সপ্তাহভর একঘেয়ে বাড়ির খাবার খেয়ে জিভে চড়া। ছুটির দিনে তাই পাড়ার দোকান থেকে গরমাগরম বিরিয়ানি। মনমাতানো গন্ধ, প্রাণকাড়া স্বাদ। বাড়িসুদ্ধ সকলে খুশ!
রসনা না হয় তৃপ্ত হল। কিন্তু স্বাস্থ্য?
সেটা খতিয়ে ভাবলে খুশির আমেজ উধাও হতে পারে। কারণ ল্যাব-রিপোর্ট বলছে, বহু ক্ষেত্রে বিরিয়ানিতে রং ধরাচ্ছে ‘মেটানিল ইয়েলো’ নামের এক রাসায়নিক, যা কিনা মানবদেহের পক্ষে বিস্তর ক্ষতিকর। বিভিন্ন ধরনের চকোলেট ও বিস্কুটেও ক্ষতিকারক রং মেশানো হচ্ছে। চপ-কাটলেটে দেওয়া বিস্কুট-গুঁড়োতেও তা-ই।
বাজারের হরেক ফল-সব্জিতেও হরেক নিষিদ্ধ রাসায়নিকের মিশেল। যেগুলো পেটে গেলে ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে বলে হুঁশিয়ার করছেন চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞেরা।
কলকাতা জুড়ে দোকানে-রাস্তায় বিক্রি হওয়া বিবিধ খাবারে এ হেন মারাত্মক ভেজালের কথা জানাচ্ছেন পুরসভার খাদ্য বিভাগের নজরদার, অর্থাৎ ফুড ইনস্পেক্টরেরা। আইন মোতাবেক খাদ্যে ভেজাল ধরার ভার ওঁদেরই হাতে ন্যস্ত। তবে আইন-ই সার। তা বাস্তবায়িত করার কার্যত কোনও পরিকাঠামোই ওঁদের হাতে নেই বলে অভিযোগ। পুর-সূত্রের খবর: খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধের লক্ষ্যে ১৯৫৪-তে তৈরি আইনটি (প্রিভেনশন অফ ফুড অ্যাডাল্টারেশন অ্যাক্ট) বাতিল করে নতুন আইন ঘোষিত হয় ২০০৬-এ। এমনিতেই নয়া আইন (ফুড সেফটি অ্যান্ড স্টার্ন্ডার্ড অ্যাক্ট) কলকাতা পুরসভায় বলবৎ হয়েছে প্রণয়নের পাঁচ বছর বাদে, ২০১১-র ৬ অগস্ট। তার উপরে আইন মোতাবেক কাজ বিশেষ কিছুই হয়নি।
বরং নতুন আইন চালু হওয়ার পরে কাজের গতি আগের চেয়েও ঢিমে হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ শোনা যাচ্ছে পুরসভার অন্দরে। নজরদারির বালাই কার্যত শূন্যে গিয়ে ঠেকেছে। দেদার ভেজাল মিশিয়েও পার পেয়ে যাচ্ছে অভিযুক্তেরা। “পুরনো ডাল ঝকঝকে করতে এক ধরনের ক্ষতিকারক রাসায়নিক দিয়ে পালিশ করা হচ্ছে। আপেল, কুলের মতো ফল যাতে পুরনো হলেও তাজা দেখায়, তাই ধোয়া হচ্ছে পোড়া ডিজেলে। বেগুন, করলা ইত্যাদি এমন সব কেমিক্যালে ভিজিয়ে রাখা হচ্ছে, যা শরীরে ঢোকা মানে বিরাট বিপদ।” জানাচ্ছেন এক ফুড ইনস্পেক্টর।
ওই ইনস্পেক্টরের আক্ষেপ, এই সব চরম অপরাধের কথা জেনেও নীরব দর্শক হয়ে থাকা ছাড়া পুরসভার কোনও উপায় নেই। কেন?
উত্তরে লোকাভাবের যুক্তি দিচ্ছেন কর্তারা। পুর-সূত্রের তথ্য, কলকাতা পুরসভায় স্বীকৃত খাদ্য নজরদারের পদের সংখ্যা ৩১-এ বাঁধা রয়েছে দীর্ঘ দিন। অথচ গত ক’দশকে ক্রেতা-বিক্রেতা যেমন বেড়েছে, তেমন ভেজাল দেওয়ার প্রবণতাও ঊর্ধ্বগামী। তবু বরাদ্দ পদের সংখ্যা তো বাড়েইনি, উল্টে ইনস্পেক্টরের আট-আটটা পদে এখন লোক নেই! অভিযানে সাক্ষী হিসেবে এবং নির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব সামলাতে প্রতি ইনস্পেক্টরের সঙ্গে এক জন আর্দালি থাকার কথা। আর্দালি ক্রমশ কমলেও নতুন নিয়োগ হয়নি। বাজেয়াপ্ত নমুনার বিররণ লেখেন যাঁরা, সেই হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট ও আপার ডিভিশন ক্লার্ক-ও বাড়ন্ত। |
রঙিন সর্বনাশ |
 |
খাবার |
মেশানো হয় |
প্রতিক্রিয়া* |
 |
গুঁড়ো হলুদ, বিরিয়ানি,
পোলাও, ডাল |
মেটানিল ইয়েলো |
প্রজনন ও গর্ভধারণ
ক্ষমতা নষ্ট |
গুঁড়ো লঙ্কা |
লেড ক্রোমেট |
রক্তাল্পতা |
পটল, মটর |
সবুজ রাসায়নিক |
কিডনির
কার্যকারিতায় কোপ |
লাল মিষ্টি |
রেড অক্সাইড |
মাথা ঘোরা,
বমি ভাব, দুর্বলতা |
সবুজ মিষ্টি |
ম্যালাসাইড গ্রিন |
ক্যানসারের আশঙ্কা |
মাছের কানকো |
কঙ্গো রেড |
হতে পারে টিউমার |
* মাত্রাতিরিক্ত দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারে সব ক্ষেত্রেই ক্যানসারের আশঙ্কা
সূত্র: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় |
|
পরিণামে নগর জুড়ে ভেজাল-রাজের রমরমা। অন্য দিকে প্রতিরোধের প্রক্রিয়া কতটা খুঁড়িয়ে চলছে, পুর-তথ্যেই তার ইঙ্গিত। নতুন আইন চালু হওয়ার পরে, ২০১২-য় নমুনা সংগ্রহ হয়েছে সাকুল্যে ২৬টি। ২০১৩-য় ৭৪টি। নমুনা পরীক্ষার ফলাফল নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীকে জানানোর নিয়ম। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা হয়নি। কেননা নমুনা পরীক্ষার পর্বই ঠিকঠাক সারা যাচ্ছে না। এ জন্য আঙুল উঠছে পরিকাঠামোর ঘাটতির দিকে। পুর-সূত্রের খবর, খাদ্যে ভেজাল প্রমাণ করতে যে সব আধুনিক যন্ত্রপাতি দরকার, পুর-পরীক্ষাগারে তার বেশির ভাগ অনুপস্থিত। এমনকী নরম পানীয়ে কীটনাশক মেশানো হচ্ছে কি না, তা-ও জানার উপায় নেই। উপরন্তু নমুনা-পরীক্ষকের চিরন্তন অভাব।
সুতরাং নমুনা সংগ্রহের পরের ধাপের প্রক্রিয়া থমকে যাচ্ছে হামেশা। যদিও পুর-কর্তাদের দাবি, গত দু’বছরে সংগৃহীত নমুনার ১৮টিতে তাঁরা ভেজাল ধরতে পেরেছেন। সেই সব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া অবশ্য তেমন এগোয়নি। কেন?
এখানেও যুক্তি লোকাভাব। পুর-সূত্রের ব্যাখ্যা: নতুন আইন অনুযায়ী প্রক্রিয়াটি সম্পাদনের জন্য অতিরিক্ত জেলাশাসক মর্যাদার এক অফিসারকে ‘অ্যাডজুডিকেটর’ হিসেবে রাখা বাধ্যতামূলক। কিন্তু কলকাতা পুরসভায় কোনও আলাদা অফিসারকে দায়িত্বটি না-দিয়ে যুগ্ম কমিশনারকে প্রক্রিয়া তদারকির ভার দেওয়া হয়। অভিযোগ, প্রশাসনিক অন্যান্য কাজের চাপে যুগ্ম কমিশনার ভেজাল-রোধের বিষয়টিতে যথেষ্ট নজর দিতে পারেননি।
বস্তুত ভেজাল ধরার বিভাগটিকে যতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল, তা আদৌ দেওয়া হয়নি বলে পুর-আধিকারিকদের অনেকেরই দাবি। “তাই ভেজাল-অভিযানও যে মুখ থুবড়ে পড়বে, তাতে আশ্চর্য কী?” কটাক্ষ এক অফিসারের। প্রশাসকেরা এখন কী ভাবছেন?
পুর-কর্তৃপক্ষের বক্তব্য: এ বার কাজে গতি ও জোর আনার সর্বাত্মক প্রয়াস চলছে। আইনি প্রক্রিয়ার ব্যাপারটা দেখভালের দায়িত্ব সম্প্রতি দেওয়া হয়েছে অন্য এক পদস্থ অফিসারকে। বিভাগীয় মেয়র পারিষদ পার্থ হাজারি বলছেন, “দীর্ঘ কাল ধরে বেশ কিছু পদ ফাঁকা পড়ে আছে। তাতে লোক নেওয়ার চেষ্টা করছি। উপরন্তু ল্যাবরেটরির মান উন্নত করতে আমাদের বাড়তি জায়গা দরকার। তা নিয়ে মেয়রের সঙ্গে কথা হয়েছে।”
পুর-সূত্রের খবর: পুরসভার এখনকার পরীক্ষাগারের আয়তন দু’হাজার বর্গফুট। অন্তত পাঁচ হাজার বর্গফুট জায়গা নেওয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে। পুরভবনের সামনে সাবেক চ্যাপলিন হলে যে নতুন ভবন হওয়ার কথা, সেখানেই নতুন ল্যাব গড়ার চিন্তা-ভাবনা চলছে।
ভেজাল-প্রতিরোধে পুরসভার ‘সীমিত ক্ষমতা’র কথা কবুল করেছেন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ও। “এত বড় শহরে ভেজাল ধরতে যে পরিকাঠামো দরকার, তার সংস্থান শুধু পুরসভার পক্ষে করা সম্ভব নয়। রাজ্য সরকারের সাহায্য চাইব। তবে শূন্য পদে নিয়োগ ও ভেজাল সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে ব্যবস্থা নিচ্ছি।” মন্তব্য মেয়রের।
রাজ্য সরকারের কী বক্তব্য?
রাজ্য সরকারের খাদ্য কমিশনার গৌতম ঘোষ বলেন, “ভেজালের রমরমা এক দিনে হয়নি। এটা মোকাবিলার পর্যাপ্ত পরিকাঠামো নেই। আমি সবে দায়িত্ব নিয়েছি। পুর-কর্তৃপক্ষকে শীঘ্রই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আর্জি জানাব।” |