীয় স্বৈর-ক্ষমতা। আর ধনতন্ত্রের মধ্যে যে পুঁজি-স্বৈরবাদ, তার দাপটও রাষ্ট্রের অঙ্গীভূত হতে দেরি হয় না। সুতরাং? সুতরাং চেনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পথে নতুন কোনও আশা নেই। যে বৃহৎ মতাদর্শ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যম, তার আশাও ছাড়তে হবে। নতুন পথ বানাতে হবে, যেখানে সাধারণ মানুষের উপস্থিতি অনেক বেশি, প্রতিনিধিত্ব অনেক সরাসরি। আগে থেকেই বড় পথটা ছকে না নিয়ে ছোট সমস্যার ছোট সমাধানের পথে চলতে হবে। আপ-এর বিরাট গুরুত্ব এই জায়গাটাতেই। আমাদের দেশে যেহেতু বড় দলের বড় আদর্শবাদ সব সময় ছোট কাজ, ছোট সমস্যাগুলোকে উপেক্ষা করে এসেছে, বিদ্যুৎ জল দুধ ওষুধ, কিংবা দৈনন্দিন নিরাপত্তা, এই সব ছোট সমাধানগুলোর দিকে ফিরে তাকায়নি, তাকায় না— আপ-এর আবেদন হয়ে উঠেছে বিস্ফোরক।
এ দিকে ইতিমধ্যে বেশ কিছু জরুরি তত্ত্ব প্রণয়ন হয়ে গিয়েছে গত দু-তিন দশকে, যার মর্ম, এ বার চাই নতুন সমাজ, যে সমাজ নিজেকেই নিজে শাসন করবে। ইতালীয় বিপ্লবী আন্তোনিয়ো নেগ্রি ও মার্কিন দার্শনিক মাইকেল হার্ট-এর ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো অব দ্য টোয়েন্টি-ফার্স্ট সেঞ্চুরি’ তাই বলছে। শুধু দার্শনিক কেন, সাংবাদিকরাও বলছেন, কী ভাবে ‘বিগ সোসাইটি’ ক্রমে অকেজো হয়ে পড়ছে, জরুরি হচ্ছে স্থানীয় সমাজের ভূমিকা। ‘দ্য লিডারলেস রেভলিউশন’ নামে বইটিতে কার্ন রস লিখেছেন: নতুন রাজনীতিতে মানুষ তার নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গা পাবে। প্রতিনিধিত্বের গণতন্ত্রকে হটিয়ে আসবে অংশগ্রহণের গণতন্ত্র।
মানুষ নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবে? এ-ও কি সম্ভব? শুনতে অসম্ভব ঠিকই, কিন্তু মানুষ যে শেষ পর্যন্ত কী পারে আর কী পারে না, বলা যায় না। দক্ষিণ ব্রাজিলের পোর্তো আলেগ্রে শহর দীর্ঘ সময় এই বিকল্প গণতন্ত্রের পথে হেঁটে দেখিয়েছে, ব্যাপারটা একেবারে ভাবনাতীত নয়। সেখানে ১৯৮৯ সালে সমস্ত মানুষের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে বাজেট পর্যন্ত তৈরি করা গিয়েছিল। নাগরিকরাই গণভোটের মাধ্যমে ঠিক করতেন কী ভাবে খরচাখরচ চলবে। সম্প্রতি ‘অকুপাই’ আন্দোলনও এমন অ্যাজেন্ডা নিয়ে এসেছে স্থানীয় বা সীমিত ভিত্তিতে। প্রসঙ্গত, আমাদের দেশেও এই ধরনের কথা শোনা গিয়েছিল চার দশক আগে, সত্তরের দশকে জয়প্রকাশ নারায়ণের জনতা আন্দোলনের সময়। সাধারণ মানুষকে রাজনীতিতে অংশ দেওয়ার দাবি উত্তাল হয়েছিল, আন্দোলন ভিন্পথে ঘুরে যাওয়ার আগে।
সে দিনের ‘জনতা’র সঙ্গে আজকের ‘আপ’-এর মিল আছে। অমিলও। মিল আছে নামে, মিল আছে প্রেক্ষিতে। সেই দুর্নীতি ও ক্ষমতাতন্ত্রের বিরুদ্ধতা। তারাও সে দিন প্রচলিত দল-রাজনীতি চায়নি, এরাও চায় না। তবে এক জায়গায় কিন্তু দুইয়ের মধ্যে বিরাট বেমিল। জে পি-র সামনে একটা স্পষ্ট আদর্শ ছিল, গাঁধীবাদ-সমাজতন্ত্রের মিশ্র আদর্শ। আপ আন্দোলন আদর্শহীন, এমনকী আদর্শবিরোধী। এই অমিলটা ঘটতে পারল বিশ্ব-প্রেক্ষিতটা ইতিমধ্যে পাল্টে গিয়েছে বলেই।
আর সেই পরিবর্তিত বিশ্ব-প্রেক্ষিতের জন্যই, বা সেই প্রেক্ষিতের অনিশ্চয়তার জন্যই, আজকের আপ যা বলছে, তার মধ্যে কিন্তু থেকে যাচ্ছে বহু উত্তরহীন প্রশ্ন। সত্যিই কি ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতা সরিয়ে রাখতে গেলে বৃহৎ-আদর্শমুক্ত রাজনীতিতেই পৌঁছতে হবে? সত্যিই কি সেই আদর্শ-উত্তর পরিসরে সব মানুষকে সমান জায়গা দেওয়া সম্ভব? মানুষের সরাসরি অংশগ্রহণের মাধ্যমে যে গণতন্ত্র, তা তো শেষ পর্যন্ত সংখ্যাগুরুতন্ত্র। কিন্তু গণতন্ত্র আর সংখ্যাগুরুতন্ত্র কি কখনও এক হতে পারে, হওয়াটা কি বাঞ্ছনীয়? তা ছাড়া, ছোট সমস্যার সমাধান কি সত্যিই নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে করে যাওয়া সম্ভব, যদি তার মধ্যে একটা বড় আদর্শের নিশানা না থাকে?
আরও একটা কথা। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই ধর্নায় বসে একের পর এক ফাইল সই করে যাওয়ার যা প্রতীকায়িত করতে চায়, তা হল রাজনৈতিক সমাজ ও অরাজনৈতিক সমাজের বিভাজনরেখা ভেঙে দিয়ে নতুন ‘রাজনীতি’র সংজ্ঞা তৈরি। কিন্তু সেই চেষ্টার মধ্যে অবধারিত একটি ধাপ হল, নৈরাজ্য। নিজেকে নৈরাজ্যবাদী ঘোষণা না করে কেজরিওয়ালের উপায় ছিল না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সামনে প্রতিবাদী ধর্না থেকে শুরু করে প্রজাতন্ত্র দিবস নিয়ে হুমকি, এ সবের মধ্যে ‘গিমিক’ বা কংগ্রেসকে বিপাকে ফেলে সংকট তৈরির প্রয়াস ছাড়াও তাই আরও একটা ব্যাপার আছে: এই ধরনের উত্তর-অদর্শবাদী গণ-আন্দোলনের নিজস্ব অন্তর্লীন বাধ্যতা। এখন প্রশ্ন হল, এই নৈরাজ্য তাঁকে ‘অভিমন্যু’ করে দেবে না তো? নৈরাজ্য অতিক্রম করার পথটা মিলবে তো? ‘তন্ত্র’ বিকল হয়ে গেলে ভয়ংকর। কিন্তু তন্ত্র-শূন্যতা তো হতে পারে ভয়ংকরতর!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.