ছাত্র পরিষদ ১, এসএফআই ২!
এই সংখ্যা কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র তোলার। মঙ্গলবার দুপুরের পরেই চিত্রটা পরিষ্কার হয়ে গেল। যার নিরিখে দেকা যাচ্ছে, এ বার জেলার ১৪টির মধ্যে ১২টি কলেজই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিনিয়ে নিল তৃণমূল ছাত্র পরিষদ। একটি পেল ছাত্র পরিষদ ও তৃণমূল ছাত্র পরিষদ জোট।
এসএফআইয়ের অভিযোগ, এ দিন পুলিশ-প্রশাসনের তরফে সংগঠনের কর্মী-সমর্থকদের কোনও নিরাপত্তা দেওয়া হয়নি। টিএমসিপি-র সন্ত্রাসের জেরে বহু ক্ষেত্রেই কার্যত কেউ-ই কলেজের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারেননি। আর তার জেরেই তারা জেলার প্রায় কোথাও-ই ছাত্র সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী দিতে পারলেন না। এসএফআইয়ের এই দাবিকে অবশ্য উড়িয়েই দিচ্ছেন টিএমসিপি নেতৃত্ব। তাঁদের পাল্টা দাবি, আসলে নিজেদের সাংগঠিক দুর্বলতার জন্যই বিরোধীরা বেশির ভাগ কলেজে প্রার্থী দিতে পারেননি। এখন তাঁরা তাই সন্ত্রাসকে অজুহাত করছেন। |
বোলপুর কলেজের সামনে ছাত্রদের জটলা। |
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত ওই কলেজগুলিতে এ দিনই ছিল মনোনয়পত্র তোলার প্রথম ও শেষ দিন। আজ, বুধবার ওই মনোনয়নপত্রগুলি জমা নেওয়া হবে। গত নির্বাচনে এসএফআই জেলায় ৫টি কলেজে প্রার্থী দিয়েছিল। বিপুল ভোটে জিতেছিল মল্লারপুর টুরকু হাঁসদা-লেপসা হেমব্রম কলেজ। কিন্তু এ দিনের পরে দেখা যাচ্ছে ১২টি কলেজেই কোনও নির্বাচন হবে না। এসএফআই নেতৃত্ব জানিয়েছেন, এ দিন মল্লারপুরের কলেজটির ১৯টি আসনের মধ্যে ১৯টিতেই তাঁরা মনোনয়নপত্র তুলতে পেরেছেন। অন্য দিকে, খয়রাশোল শৈলজা ফাল্গুনী স্মৃতি মহাবিদ্যালয়ের ১২টির মধ্যে তাঁরা ৬টি আসনে মনোনয়নপত্র তুলেছেন। ওই কলেজে ১২টি আসনের জন্য মোট ৫৭টি মনোনয়নপত্র তোলা হয়েছে। যার পিছনে রাজনৈতিক মহলের দাবি, ছাত্র সংসদ নির্বাচনেও এলাকায় অশোক ঘোষ এবং অশোক মুখোপাধ্যায় তৃণমূলের ওই দুই গোষ্ঠীর ছায়া রয়েছে।
এ দিন সকাল থেকেই রামপুরহাট ছাত্রপরিষদ এবং তৃণমূল ছাত্র পরিষদ কর্মী-সমর্থকদের বাইক বাহিনীকে কলেজের গেটের সামনে নজরদারি করতে দেখা যায়। দুপুর ১টার সময় ফোনে ধরা হলে এসএফআইয়ের জেলা সভাপতি ঋক চক্রবর্তী বলেন, “আমাদের কর্মী-সমথর্কেরা কলেজে ঢোকার চেষ্টা করছেন। দেখা যাক, মনোনয়নপত্র তুলতে পারি কিনা।” কিন্তু দুপুর ২টো বাজলে জয় সুনিশ্চিত বুঝেই ‘বন্দেমাতরম’ আর ‘এসএফআই গো ব্যাক’ শ্লোগানে গেটের সামনে উল্লাসে ফেটে পড়েন টিএমসিপি ও সিপি-র কর্মী সমর্থকেরা। পরে তারা শহর জুড়ে বিজয় মিছিলও বের করেন। তৃণমূলের একটি সূত্রের খবর, ঊর্ধ্বতন নেতৃত্ব সিপি-র সঙ্গে থাকা জোট থেকে বেরিয়ে এসে রামপুরহাট কলেজে তৃণমূল ছাত্র পরিষদকে একা লড়ার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু, কলেজ সূত্রে খবর, এ বারও দুই সংগঠন জোট করেই মনোনয়নপত্র তুলেছে। যদিও তৃণমূলের জেলা সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “রামপুরহাট কলেজে যাঁরা মনোনয়নপত্র তুলেছে, সকলেই তৃণমূল ছাত্র পরিষদ কর্মী।” যদিও সেই দাবি উড়িয়ে দিয়ে শহরের যুব কংগ্রেস নেতা ওয়াসিম আলি ভিক্টর বলেন, “ছাত্রছাত্রীদের দাবি মেনেই রামপুরহাটে টিএমসিপি-র সঙ্গে সিপি জোট করেছে। জোট না হলে কলেজে ছাত্র সংঘর্ষের ঘটনা ঘটত। তাই জোট জারি রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েই মনোনয়নপত্র তোলা হয়েছে।” |
সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজে পুলিশি টহল। |
এ দিকে ছাত্র পরিষদের অভিযোগ, মুরারই কবি নজরুল কলেজে টিএমসিপি তাদের কর্মী-সমর্থকদের মনোনয়নপত্র তুলতে দেয়নি। স্থানীয় ছাত্রপরিষদ নেতা অজিউল ইসলামের দাবি, “টিএমসিপি কর্মীরা জোর করে কলেজের গেটে তালা লাগিয়ে দেওয়ায় আমরা মনোনয়নপত্র তুলতে পারিনি। বারবার কলেজ কর্তৃপক্ষ থেকে মুরারই থানার ওসি এবং মুরারই ১ বিডিও-কে জানালেও কেউ কোনও পদক্ষেপ করেনি।” মুরারই ১ ব্লকের কংগ্রেস সভাপতি আলি মোর্তাজা খান বলেন, “পুলিশ-প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের ছাত্রেরা নির্বাচনের লড়াই থেকে বঞ্চিত হলেন।” তাঁরা ফের মনোনয়নপত্র তোলার সুযোগ চেয়ে বৃহত্তর আন্দোলনে নামার হুমকি দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট বিডিও আবুল কালাম বলেন, “অভিযোগ পেয়ে দুপুর ১টা নাগাদ কলেজে গিয়ে দেখি কলেজের গেটে তালা ঝুলছে। এক পক্ষ কলেজের ভিতরে, অন্য পক্ষ গেটের বাইরে। তালা ভাঙার চেষ্টা করলে এক পক্ষ বাধা দেয়। পরে ১টা ৪০ মিনিট নাগাদ তালা ভেঙে দিই।” তখন বাইরে থাকা আর কেই মনোনয়নপত্র তোলার আর চেষ্টা করেননি বলে তিনি জানিয়েছে। কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিমাইচন্দ্র মণ্ডল বলেন, “বিডিও এবং থানার ওসিকে খবর দেওয়ার পরে তাঁরা এসে তালা খোলার ব্যবস্থা করেন। তখনও মনোনয়নপত্র তোলার সময়ও ছিল। কিন্তু বাইরে থাকা পক্ষ তাতে রাজি হয়নি।” পরে অবশ্য তাঁরা একটি আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন। টিএমসিপি তালা ঝোলানোর অভিযোগ মানেনি।
অন্য দিকে, সাঁইথিয়া অভেদানন্দ কলেজে ২৯টি আসনের জন্য ৫১টি মনোনয়নপত্র তোলা হয়েছে। কলেজ সূত্রে খবর, এখানেও কেবল টিএমসিপিই মনোনয়নপত্র তুলেছে। একই চিত্র নলহাটি হীরালাল ভকত কলেজ, হেতমপুর কৃষ্ণচন্দ্র কলেজ, বোলপুর, ইলামবাজার, নানুর ও লাভপুর এলাকার কলেজগুলিতেও। বেশির ভাগ কলেজেই এসএফআই এই প্রথম মনোনয়নপত্র জমা দেয়নি। হেতমপুর কলেজের তথা এসএফআই জেলা সম্পাদকমণ্ডলির সদস্য জ্যোতির্ময় দে-র দাবি, “গতবার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় আমাদের ছেলেমেয়েরাই মার খেয়েছিল। অথচ পুলিশ তাঁদেরই মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে ছিল। এ বার তাই অশান্তি এড়াতেই আমরা যাইনি।” এ বারই প্রথম ছাত্র সংসদ নির্বাচন হবে বোলপুর পূর্ণীদেবী চৌধুরী মহিলা কলেজে। ১২টি আসনের জন্য ২০টি মনোনয়নপত্র তোলা হয়েছে। |
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে রামপুরহাটে উচ্ছ্বাস।—নিজস্ব চিত্র। |
এসএফআইয়ের জেলা সভাপতি ঋক চকবর্তীর অভিযোগ, “টিএমসিপি-র গুন্ডাবাহিনীরস ন্ত্রাসের মুখেও আমরা বেশ কয়েকটি কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে লড়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। কিন্তু কার্যত কোথাও-ই মনোনয়নপত্র তোলার দিন পুলিশ-প্রশাসন আমাদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিয়ে ভরসা দিতে পারেনি। সংগঠনের ছেলেমেয়েদের নিরাপত্তাই যেখানে সুনিশ্চিত নয়, সেখানে তাঁদের কেন মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেব?” এসএফআইয়ের অভিযোগ অস্বীকার করে টিএমসিপি-র জেলা সভাপতি সুরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, “আমরা ১২টি কলেজে নিরঙ্কুুশ ভাবে জয়ী হয়েছি। নিজেদের সাংগঠিক দুর্বলতা ঢাকবার জন্যই এসএফআই সন্ত্রাসের কথা বলছে। আর এ জেলায় এখন ছাত্র পরিষদ বলে তো কিছু নেই। তাই ওদের নিয়ে আর কী বলব!” এ দিকে, জেলার পুলিশ সুপার সি সুধাকরের দাবি, “সব ক’টি কলেজেই নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যেখানেই অভিযোগ মিলেছে, পদক্ষেপ করা হয়েছে।” অন্য দিকে, এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনা। |