শীতের মরসুমে বনভোজন ছাড়াও বেড়ানোর জন্য ইছামতী নদীর পাড় ঘেঁষে তৈরি করা হয়েছিল সুসজ্জিত উদ্যান। কিন্তু লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে তৈরি করা সেই উদ্যানগুলিই এখন পুলিশের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজ্যে পর পর নারী নিগ্রহের ঘটনার প্রেক্ষিতে উদ্যানগুলির বেহাল অবস্থার সুযোগে সেখানে অসামাজিক র্কাযকলাপ বাড়া নিয়ে স্থানীয় মানুষের অভিযোগে তাঁরা উদ্বিগ্ন। বসিরহাট পুর কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়ে তাঁরা চিঠিও দিয়েছেন। বসিরহাট থানার আইসি প্রসেনজিত দাস বলেন, “পুলিশ যথাসম্ভব নজরদারি চালালেও পুরসভাকেও পার্কগুলির দিকে নজর রাখতে হবে। নয়তো যে কোনও সময় বড় ধরনের কোনও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।” |
ইছামতী নদীকে কেন্দ্র করে এলাকায় পর্যটনের প্রসার বাড়াতে বসিরহাট মহকুমাশাসকের বাংলোর সামনে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে নদীর ধার ঘেঁষে কয়েকটি সুসজ্জিত পিকনিক স্পট তৈরি করেছিল পুরকর্তৃপক্ষ। সেগুলিতে বসার জন্য বাহারি চেয়ার তৈরির পাশাপাশি রোদ এড়াতে সেগুলির উপরে ছাউনি তৈরি করে দেওয়া হয়। লাগানো হয়েছিল আলোর ফোয়ারা, বাহারি ফুলের গাছ। নদীর ধারে বালি ফেলে সেখানে লাগানো হয়েছিল ঝাউ গাছ। তৈরি করা হয়েছিল কৃত্রিম পাহাড় বেয়ে আসা ঝরনা। বসানো হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবক্ষ মূর্তি সহ শিশুদের মনোরঞ্জনে খেলাধুলার সরঞ্জাম। রবীন্দ্রসৈকত নামে ওই উদ্যানের উদ্বোধন করেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি শ্যামল সেন। তারপর থেকে শুধু স্থানীয় নয়, এমনি সময় বিশেষ করে শীতের মরসুমে আশপাশের জেলা এবং কলকাতা থেকেও বহু মানুষ এখানে পিকনিক করতে বা বেড়াতে আসতেন। |
রেলিং উধাও হয়ে গিয়েছে পার্কের। |
আর এখন?
বেহাল, হতশ্রী চেহারা নিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে পিকনিক স্পট ও পার্কগুলি। চুরি হয়ে গিয়েছে চারপাশের রেলিংয়ের পাইপ। ভেঙে পড়েছে বসার জায়গা। জল শুকিয়ে গিয়ে ফোয়ারাগুলি এখন নিস্প্রাণ। শুকিয়ে গিয়েছে কৃত্রিম ঝরনা। অধিকাংশ খেলার সরঞ্জাম, বসার জায়গার মাথার আচ্ছাদন চুরি হয়ে গিয়েছে। বাহারি ফুলের বদলে মাঠভর্তি এবং চারপাশ ভরেছে আগাছায়। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধুলো জমেছে রবীন্দ্রমূর্তির গায়ে। এমন অবস্থার মধ্যেও স্থানীয় কেউ কেউ এখনও পার্কে এলেও তাঁদের অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। এমনই একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রৌঢ়া জানালেন, “বিকেলে পার্কে একটু হাঁটতে আসি। কিন্তু অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের যে ভাবে সেখানে আচরণ করতে দেখি তাতে লজ্জায় পড়তে হয়। তা ছাড়া সন্ধে হলেও এমন সব ছেলেরা জমায়েত হতে থাকে তাতে নিরাপত্তারঅভাব বোধ করি।” বস্তুত এই প্রৌঢ়ার মতো অভিজ্ঞতা অন্যদেরও। স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, সন্ধের পর পার্কগুলো এখন গাঁজা, নশাখোরদের আড্ডার নিরাপদ জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে।” যে ভাবে একের পর এক নারী নিগ্রহের ঘটনা ঘটছে তাতে এই পরিস্থিতিতে তাঁরা যে আতঙ্কিত তাও জানাতে ভোলেননি। সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজীব দাস, প্রমিতা গড়াই বলেন, “বিকেলে বাচ্চাদের নিয়ে বেড়াতে এসে টিনএজার ছেলেমেয়েদের যে ভাবে আপত্তিকর অবস্থা দেখা যায় তাতে ছোটদের পার্কে না নিয়ে আসাই সমীচিন। আগে বাড়িতে অতিথি এলে পার্ক দেখাতে নিয়ে আসতাম। এক সময় পরিচিতদের অনেককে চড়ুইভাতি করার জন্যও এখানে আসতে বলেছি। এখন আর ভরসা হয় না।”
২০০৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর বসিরহাট টাউন হলের পাশে প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা খরচে আলোর ঝরনার উদ্যান উদ্বোধন করেছিলেন তদানীন্তন সিপিএম বিধায়ক ও মন্ত্রী গৌতম দেব। ইছামতী নদীর ধারে সুন্দর পার্কটিতে ঝরনার পাশাপাশি ফুলের বাগান ছাড়াও শিশুদের খেলার নানা উপকরণ ছিল। কিন্তু এখন সেই পার্ক দেখে সে সব আর বোঝার উপায় নেই। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হতে বসেছে সূর্যকান্ত উদ্যান এবং মির্জাপুরে প্রায় ১০০ বিঘা জমিতে তৈরি শহিদ দিনেশ মডুমদার শিশুপার্ক ও ইছামতী পিকনিক গার্ডেন। দেখা গেল ইছামতী থেকে খাল কেটে তৈরি করা লেকে ভেঙে পড়ে রয়েছে প্যাডেল বোট। পিকনিক পার্টির জন্য তৈরি করা খড়ের ছাউনিগুলিরও অবস্থা খারাপ। এখানে পর্যটকদের রাত্রিবাসের জন্য ট্যুরিস্ট লজ, সায়েন্স পার্ক, কুমির প্রকল্প, টয় ট্রেন, রোপওয়ে তৈরির কথা থাকলেও তা আর বাস্তবে পরিণত হয়নি।
রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পিকনিক স্পট ও পার্কগুলির শোচনীয় অবস্থার কথা স্বীকার করেছেন বসিরহাটের উপপুরপ্রধান অমিত দত্ত। তিনি বলেন, “দুষ্কৃতীরাই পার্কগুলির দামী সরঞ্জাম চুরি করে নিয়ে গিয়েছে। পরিবেশও নষ্ট হচ্ছে। সমস্ত বিষয়েই পুলিশকে জানানো হয়েছে।” তাঁর দাবি, “পর্যটন শিল্পের উন্নতিতে পার্কগুলি সাজানোর জন্য রাজ্য সরকারের কাছে ২০ লক্ষ টাকা চাওয়া হয়েছে। টাকা পেলেই কাজ শুরু করা হবে।” পুরসভার বিরোধী দলনেতা তৃণমূলের পার্থসারথি বসুর অভিযোগ, “কংগ্রেস পরিচালিত এই পুরসভার পর্যটন নিয়ে কোনও আগ্রহ নেই। রাজ্য সরকারের পক্ষে ইতিমধ্যেই বসিরহাটের উন্নতিতে প্রায় ৪ কোটি টাকা মিললেও পার্কগুলির হাল ফেরেনি। সেগুলি মদ-জুয়ার আড্ডা-সহ নানা অসামাজিক কাজের আখড়া হয়ে গিয়েছে। এ ব্যাপারে পুলিশের নজরজারিতেও গাফিলতি রয়েছে।” |