কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের (কেটিপি) তিনটি ইউনিট যে ক্রমান্বয়ে দূষণ ছড়াচ্ছে, কার্যত তা কবুল করে নিলেন ওই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের শীর্ষ কর্তারা।
সম্প্রতি দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের শুনানিতে হাজির হয়ে কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার পুলক রায় জানান, ৪,৫, এবং ৬ নম্বর ইউনিটের সংস্কারের কাজে দ্রুত পদক্ষেপ করা হবে। সেই সঙ্গে, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১,২ এবং ৩ নম্বর ইউনিটের বয়লার ও চিমনির ঢেলে সাজার জন্য গ্লোবাল টেন্ডার ডাকা হচ্ছে বলে পর্ষদ কর্তাদের আশ্বস্ত করেছেন তিনি।
পুলকবাবু বলেন, “তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম তিনটি ইউনিটের (১,২,৩) উন্নীতকরণের জন্য ইতিমধ্যেই রাজ্যের বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম গ্লোবাল টেন্ডার ডাকার প্রস্তুতি নিয়েছে। চিমনিগুলির সংস্কার হলে দূষণের মাত্রাও অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।”
কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সাম্প্রতিক হাল হকিকত কী?
স্থানীয় গ্রামবীসারা জানাচ্ছেন, ধোঁয়া ও ছাই দূষণে পূর্ব মেদিনীপুরের কোলাঘাট ও শহিদ মাতঙ্গিনী এবং পড়শি হাওড়ার বাগনান-১ এবং ২ নম্বর ব্লকের প্রায় ৫০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে গ্রামবাসীদের নাভিশ্বাস উঠেছে। এলাকার অন্তত ৫৯টি গ্রামের মানুষের চাষ আবাদ থেকে প্রাত্যহিক জীবন যাপন মুখ ঢেকেছে কালো ছাইয়ে। অন্তত ৮৫ হাজার স্থানীয় গ্রামবাসীর পাশে দাঁড়িয়েছে বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তাদের দাবি, দূষণের জেরে নিত্য নতুন রোগেও জেরবার হচ্ছেন গ্রামবাসীরা।
স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতিনিধি হয়ে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদে অভিযোগ দায়ের করেছে ‘কৃষক সংগ্রাম পরিষদ’ এবং ‘কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধ কমিটি’ নামে দু’টি সংগঠন। ওই দুই সংগঠনের পক্ষে নারায়ণ নায়েক এবং সোমেশ মাইতির দাবি, পর্ষদের কাছে বার বার নালিশ জানানো হয়েছে। স্থানীয় গ্রামবাসীদের স্মারকলিপি পাঠানো হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও। নারায়ণবাবু বলেন, “দূষণ জনিত কারণে অসুস্থ স্থানীয় গ্রামবাসীদের কোলাঘাট প্লান্টের হাসপাতালে নিখরচায় চিকিৎসার দাবিও জানানো হয়েছে। তবে সে ব্যাপারে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কোনও সাড়া মেলেনি।”
স্থানীয় ওই দুই সংগঠনের অভিযোগ পেয়ে পর্ষদ কর্তৃপক্ষ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের শীর্ষ কর্তাদের তলব করে। পর্ষদের শুনানিতে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্তারা জানিয়েছেন, চিমনি সংস্কারের ব্যাপারে গ্লোবাল টেন্ডার ডাকার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁরা। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ছাই বোঝাই ট্রাকগুলি যাতে ঢাকা থাকে সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন তাঁরা। তবে সে আশ্বাস কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন নারায়ণবাবু।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, সামান্য সচেতনতা এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যবহার হলে দূষণের মাত্রা এমন ভয়ঙ্কর হত না। বিশিষ্ট পরিবেশবিদ তথা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন মুখ্য আইন-অফিসার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, “চিমনিতে আধুনিক ইলেক্ট্রো স্ট্যাটিক প্রেসিপিটেটর মেশিন বসানো উচ্চমানের কয়লা ব্যবহার, পরিকল্পিত বৃক্ষরোপণ আর একটু সচেতনতা, এটুকু থাকলেই এলাকায় দূষণের মাত্রা এমন ভয়ঙ্কর জায়গায় পৌঁছত না।”
স্থানীয় গ্রামবাসী প্রবীণ বিনোদ মাইতি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ধূমায়িত চিমনির দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করেন, “সেই সচেতনতা কবে আসবে বাবু বলতে পারেন!”
|
ক্ষতির খতিয়ান |
• চার ব্লকের ৫৯টি গ্রামে চর্মরোগের প্রকোপ।
• শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ, যক্ষ্মার প্রকোপ।
• তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাগোয়া জলা, পুকুর এবং খাল-বিলে ছাই দূষণে মাছ নষ্ট।
• ফুল চাষের ক্ষতি |
|